সাকুরা ঝরে পড়ছে নিভৃতে

সাকুরা ফুল। ছবি: লেখক
সাকুরা ফুল। ছবি: লেখক

জাপান, হাজার বছরের পুরোনো বহুমুখী সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করা এক দেশ। জাপানিজ সমাজ তার নিজস্ব ভাবধারা, কৃষ্টি-সংস্কৃতির মূলকে আগলে রেখে ক্রমাগত চলমান প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে হাল ফ্যাশনের শৈলীগুলো পরিবর্তন করে চলেছে। তারা বিদেশি সংস্কৃতির কাছে নিজের সংস্কৃতিকে কখনোই বিকিয়ে দেয়নি। 

জাপানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও যেন এদের আচার-আচরণে ফুটে উঠেছে, যেমন উদার তেমনি আকর্ষণীয়। সাকুরা বা চেরি ফুল বসন্তকালে জাপানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে এক ভিন্ন রূপে সাজিয়ে তোলে। সাকুরা ফুল জাপানিদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ফুল, যাকে দেখার তৃষ্ণা তারা আমৃত্যু লালন করে। হাজার বছর ধরে আবালবৃদ্ধবনিতা এই প্রেমের মালা গেঁথে চলেছেন।


সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাকুরা ফুলের আকর্ষণ বিন্দু মাত্র কমেনি বরং হাজার গুণ বেড়েছে। শিল্পীর ক্যানভাস থেকে শুরু করে রমণীর পোশাক, খাবারদাবার, খেলনার সামগ্রী—সবকিছুতেই যেন সাকুরার রোমাঞ্চকর উপস্থিতি।


শুধু জাপানের মানুষ নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীন ছাড়াও সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা থেকে ফুল ফোটার এই সময়টাতে হাজারো সাকুরাপ্রেমী এসে ভিড় করে একটু প্রশান্তির আশায়। গত বছরের একটি সহজ সমীকরণই এর পক্ষে যথেষ্ট। কানসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাপানের ভেতরের এবং বহির্বিশ্ব মিলিয়ে মোট ৬৩ মিলিয়ন মানুষ সাকুরা ফুল ফোটার সময়টায় এ দেশের আনাচকানাচে ভ্রমণ করে থাকে। ভ্রমণের এই সময়টায় পর্যটকদের যাতায়াত, হোটেলে থাকা–খাওয়া ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রায় ২.৭ বিলিয়ন ডলার, যা জাপানিজ টাকায় ৩০১ বিলিয়ন ইয়েন ব্যয় হয়, যা জাপানের পর্যটন খাতের সবচেয়ে বড় উৎসের একটি। ২০২০ সালের সাকুরা ফুল ফোটার সময়টায় জাপান সরকার ৪০ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক আশা করেছিল। যদিও করোনা মহমারির কারণে তার সবকিছুই ভেস্তে যায়।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে সাকুরা ফুল একদিকে যেমন কোটি মানুষের মনের তৃপ্তি দিচ্ছে, তেমনি জাপানের অর্থনীতিকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। সাকুরা ফুল ফোটার সময়টায় পুরো জাপানে দেখা যায় এক অন্য রকম আমেজ। কেউ যেন এর সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হতে নারাজ। এই সৌন্দর্যের সাক্ষী হতে হাজার হাজার মানুষ তাদের পরিবার–পরিজন নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন সাকুরা পার্কে ভিড় করেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিভিএম এ ভর্তি হওয়ার পর থেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য জাপানের প্রতি আমার আগ্রহটা জন্মায়। ২০১৩ সালে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হওয়ার মধ্য দিয়ে তা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে জাপানের গিফু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে ভর্তি হই। সাকুরা ফুল নিয়ে ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় জাপান ফেরত সহকর্মীদের কাছ থেকে অনেক গল্প ও অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। ওনাদের কথায় অনেক সময় মনে হতো এটা কি করে সম্ভব? একটা ফুলের কী এমন মাহাত্ম্য আছে, যা দেখার জন্য সবাই এতো পাগল হয়ে ওঠে। এখানে আসার ছয় মাস পরই ছিল সাকুরা ফুল ফোটার সময়। সাকুরা ফুলের সৌন্দর্যই যেন আমাকে সবকিছু খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিল কেন সে এক ও অদ্বিতীয়।

