করোনায় নিউইয়র্কের দিনগুলো

এই তো ফেব্রুয়ারি মাসেও এখানে সব ঠিকঠাক ছিল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে নাশতা করে বাস ধরে লাইব্রেরি যাওয়া, কফির কাপে হালকা চুমুক দিয়ে ল্যাপটপ অন করে নিজের কাজ গুছিয়ে নেওয়া, দুপুরে ভূরিভোজের পর হালকা ঝিমিয়ে নেওয়া, বিকেল পাঁচটার বাস ধরে বাড়ি ফেরা আর রাতে ডিনারের পর স্বামীর সঙ্গে নাটক দেখা।

দৈনন্দিন জীবনে এমন নিয়মনীতিগুলো আচমকা থমকে গেল অতিকায় ক্ষুদ্র করোনাভাইরাসের অনাকাঙ্ক্ষিত আবির্ভাবে। খালি চোখে দৃশ্যমান না হলেও এর প্রভাবে আজ স্তব্ধ হয়ে আছে সারা বিশ্ব। গতিময় জীবনে কেমন যেন এক গম্ভীর ভাব চলে এসেছে। নেই কোনো বাস ধরার তাড়া, নেই আগের সেই প্রাণচাঞ্চল্য। তারপরও এই দূর প্রবাসে আমরা একজন আরেকজনকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্তে, নিজেদের একটুখানি ভালো রাখার জন্য।

আমার স্বামী নিউইয়র্কের একটি ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সের ওপর পিএইচডি করছেন। যদিও করোনার প্রাদুর্ভাবে ইউনিভার্সিটি বন্ধ, তবু তাঁর প্রতিদিনের কাজ কিন্তু থেমে নেই। আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে ঘরে বসে অনলাইনেই সেরে নিচ্ছেন জরুরি মিটিং। এমনকি সব ডেডলাইন ও মিট করতে হচ্ছে সময়মতো। করোনার এই ক্রান্তিকালে জীবনযাত্রার স্বাভাবিক গতি ধরে রাখার জন্য আমরা দুজনেই আগের নিয়মে সকালে ঘুম থেকে উঠছি। সারা দিনের কাজ গুছিয়ে বিকেলে একসঙ্গে বসে চায়ের কাপে ফুঁ দিচ্ছি। কাজের চাপ একটু কম থাকলেই নিজেদের পছন্দের রেসিপি ট্রাই করছি অথবা প্রিয় অভিনেতার সিনেমা দেখছি। আর সবকিছুর ফাঁকে কিছুটা সময় বের করে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। জীবনের এই কঠিন সময়েও হাল ছেড়ে দিইনি। সব সময় চেষ্টা করছি একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে, একে অপরের পাশে থাকতে। এই দুর্যোগের সময়েও নিজেদের মনোবল শক্ত রেখে আশায় বুক বেঁধে আছি।

আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। হয়তো কোনো এক আলো ঝলমলে সকালে আশার সূর্য হাতছানি দিয়ে ডাকবে। ভোরের আলো মুছে দেবে সব কলুষতা। জরাজীর্ণতা কেটে পৃথিবীতে বিরাজমান হবে কেবল শুদ্ধি। সেদিন অবশ্যই পড়ন্ত বিকেলের লাল আলোয় চার চাকার বাহনে চেপে হারিয়ে যাব কোনো এক অজানা গন্তব্যে। কিংবা সন্ধে নামার আগেই হাতে হাত রেখে দুজন মিলে বেরিয়ে পড়ব প্রিয় কোনো সিনেমা দেখতে। অথবা কোনো একদিন নাড়ির টানে উড়োজাহাজের পাখায় চড়ে সাড়ে তেরো হাজার মাইল পাড়ি দেব মা ও মাটির উদ্দেশে। মাকে জড়িয়ে ধরে বলব, কতটা ভালোবাসি। বাবার কাছে হরেক রকমের আবদার করব। ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠব। সোঁদা মাটির গন্ধ নেব। ফিরে যাব আবার সেই সোনালি শৈশবে। তত দিন পর্যন্ত আমাদের স্বপ্নের পৃথিবীর অপেক্ষায়।

পৃথিবী আবার সুস্থ হয়ে উঠুক। জীবনের হারানো গতি ফিরে আসুক।