সন্তান ৪
ওই রঙিন কাগজের প্যাকেট নিয়ে যেন উৎসব শুরু হয়েছে জিনাত ফাতেমার বাড়িতে। ‘কী আছে রে ইডার মদ্দি?’ অবাক প্রশ্ন আমেনা বেগমের।
‘ইডা তুরা পালি কই?’ অবাক হয়েছেন শরিফাও। মা–বাবা দুজনও হতভম্ব!
নিজের প্যাকেটটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল জিনাত, ‘আপনেই খোলেন, আম্মা।’
প্যাকেট থেকে অপূর্ব সুন্দর একটা শাড়ি বের হলো। সাদা জমিনে ছোট্ট ছোট্ট কালো সুতোর গোলাপ ফুল তোলা। বোঝাই যাচ্ছে, কোনো অভিজ্ঞ তাঁতি পরম যত্নে বুনেছেন সেটাকে। সঙ্গে আবার রং মেলানো ডজন দুই কাচের চুড়িও আছে, আর আছে একটা লাল ফ্রক, যেটা নিয়ে আনন্দে নাচছে খুকু।
শাড়িটা জিনাতের গায়ে ফেলে খানিকক্ষণ কোনো কথাই বের হয়নি আমেনা বেগমের মুখ দিয়ে। শেষতক মুখ খুললেন তিনি, ‘ওরে, সুবহান আল্লা!’
ফাতেমার প্যাকেটেও একই রকম শাড়ি-চুড়ি। তবে সাদা–কালোর বদলে হালকা গোলাপির ওপর লাল সুতোর গোলাপ।
‘এ তো বাজারে কিনতি গেলি মেলা দাম হবি রে!’ ফাতেমার শাড়িটা হাতে নিয়ে বলেন জামাল উদ্দিন।
‘এ, তুরা কলি না কিডা দিল?’ আনোয়ার মিয়া প্রশ্ন করেন ফাতেমাকে।
একে একে সব ঘটনা বর্ণনা করল ফাতেমা, ‘কাহা, হেড স্যারে আলেন, দিলেন আর হারায়ে গেলেন! তারে আমরা কিসু কবারই পারলাম না!’
‘আল্লা মানুষডার ভালো করেন...আমিন!’ ছোট্ট মোনাজাত সেরে নিলেন শরিফা বানু।
‘স্যারে রে দেইখে এক্কেরে তব্দা খায়া গেছিল আব্বাস মেম্বার!’ হাসতে হাসতে বলে জিনাত।
‘আব্বা, তয়, মেম্বার করিম ভাই ডিরে বেজন্মা কইল ক্যা?’ ফাতেমার প্রশ্ন।
‘আর হেড স্যারে আরও লেহাপড়া করতি কইছেন আমাগে।’ শাড়ি দুটো ভাঁজ করে রাখতে রাখতে বলে জিনাত।
‘হে গো আম্মারা, তুরা অনেক বড় পাস দিবি। আমরা তো কেবল নিজির নামটুক লিখতি পারি, তোগে আমরা পড়াবানি, তুরা আমাগে মতো হইস না।’ একসঙ্গে দুই বাবার সম্মতি।
‘আর করিম? ওরে বেজন্মা কেবল ওই মেম্বার হারামজাদাই কয়...আর সেলিমডা ও হইছে বাপের মতন!’ কথা শেষ করতে পারলেন না শরিফা বানু, স্ত্রীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জামাল উদ্দিন বললেন, ‘আবদুল করিম এই গেরামের পোলা, ওর মেলাডি আব্বা আম্মা আছে এই গেরামে।’
হাসি ফোটে শরিফার মুখে, ‘হে রে ফাতু, তোর আব্বায় এক্কেরে ঠিক কইছেন।’
সে রাতে মেয়েদের জন্য মুলা রাঁধলেন দুই মা মিলে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় দুই বাড়ি মিলেই এই দুই পরিবারের বাস। নিজের বাড়িতে তালা মেরে এসেছেন জামাল উদ্দিন, সবাই মিলে আনোয়ার মিয়ার বাড়িতে থাকবেন আজ।
নতুন ফ্রক পেয়ে কিছুতেই সেটা খুলতে চাইছিল না খুকু। জিনাত একটু আগে ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে জামাটা পাল্টে দিয়েছে, ‘বু নতুন দামা আনি ডে ছে...’ হাসিতে ভরে গেছে খুকু।
‘না রে বুন, বু দেয় নাই, স্যারে দেছেন।’ শুধরে দেয় জিনাত।
শুনেই খুকুর আবদার, ‘স্যার বালও, স্যার যামু।’
জিনাত চুমু খায় বোনের কপালে, ‘হে, আমরা সবাই স্যার যামু, তয় পরে।’
আমেনা একটা আলাদা বাটিতে কিছুটা মুরগির মাংস তুলে রাখলেন। ‘তুরা দুইডা যাইয়ে কাইল করিমেরে দিয়া আবি এই সালুন।’ দুই মেয়েকে বলেন আমেনা।
আবার প্রশ্ন করল ফাতেমা, ‘আব্বাস মেম্বার করিম ভাইডি রে গাইল পাড়ল ক্যা?’