সাকুরা ফুলে পাশে লেখকের ছেলে। ছবি: লেখক
সাকুরা ফুলে পাশে লেখকের ছেলে। ছবি: লেখক

সাকুরা জাপানের জাতীয় ফুল, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো চেরি ফুল। সাকুরার অনেক প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে Prunus serrulata বৈজ্ঞানিক নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাপানে প্রায় ২০০ প্রজাতির সাকুরা ফুল রয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগই সাধারণত সাদা বা গোলাপি কিংবা লাল রঙের হয়ে থাকে। জাপান ছাড়াও পৃথিবীর আরও অনেক দেশে এই রকম ফুল দেখতে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকভাবে জাপানের নানা সময় (৭১০-৭৯৪) থেকে সাকুরাবন্দনা শুরু হয়ে, আজও চলমান। কথিত আছে, আনুমানিক ১৭২০ সালে তকুগায়া ইয়োশিমুনে নামের একজন নাগরিক আসুকায়ামা পার্কে প্রস্ফুটিত সাকুরাগাছের নিচে জাপানিজ মদ সাকে পান করার মাধ্যমে বিখ্যাত ‘হানামি’ উৎসবের প্রচলন শুরু করেন। শীতের আড়মোড়া ভেঙে বসন্তে নতুন দিনের সূচনা হয় এই ঝলমলে ফুল ফোটার মাধ্যমে। বাচ্চাদের নার্সারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, বাসা-বাড়ি থেকে অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, পাহার-বন-জঙ্গল—সবকিছুই যেন সাকুরাময় হয়ে ওঠে।


গিফু বিশ্ববিদ্যালয় পাহাড়ের ঠিক কোল ঘেঁষে। এখানে সারা বছরই এক নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় থাকে। জাপানের সব কটি ঋতুর বহিঃপ্রকাশ এখানে সুস্পষ্ট। শীতকালে যৌবন হারানো গাছগুলো বসন্তে আবার ফুলে-ফলে বিকশিত হয়। গ্রীষ্মের সময় চারদিকে তাকালে শুধু সবুজের সমারোহই চোখে পড়ে, যা শরতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পাতার রং পাল্টে গাঢ় লাল রং ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে বাম আর ডান দিকের রাস্তাটি এর চারপাশ বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করেছে, যা দৈর্ঘ্যের হিসাবে দুই কিমির একটু বেশি। এই রাস্তাটির দুই পাশজুড়েই রয়েছে বাহারি গাছপালা, যার বেশির ভাগই সাকুরা গাছ। মূল ফটকের বাঁ পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি মেডিসিন অনুষদের দিকে চলে গেছে, এর সম্পূর্ণ অংশটিই সাকুরাগাছ দিয়ে পরিপূর্ণ।

সাকুরা ফুল ফোটার সময়টায় পুরো জাপানে দেখা যায় এক অন্য রকম আমেজ। ছবি: লেখক
সাকুরা ফুল ফোটার সময়টায় পুরো জাপানে দেখা যায় এক অন্য রকম আমেজ। ছবি: লেখক

২০ মার্চ জাপানে বসন্ত ঋতু শুরু হয়। সাকুরা গাছগুলোও যেন শীতের আড়মোড়া কাটিয়ে ওঠে নবযৌবনা কিশোরীর মতো নিজেকে মেলে ধরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। উষ্ণ আবহাওয়ার ফুল হওয়াতে তার পরিপূর্ণ প্রস্ফুটিত হওয়াটা তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অঞ্চলভেদে এই ফুল ফোটার সময়কাল একটু ভিন্ন হয়। গিফু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ফুল ফোটা শুরু হয়ে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গিয়ে পরিপূর্ণতা পায়, যা সপ্তাহকাল স্থায়ী হয়। চোখের পলকে কয়েক দিনের মধ্যেই পাতাবিহীন গাছজুড়ে শুধু জাদুকরি সাদা/গোলাপি/লাল রঙয়ের ফুল আর ফুল। অনিন্দ্য দৃষ্টিনন্দন এই রূপ।


বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দকৃত আবাসিক এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আছি। গত বছর সাকুরা ফোটার সময়টায় আমরা তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের রাস্তায় কত যে হেঁটেছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। যতই দেখেছি দুচোখ আটকে যেত তার সৌন্দর্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দেশি ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই বিদেশি ছাত্রছাত্রীরাও দৃষ্টিনন্দন পোশাক পরে ক্যাম্পাসে সাকুরা ফুলের শোভা উপভোগ করে। সাকুরাগাছের সামনে দল বেঁধে ছবি তোলা, গাছের নিচে বসে গান, আড্ডা—সবই চলে সমান্তরালে। ক্যাম্পাসে এই সময়টাতে নানান রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে, যার প্রতিটাতেই ছাত্রছাত্রীদের অবাধ উল্লাস প্রকাশ পায়। আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষজন পরিবার নিয়ে এই সময়টাতে এখানে এসে ভিড় জমায় সাকুরার বাহারি রূপ দেখার জন্য। কিন্তু হঠাৎই যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় মুখর একটা ক্যাম্পাস মুহূর্তের মধ্যেই যেন সুনসান নীরবতায় পরিণত হলো। তুলনামূলকভাবে জাপানে করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো এতটা ভয়ানক না হলেও সংক্রমণের শঙ্কা সব সময় ছিল।

