সন্তান ৩

কয়েক মাস দম ফেলার ফুরসত নেই দুই বান্ধবীর। সামনে পরীক্ষা যে! স্কুলে ঢোকার মুখে সহপাঠীদের ওই ছড়ার জবাব দিতে হবে তো!

ফাতেমা লেখাপড়ায় সব সময় মনোযোগী, আবার ওদিকে জিনাতকে যে কাজই করতে বলা হোক, সে করতে রাজি, তবে পড়তে বললেই যেন গায়ে জ্বর আসে তার। সে স্কুলে যায়ই মূলত ফাতুকে পাহারা দিতে। ছাত্রী হিসেবে জিনাত অতটা ভালো নয়।
‘মাইয়াডা আমার এমনিতে বড় লক্ষ্মী, তয় ওরে পড়তি কলিই তার ঘুম আসে,’ রান্নাঘরে মসলা পিষতে পিষতে শরিফা বানুকে বলেন আমেনা বেগম।


আমেনার কথার ধরন দেখে শরিফা বানু বলেন, ‘বুন, ডাক্তার আফার কথা মনে নাই তুমার? বলছিলেন ওরে লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষ বানাইতে...’
আদাবাটাটুকু পাটা থেকে বাটিতে তুলে শুধরে দিলেন আমেনা, ‘আফায় তো ফাতুর কতা কইছিলেন। আমারডার মাথাভরা খালি গোবর, আর কিসসু নাই!’ মায়ের কণ্ঠে দুঃখ ঝরে পড়ে।

ধমকে ওঠেন শরিফা বানু, ‘মা হইয়া ইডা কী কইলা আমেনা বুন? আর ফাতু তুমার মাইয়া হইলে তুমার জিনাতও আমার। ওর কতা এমনে কইবা না!’
মাটির চুলায় বসানো কড়াইতে মসলা কষাতে কষাতে এবার জলভরা চোখে শরিফার দিকে তাকান আমেনা, ‘এমনি কী আর কই গো ভাবি! আমি কেবল চাইর কেলাস পড়ছিলাম ওগো আব্বার লগে বিয়ার আগে। চাই তো মাইয়া দুইডা পড়ুক। খুকুর নয় সময় হয় নাই এহনো, তয় জিনাত? উডাও আমার মতো হবি?’

আমেনা বেগমের মতো অত কম বয়সে বিয়ে হয়নি শরিফা বানুর। তিনি আরও কিছুদূর পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন।
কষানো মসলায় কয়েকটা কই মাছ ভাজা ছেড়ে দিলেন শরিফা। ‘বুজছি, জিনাতের মাথা কাঁচা, তয় ও–ও পড়তি পারবি, কম হোলিও। জিনাত তো কত কিছু করতি পারে, আর খুকু রেও অয় কত কিছু কইরে সামলায়। কয়ডা মাইয়া এমন আছে? এহন কই মাছে রে যদি কও আম গাছে চড়তি আর বান্দররে যদি কও সাঁতরাইয়া নদী পার হতি, তয় কেমনে হয়?’
সে রাতে বাড়ি ফিরে ফাতেমার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মেয়ের চিবুক ধরে নিজের দিকে ফেরান শরিফা, ‘জিনাতেরে পড়াতি পারবি তুই? ফাতু?’

মায়ের কথায় ম্লান ফাতেমার মুখ, ‘ওরে কত কইছি জানেন আম্মা? ও কয় পরীক্ষা দিবি না! উডা পড়তিই চায় না!’
‘ওরে পড়তি হবিই... তুই কেমনে পড়াবি তুই জানিস,’ শরিফার আদেশ।
পরদিন জিনাতের সামনে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে ফাতেমা, ‘ওই ছেমড়ি, তুই পরীক্ষায় না বইলে আমিও বমু না!’
জিনাত অবাক হয়, ‘ওই, কী কস? ফাইজলামি করিস না ছেড়ি!’

দুষ্টুমির দ–ও নেই ফাতেমার কণ্ঠে, ‘পরীক্ষা দিবি না তো? আমার খাতা, কলম, বই সবডি জ্বালায় দি আয়গা পাকঘরে গিয়া!’
ওই জেদের কাছে হার মানতেই হলো জিনাতকে। অতএব, শেষতক দুজনেই পড়ার বইয়ে আটকে গেল।
ফাতেমা জানে না জিপিএ–ফাইভ কী? খায় না মাথায় দেয়? সে নতুন কিছু শেখার খুশিতে পড়ে। জিনাতও সেভাবেই বইকে ভালোবাসতে শিখল।

স্কুলে পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন আব্বাস আলিকে ডেকে আনা হলো। মেম্বার সাব দু–তিন বছর ধরে এসএসসির ফল নিজে দেখেন, ছোটখাটো ‘বকশিশ’ দেন যারা ‘ভালো পাস দেয়’ তাদের। এসবই অবশ্য গাঁয়ের কৃষক-তাঁতিদের থেকে ভোট নেওয়ার জন্য সহজ উপায়। আর যারা আব্বাসকে ভোট না দেন, তাদের পেছনে ভাড়া করা গুন্ডা লেলিয়ে দেন আব্বাস। জ্বালিয়ে দেন খেতের ফসল বা খড়ের চালের মাটির বাড়ি। কখনো কারও টাকা ধার করার প্রয়োজন পড়লে সেটার দায়িত্ব নাজমুল ছাড়া আর কার? নাজমুল নিজের বাড়ির নরম গদিতে বসে টাকা ধার দেয় বটে, তবে অবশ্যই চড়া সুদে। কেউ টাকা শোধ দিতে পারল না? নাজমুল বাড়ির গোয়াল থেকে দুধেল গাইয়ের সদ্য জন্মানো বাছুর পর্যন্ত টেনে বের করে নেয়।
যাক, তো নিয়মমতো একেকজনের ফল দেখছেন আব্বাস। সে বছর দশম শ্রেণিতে জিনাত-ফাতেমা ছাড়া আর মাত্র তিনজন মেয়ে ছিল। ৩০ জন ছাত্রছাত্রীর ২৫ জনই ছাত্র।

