থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে ১০

কানাডার হাইওয়ের রাস্তা। ছবি: সংগৃহীত
কানাডার হাইওয়ের রাস্তা। ছবি: সংগৃহীত

মার্চের শেষ দিককার কথা। সেদিন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। সাসকাতুন শহরের স্টোনব্রিজ এলাকাটা এই সময়ে নিঝুম পুড়ি। খাবার ঘরের জানালাটায় দাঁড়ালেই দূরের ঢালু উঁচু বাঁধটায় চোখ আটকে যায়। কোথাও কোথাও বরফ গলেছে, কোথাও জমাট বেঁধে আছে। ফ্যাকাসে বাদামি, কী ভীষণ বিচ্ছিরি একটা রং। সারি সারি চেরি, লাইলাক, হোথ্রোনগাছ লাগানো আছে বাঁধটার নিচবরাবর। নিকষ কালো অন্ধকারেরা ঘুপটি মারছে সেই চেরি, লাইলাক আর হোথ্রোনগাছের ডালপালার পেছনে। কালো হয়ে আসা মেঘের ভেতর ক্লান্ত আকাশের ঘুমিয়ে পড়া দেখতে দেখতে নিজেরও কেমন ঝিমুনি লাগছে। নিঝুম সন্ধ্যায় কোলাহল করে পাখিরা সব ঘরে ফিরছে। আলো–আঁধারিতে ঘরে ফেরা পাখিদের গলা ছেড়ে গল্পকথন শুনে মন উথাল-পাতাল করে। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়া সময়ে কিছুই কেন জানি ভালো লাগে না।

‘আমাদের প্রিয় সময় ফিরে যায় অভিমানে। আমাদের প্রিয় সময়, ভেসে যায় জনস্রোতে, ডুবে যায় মানুষের আশা। ডুবে যায় ভালোবাসা।’

ইউটিউবে এই গানটা শুনতে শুনতে ভীষণ বিমর্ষতায় ডুবে গেলাম। আজ মনে হচ্ছে মরার আগেই যেন মারা যাচ্ছি। আমার ইদানীং মনে হচ্ছে করোনাভাইরাসে মরার আগে আমি বুঝি হার্ট অ্যাটাকেই মারা যাব। পুরো পৃথিবীকে মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। পৃথিবীর শক্তিশালী চিকিৎসাব্যবস্থা যেন ভেঙে পড়ছে। ইতালিতে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। প্রতিদিনই খবর আসছে সারি সারি লাশের। চিকিৎসকদের আহাজারিতে ভরে যাচ্ছে ফেসবুক। স্পেন, ইরান আর নিউইয়র্কেও যেন ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা। জীবন যে আসলে কিছুই না, এখন উপলব্ধি করছি। মৃত্যুর মুখোমুখি না দাঁড়ালে জীবনের মূল্য বোঝা যায় না। এখন সবকিছুই ভীষণ মূল্যহীন মনে হচ্ছে। এই বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা, দামি জামা, মূল্যবান সবকিছুই কি মূল্যহীন।

জানালা থেকে তাড়াতাড়ি সরে এলাম কারণ ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা মোবাইল ফোনটা তখন বাজছে। আমার মেয়ে রোদেলার ফোন।
কী মা, কেমন আছ? একটু উৎকণ্ঠা নিয়েই বললাম।

অটোয়া থেকে সাসকাতুনের সড়কপথ। ছবি: সংগৃহীত
অটোয়া থেকে সাসকাতুনের সড়কপথ। ছবি: সংগৃহীত

ওপাশেও বেশ উত্তেজনা। ভালো আছি। আম্মু, আমি প্লেনের টিকিট ক্যানসেল করে ফেলেছি, আমি গাড়ি ড্রাইভ করে আসব বৃহস্পতিবারে।
ড্রাইভ করে আসবে? অটোয়া থেকে সাসকাতুন তো অনেক দূর, মা।
হ্যাঁ, প্রায় ২ হাজার ৯২৭ কিলোমিটার।
কী বলো? আমি প্রায় চিৎকার করেই উঠলাম।
সে এবার একটু গম্ভীর কণ্ঠেই উত্তর দিল, ৩৩ ঘণ্টা ২২ মিনিট ড্রাইভ, যদি কোথাও না থামি।
আমি ধপাস করে পাশের চেয়ারটায় হতবিহ্বল হয়ে বসে পড়লাম।
শোন আম্মু প্লেনে এখন ভীষণ রিস্ক। বিশেষ করে টরন্টো পিয়ারসন্স এয়ারপোর্ট। এখানে প্রচুর আন্তর্জাতিক যাত্রী থাকে আম্মু। ওখান থেকে সহজেই ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। এটা ভালো হবে
যদি ড্রাইভ করে আসি। আমার বন্ধু আফসানা মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিলে পড়ে। ওর বাবা সাসকাতুন থেকে আসছে ওকে নিতে। তিনি আমাকেও অটোয়া থেকে তুলে নেবেন। এটা প্লেনের চেয়েও কম খরচ।
এতক্ষণে সম্ভিত এল যেন। ও তাই বলো, আফসানার বাবা ড্রাইভ করবেন?
আমরা তিনজনই ড্রাইভ করব মা। অনেক সস্তা হবে।
জীবনের চেয়ে টাকা গূরুত্বপূর্ণ না। এই বিপদে টাকার কথা কে ভাবে বুড়ি? তোমার নিরাপদে এসে পৌঁছানোই তো বেশি জরুরি বাবা। কবে আসবে? বৃহস্পতিবার?
হ্যাঁ, বৃহস্পতিবার ভোরে রওনা হব।
কয়দিন লাগবে?
মেয়ের কণ্ঠ একটু রুক্ষ-বললাম তো বৃহস্পতিবার রওনা হয়ে শনিবার এসে পৌঁছাব।
রাখি মা, বাবাকে ফোন দিই।