শুধু জাপানের মানুষ নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীন ছাড়াও সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা থেকে ফুল ফোটার এই সময়টাতে হাজারো সাকুরাপ্রেমীরা এসে ভিড় করে একটু প্রশান্তির আশায়। ছবি: লেখক
শুধু জাপানের মানুষ নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীন ছাড়াও সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা থেকে ফুল ফোটার এই সময়টাতে হাজারো সাকুরাপ্রেমীরা এসে ভিড় করে একটু প্রশান্তির আশায়। ছবি: লেখক

গিফু শহরের অবস্থা মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধে যথেষ্ট ভালো অবস্থায় ছিল। কিন্তু জাপানের অন্য বড় শহরেরে মতো গিফুতেও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনার পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন হলো যে করোনা এসে নিজের ক্যাম্পাসেই হানা দিয়ে বসল। ৩ এপ্রিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন। এক অজানা আতঙ্ক এসে ভর করল মাথার মধ্যে। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে থেকে কেউ ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না অথবা ভেতর থেকে বাইরে যেতে পারবে না। প্রফেসর ই–মেইল করে জানিয়ে দিলেন অনার্স-মাস্টার্স সবার জন্যই ক্যাম্পাস বন্ধ শুধু পিএইচডি গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার ব্যপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। দুই দিনের মধ্যেই ইতিবাচক নির্দেশনা পেয়ে যাই। তবে ক্যাম্পাসের ভবনে প্রবেশে মানতে হবে খুবই কঠিন আইন সঙ্গে সুরক্ষাব্যবস্থা। যদিও ল্যাবে আমরা সব সময় ল্যাবকোট, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লোভস পরেই কাজ করি সঙ্গে হ্যান্ড সেনিটাইজার তো আছেই। ই–মেইল পাওয়ার পর থেকে পরিবার নিয়ে পড়েছি মহা চিন্তায়। আমাকে যেহেতু বাহিরে বের হতে হবে, সুতরাং করোনার সংক্রমণ আমার মাধ্যমেই ছড়াতে পারে আমার স্ত্রী-সন্তানের মধ্যে। লকডাউনের পর প্রথম দিন ক্যাম্পাসের অবস্থা দেখে আমার মনে হলো আমি কি ঠিক জায়গায় আছি। কোথাও কেউ নেই। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক–কর্মকর্তা পদচারণে যে ক্যাম্পাস মুখর থাকত, তা যেন আজ মৃত্যুপুরীর মতো। ক্যাম্পাসের আনাচ–কানাচে তখন শুধু সাকুরা ফুল। মানসিক চাপ কমানোর জন্য একদিন ল্যাবের কাজ শেষ করে মনে হলো গাড়ি দিয়ে একটা চক্কর দেওয়া যাক পুরো ক্যাম্পাস। সারি সারি সাকুরাগাছ বাহারি ফুল নিয়ে সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আফসোস দেখার কেউ নেই। এ যেন অন্ধকার রাজ্যর অভিশপ্ত রাজকন্যা, দেখা যাবে না ছোঁয়াও যাবে না। আমাকে দেখে ফুলগুলো যেন হাজারটা অভিমান দেখিয়ে দখিনা হাওয়ায় ঝরে পড়তে লাগল। কয়েক দিনের মধ্যে নিমেষেই সাকুরা ফুলগুলো তার দ্যুতি ছড়িয়ে ঝরে পড়ে গেল। ক্যাম্পাসে নিভৃতে ঝরে গিয়ে যেন বুঝিয়ে দিল আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনের কথা। পার্কে বসে সাকুরা ফুলের মনমাতানো শোভা দেখার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় আমার মতো কোটি কোটি জাপানির হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হয়েছে। জানি না পরেরবার প্রকৃতি কীভাবে এই মনের তৃষ্ণা মেটাবে?


প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা করি, যেন সবকিছু আগের মতো করে দেন। আবার হাসি–আনন্দে ভরে উঠবে ক্যাম্পাস, সদ্য ফোটা সাকুরা ফুল নিয়ে হবে হাজারো উৎসব। জাপানের স্বনামধন্য কবি মাতসুও বাশোর লিখেছেন, মানুষের দুই জীবনের মাঝখানের জীবনটাই হচ্ছে সাকুরা ফোটার সময়। কবির সুরে সুর মিলিয়ে আরেকবার সাকুরা ফোটার অপেক্ষায় রইলাম...। সাকুরা, তোমারই অপেক্ষায় রইলাম...।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]