অনলাইনে উচ্চশিক্ষা ও রাষ্ট্রের দায়

৩০ এপ্রিল বিকেলে এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের মাধ্যমে করোনা সংকটে দীর্ঘদিনের ছুটি পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে এক নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অনলাইনে ক্লাস, সেমিস্টার ফাইনাল, অন্যান্য পরীক্ষা এবং ভর্তি কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) যে নির্দেশনা প্রণয়নের কথা ছিল, তা ৭ মে প্রণীত হয়েছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও ৩ মে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিষয়টি সময়ের দাবিও বটে।

এক. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপার কিংবা ইন্টার্ন রিপোর্টের কাজ প্রদান করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার আবহের মধ্যে রাখতে পারলে সেটিও অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত হতো। কেননা দীর্ঘ সময় উচ্চশিক্ষার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার ফল কোনোভাবেই ভালো হতে পারে না। প্রণীত নির্দেশনা অনেকাংশেই শিক্ষার্থীবান্ধব এবং ইতিবাচক। কাজেই যেসব শিক্ষার্থী না বুঝেই অনলাইনভিত্তিক উচ্চশিক্ষার বিরোধিতা করছেন, তাঁদের জন্য এ নির্দেশনা বেশ উপযোগী হবে।

দুই. যেকোনো নতুন বিষয় মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের মধ্যে নেই। যেহেতু করোনা সংকটে পৃথিবী সুদূর অতীতে কখনো পড়েনি, কাজেই শুধু করোনার কারণে আগামী পৃথিবীকে অনেক নতুন রীতি-নীতিকে মেনে নিতে হবে, যা অতীতে কখনো ছিল না। চীনের যে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আমি পড়ি, সেটি বর্তমান কিউএস র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্বে ৫৪তম, এশিয়ার মধ্যে ৬ষ্ঠ এবং যেকোনো র‌্যাঙ্কিংয়ে চীনের মধ্যে তৃতীয়। এ পর্যন্ত যত ক্লাসে আমি অংশগ্রহণ করেছি, প্রায় সব ক্লাসে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল তাৎপর্যসংখ্যক। একটি ছোট পরিসরের ক্লাসে হিসাব করে দেখেছি, মোট ২১ জন শিক্ষার্থী ছিলাম ১৮টি দেশের। আমার যত দূর মনে পড়ে, শুধু চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজের ক্লাসগুলোতে সরাসরি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়া বাকি সবগুলোতে আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীরা কোনো একটি বিশ্লেষণধর্মী বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপার কিংবা ইন্টার্ন রিপোর্ট জমা দিতাম এবং সেটির একটি কপি অনলাইনে (মেইল/আপলোড) এবং অন্য একটি হার্ড কপি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের ডেস্ক কিংবা বিভাগ বা অনুষদের অফিসে জমা দিতাম। সেটির ওপর ভিত্তি করেই শিক্ষকেরা আমাদের মূল্যায়ন করতেন। চীনে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা যখন দিল, তখন শীতের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই শিক্ষার্থীদের কমন ই-মেইলে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালু রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জানিয়ে দেয়। সেভাবেই এখনো সবকিছু চলছে। বিষয়টি অনলাইনে শিক্ষক বোঝাতে পেরেছেন কি না এবং শিক্ষার্থী বুঝতে পেরেছেন কি না, সেটিই করোনাকালে বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। তবে যে বিষয়টি অতীতে ছিল না, সম্পূর্ণ নতুনভাবে শুরু করতে হবে, তা নিয়ে অবশ্যই অনেকবার ভাবার অবকাশ রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাবতে হবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে কিছু করতে যাচ্ছি, কোনো কোচিং সেন্টার বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়।

তিন. ইউজিসি প্রণীত নির্দেশনায় অনলাইন ক্লাসে ৬০ শতাংশ উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। বাকি শিক্ষার্থীদের যত দূর সম্ভব নিজ নিজ বিভাগ থেকে বিশেষ উপায়ে শিক্ষার আবহের মধ্যে রাখার যৌক্তিক কৌশল নির্ধারণ করাও জরুরি। এ ছাড়া অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের ভূমিকা ও কার্যকারিতাসংক্রান্ত জরিপের (সম্ভাব্যতা যাচাই) জন্য যে প্রশ্নপত্র আপলোড করা হয়েছে, তা সব অনুষদের শিক্ষকদের জন্য আরও বেশি সহজবোধ্য করার সুযোগ ছিল। কেননা অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা অনলাইনভিত্তিক ক্লাস, কোর্স ম্যাটেরিয়ালস তৈরি এবং আপলোডের মতো বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত নন। কাজেই তাঁদের ছোট পরিসরে প্রশিক্ষণের মতো জরুরি বিষয়ের সংযোজন থাকার জন্য অনলাইন কার্যক্রমে বিশেষজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ নন, এমন শিক্ষকদের সমন্বয়ে নিজ নিজ অনুষদে কার্যকর কমিটি তৈরি করার আবশ্যকতা থাকা দরকার।