অটোয়া থেকে সাসকাটুনের সড়কপথ। ছবি: সংগৃহীত
অটোয়া থেকে সাসকাটুনের সড়কপথ। ছবি: সংগৃহীত

ফোনটা অপাশ থেকে কেটে গেল, কিংবা দিল। রোদেলা আমার কন্যা। সে অটোয়ায় থাকে। কার্লটন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। করোনাভাইরাসের কারণে অন্টারিও প্রভিন্সের সব ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেছে। ক্লাশ অনলাইনে হবে। সে কারণে সবাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। রোদেলাও প্লেনের টিকিট কেটে ছিল। দিগুণ দাম দিয়ে টিকিট কাটতে হয়েছিল, কিন্তু এখন সে আসবে সড়কপথে।

প্লেনে আসলে চার-পাঁচ ঘণ্টায়ই সে পৌঁছে যেত সাসকাতুন। কিন্তু করোনা নামের ভাইরাসটি পৃথিবী থমকে দিল। চোখে না দেখা ভাইরাসের ভয়ে কয়েক ঘণ্টার যাত্রাপথ তিন দিনে দীর্ঘায়িত হলো। আমি স্তব্দ হয়ে বসে রইলাম। কী বলব, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মেয়ে অঙ্কের হিসাব কষে বুঝিয়ে দিল দূরত্ব। ৩৪ ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালাতে হবে। আবার দিন হিসাব করলে প্রায় এক টানা দুই দিন। তবে তারা সারা দিন গাড়ি চালাবে। দুই রাত হোটেলে ঘুমাবে। এভাবে তিন দিন লাগবে আসতে।
৩০ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরা এ যেন এক ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সড়কপথে যে কেউ আসে না তা নয়। তবে এটা এড়িয়ে চলাটাই উত্তম। কারণ মহাসড়কে গাড়ি ছুটে চলে ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে। এখনো শীতকালই। বরফ শেষ হয়েও হয় না যেন। জনমানবহীন রাস্তায় দশ থেকে পনেরো মিনিট পর পর কোনো গাড়ি দেখা যায়। এসব রাস্তায় মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে না। কোনো কারণে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলেও এক থেকে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে উদ্ধার হতে। আর কোনোভাবে এক্সিডেন্ট হলে তো বেঁচে থাকার আশাও কম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভৌতিক জনমানবশূন্য প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসা যেন এক দুর্গম যাত্রা।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমার মেয়ে ফোন দিল। মা আমি গাড়িতে উঠছি।

অটোয়ায় পার্লামেন্টের সামনে কার্লটন ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষার্থী রোদেলা অরণ্য। ছবি: লেখক
অটোয়ায় পার্লামেন্টের সামনে কার্লটন ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষার্থী রোদেলা অরণ্য। ছবি: লেখক

ভয়ে কণ্ঠ স্তব্দ হয়ে গেল। তখন ভোর পাঁচটা বাজে। ভোরের আলোরা তখনো লুকিয়ে আছে অন্ধকারের পেটে। নিকষ কালো অন্ধকার যেন কালো দৈত্যর মতো এসে আমার গলা চেপে ধরেছে।
কাপা গলায় আমি বললাম, সাবধানে আসো মা।
সে হাসলো, ভয় পেয়ো না। রাতে হোটেলে থাকব।
ভালো হোটেলে থেক। টাকার জন্য ভাববে না। সবচেয়ে ভালো হোটেলে থাকবে। যারা ভালো করে হোটেল স্যানিটাইজ করে। ঠিকমতো খাবে রাস্তায়।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। মেয়ে ফোন রেখে দেয় তাড়াহুড়ো করে।
আমি বসে রইলাম বিছানায় কুঁজো হয়ে। ঘুম আর আসবে না মেয়ের নিরাপত্তার চিন্তা করে। ঘরে আলো নেই। নিকষ কালো অন্ধকারে আবারও মৃত্যুর ভয়াবহতা টের পেলাম। মনে হলো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে যেন পৃথিবীতে। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধের বীভৎস গতিপ্রকৃতি বুঝতেই গলদঘর্ম হচ্ছে পৃথিবীর মানুষেরা। এই যুদ্ধের জয়-পরাজয় এখন সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা আছে কি না আমাদের সাধারণ মানুষের জানা নেই। এক অনিশ্চিত ভয়াবহতা, অন্ধকার আমাদের জীবনের সব স্বাভাবিক সুখ আর সোন্দর্য কেড়ে নিয়েছে। ভয়ানক বিভীষিকাময় করোনাভাইরাস জীবনের সব আনন্দ নিংড়ে নিংড়ে শেষ করে দিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মেয়ে ফিরে আসছে চেনা শহরে। ২ হাজার ৯২৭ কিলোমিটার যাত্রাপথে আমি আমার একমাত্র সন্তানকে সঁপে দিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকলাম। জানি না কতক্ষণ, কত দিন, কত বছর এমনি করে নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে হবে। মেয়ের জীবনের নিরাপত্তা, অনিশ্চিত যাত্রা—সবকিছু মিলিয়ে বুকের ভেতর তোলপাড় করা ভয়। আবার কখন এই পৃথিবীর মানুষেরা পূবের সূর্যের সোনালি আলোয় আশা জাগানিয়া পাখির গান শুনবে প্রাণ খুলে, ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরবে, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবে, কবিতা লিখবে আশাময় দিনের। চলবে...