নাজমুল সেদিন কোনো কারণে ছিল না তার বাবার সঙ্গে। জিনাত-ফাতেমা ইচ্ছা করেই সবার শেষে ঢুকেছে স্কুলে। এক হাতে শক্ত করে ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে জিনাত।
আব্বাস আলির বিদ্যার দৌড় খুব একটা বেশি না। তিনি শুধু এটুকু জানেন যে জিপিএ তিনের একটু ওপরে উঠলেই সেটা ‘ভালো পাস’।

স্কুলের মাঠে মঞ্চ বানানো হয়েছে। একে একে সেই মঞ্চে ‘ভালো পাস’ ছাত্রদের ডেকে নিয়ে মুখে একটা মেকি হাসি টেনে নিয়ে প্রত্যেকের হাতে দুটো করে কড়কড়ে ১০০ টাকার নোট গুঁজে দিচ্ছেন আব্বাস। ‘লেখাপড়া জানা, ভালো পাস পোলা’দের বলছেন আরও ভালোভাবে পড়তে।
হঠাৎ নাম ডাকতে গিয়ে কিছুটা চমকে উঠলেন আব্বাস আলি, ‘আবদুল করিম... এইডা আবার কীডা?’
ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল করিম, ‘অই পোলা, তুই সেই বেজন্মাডা না? তোরে এই ইশকুলে নিসে কীডা? বাপ–মার ঠিক নাই, পড়তি আইছে!’
করিমের দিকে বাড়ানো দুটো নোটকে আবার সরিয়ে নিতে গিয়েছিলেন আব্বাস আলি। করিম প্রায় থাবা মেরে ছিনিয়ে নিল সেগুলো, ‘পড়তি গেলি তো বাপ–মা লাগে না মেম্বার কাহা, খালি নিজির মনডা লাগে।’
করিম মঞ্চ থেকে নেমে গেলে আবারও আব্বাসের আঁতকে ওঠার পালা, ‘এই দেহো দেখি, এহানে ভুল আছে, আল্লার কিরা! ইডা হতি পারে না।’
আব্বাসের কণ্ঠ শুনে এগিয়ে এল তার লোকজন, কী হইছে?
‘এইডা চাইর। ইডা তো দেহি পাঁচ, হে পাঁচই তো... জিনের আছর হইসে এই ইশকুলই... হতি পারে না... মাইয়া মানষি...’
আব্বাসের অবস্থা দেখে নাম দুটো পড়ে ডেকে নিল তার সঙ্গের লোকেরা। আর স্বাভাবিকভাবেই সেই ছড়া, ‘কালি আর মুটি...’
ছেলেমেয়েদের কথা শেষ হওয়ার আগেই মঞ্চের পেছন থেকে বেরিয়ে এলেন একজন কাঁচা–পাকা চুলের মাঝবয়সী পুরুষ, যাকে দেখে সবাই মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেল, ‘হে... উরা এক জুটিই তো, তাই একলগে ভালো পাস দিছে!’
এতক্ষণ থমথমে হয়ে থাকা সবার মুখেই এবারে ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি হাসি। আব্বাসের মুখেই কেবল কালো মেঘ।
এই লোককে পথ ছেড়ে দিল সবাই। পেছন থেকে সামনে এসে এবারে দুই বান্ধবীর হাতে দুটো বড় রঙিন কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন মিনহাজ হোসেন।
‘ধরো গো মা জননীরা... আর যা–ই করিস... লেহাপড়া ছাড়িস না!’
গ্রামের টাকার পাহাড় মেম্বার সাব এহেন আচরণ সহ্য করবেন কেন? হাঁক দিলেন আব্বাস, ‘ওই মাস্টার! খাড়াও! ওই মাস্টার!’
আর কিসের ‘ওই মাস্টার’? কোনো ধন্যবাদের তোয়াক্কা না করেই মিনহাজ ততক্ষণে পগার পার! ভিড়ে মিশে গেছেন তিনি।
আচমকা এমন উপহার আর সবার সামনে এমন ব্যবহার—দুটোর কোনোটাতেই অভ্যস্ত নয় জিনাত-ফাতেমা। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দুজন।
‘কী হইল রে, ফাতু?’
‘ও তো আমিউ বুঝি নাই কিছু, জিনাত! তয় আল্লায় যা করেন, ভালোর জন্নি করেন।’
‘চল বাড়ি যাই... আম্মা চিন্তা করতিছে...’
মুগ্ধতা, বিস্ময় আর জীবনের প্রথম যুদ্ধজয়ের আনন্দ—তিনে মিলে প্রায় বাতাসে ভাসতে ভাসতে বাড়ির পথে চলল দুজন।

*কী আছে দোকানি আবদুল করিমের অতীতে? কে এই মিনহাজ হোসেন? ছদ্মবেশী শ্বাপদ নয় তো? এবার কী করবে জিনাত-ফাতেমা? নাজমুল কোথায় গেল? কেমন আছে খুকু? চোখ রাখুন পরের পর্বে। চলবে...