চার. আরও বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নেওয়া দরকার, যেমন: (১) অল্প কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তাৎপর্যসংখ্যক শিক্ষার্থী খণ্ডকালীন চাকরি ও টিউশন করে নিজের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করেন। তা ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী গ্রাম ও মফস্বলের হওয়ায় তাঁদের পক্ষে করোনাকালে ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্ত থাকা সব সময় সম্ভব হবে না। (২) বাংলাদেশে ইন্টারনেট প্যাকেজ অনেক দামি। শিক্ষার্থীরা অধিক মূল্যে ইন্টারনেট কিনতে পারবেন কি না, যদিও অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়। তবে, সেটি সব সময় না থাকলেও তাঁদের হয় এবং তাতে অল্প ইন্টারনেট ডেটা লাগে। তবে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজনে আগের তুলনায় বেশি সময় ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে মোবাইল কোম্পানিগুলো ‘শিক্ষার্থী প্যাকেজ’ নামে ইন্টারনেট সহজলভ্য করবে কি না, সেটি ভেবে দেখতে হবে। (৩) সব এলাকায় ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক ভালোভাবে কাজও করে না। আবার করলেও খুব ধীরগতির। এমন অবস্থা হলে শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কাইপে, জুম, ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার করে ভিডিও ক্লাসে অংশগ্রহণ করবেন, সেটি একটি বিবেচ্য বিষয়। (৪) ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার জন্য ঘর থেকে বের হলে লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা সম্ভব হবে না। (৫) বিষয়টি নতুন হওয়ায় কীভাবে অধিক শিক্ষার্থী বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে পারবেন, সেটি ভাবতে হবে। (৬) মুষ্টিমেয় কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়, যেখানে সব মিলিয়ে হাজার হাজার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী চাকরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন পরিচালনা না করা গেলে কাউকে বেতন-ভাতা দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনায় (যদি সরকার সদয় হয়ে দেয়) কিছুদিন হয়তো চলবে। তবে শিক্ষার পরিবেশ চালু রাখা না গেলে কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেতন বা সম্মানী দিতে পারবে না। তাই কোনো কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুত হবেন হাজার হাজার চাকরিজীবী। (৭) বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকরিচ্যুতির মতো অমানবিক সিদ্ধান্তে কখনো যেতে চাইবে না বলেই তাদের সরকারি প্রণোদনা প্রাপ্তির পাশাপাশি উভয় পক্ষের জন্য ভালো, এমনভাবে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। (৮) কতজন শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় থাকতে পারবেন তার একটি সার্ভে রিপোর্ট প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকতে হবে, যা তারা ইউজিসিকে সরবরাহ করবে। (৯) প্রথম অবস্থায় অন্তত একটি সেমিস্টারের বিষয়ে ভাবতে হবে। (১০) টিউশন ফি আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ না করে যাঁরা দিতে পারবেন এবং যাঁরা দিতে পারবেন না, তাঁদের উভয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে। (১১) করোনাকালে কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন চাকরিচ্যুত না হন, সে ব্যাপারে ইউজিসিকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। (১২) শুধু আর্থিক কারণে যেন কোনো শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত না হন, ব্যাপারটি ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিশ্চিত করার মানবিক দায় নিতে হবে।

কোনোভাবেই শিক্ষার্থী এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও আর্থিক ক্ষতির মধ্যে যেন না পড়ে, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রকে বিবেচনা করতে হবে। পর্যাপ্ত অর্থের সংকুলান না থাকায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেতন দিতে পারছে না। দিলেও মূল বেতনের অর্ধেক দিতে পারছে, যা দিয়ে ঘর ভাড়া ও পরিবারের ভরণপোষণ মেটানো একেবারেই দুঃসাধ্য। তাঁরা না পারছেন সহায়তার জন্য হাত পাততে, না পারছেন সংসার চালাতে। জীবনের এই কঠিন দুঃসময়ে সরকারকে বিশেষ সহজ ও সহনীয় শর্তসাপেক্ষ বা শর্তহীন অনুদান ও প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে সবার পাশে দ্রুত দাঁড়ানোর এখনই সময়। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ক্ষতির মধ্যে একবার পড়ে যায়, তাহলে তার ফল উচ্চশিক্ষার এই খাতকে ধ্বংস করে দেবে এবং পরবর্তী সময়ে দেউলিয়াত্বের কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কখনো সম্ভব হবে না।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