আমেনা বেগম ফিরে গেলেন প্রায় ১০ বছর আগে, ‘জিনাত তহন এক্কেরে কুট্টি। জিনাতেরে শরিফা ভাবির কাছে দিয়া আমি আর ওর আব্বায় ঘাটে গেছি মেলাডি কাপড় নিয়া। কাচা কাপড় ভাসাইতে গিয়া দেহি কচুরিপানার আড়ে কি জানি লড়ে...’ নিজের ভাতের থালায় শুকনা মরিচ ডলে নিলেন আমেনা।
‘জিনাতের মায়ে চিক্কুর দিয়া ডাকল আমারে। পানা সরায় দেহি কুটি এক পোলা, জিনাতের তে বড়ই। তয় বেহুঁশ, আজরাইলে নেয় নাই।’ একটু থামলেন আনোয়ার। কাপড়চোপড় ফালায়া বাড়ি আলাম পোলাডারে কোলে কইরে।’
জামাল উদ্দিন যোগ দিলেন কথায়, ‘পোলাডারে দেইখে তব্দা খাইছিলাম পরথম এ টু, তয় মানুষ তো, না? ভাবছিলাম হুঁশ আলি বাপ–মায়েরে ফিরায় দিবানি।’
খাওয়া শেষে এঁটো বাসন তুলছেন শরিফা, ‘মেলা দুয়া দুরুদ, মেলা কিছু কইরে উডার হুঁশ তো ফিরল, তয় ও দেহি নিজির নাম আবদুল করিম ছাড়া আর কিছুই কবার পারে না, তো ই ডা রে আর কী করুম?’
আমেনা এক খিলি করে পান ধরিয়ে দিলেন আনোয়ার, জামাল আর শরিফাকে। জিনাতের কাঁধে মাথা রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন খুকু।
‘করিমরে তাই আমরা গেরামের সবাই মিলে পালছি। উডা ওই নদীর পানিতি ভাইসে আইছিল তাই মেম্বার হারামজাদায় বেজন্মা কয় ওরে। ওই দোকানডাও সবাই মিলে তুইলে দিছে। মেম্বারে মানা করছিল তয় সবার সামনে করিমরে আর কিছু কয় নাই। সবাই মিলে একজোট হোলি ওই হারামজাদায় আর কি করবার পারে? যত টাকা থাক।’ স্নিগ্ধ হাসি আমেনার ঠোঁটে।
ঘুমন্ত খুকুর পিঠ থাপড়ে জিনাত বলে, ‘তালি করিম তো ভাইডিই, আমাগে বাপ–মাই ওর বাপ–মা।’
‘হে, এক্কেরে ঠিক কথা।’ সায় দেয় ফাতেমাও।
* মিনহাজ হোসেন কেন এত সুন্দর উপহার দিলেন দুই বান্ধবীকে? আব্বাস আলী বা নাজমুলের মনেই বা কী চলছে? জানবেন পরের পর্বে। চলবে...
আরও পড়ুন
সন্তান ৩