স্পেনে অবৈধ অভিবাসী বৈধতা নিয়ে আলোচনা, জুনে আসতে পারে ঘোষণা

করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্ব বিরাট অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কার সমক্ষে আছে। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নেই ইউরোপীয় উন্নত দেশগুলো। সেই সংকট মোকাবিলায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ অনেক রকম প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি, বিশেষ করে অবৈধভাবে বসবাসকারীরা আছেন চরম বিপাকে। তাদের কথা মাথায় রেখেই ইতালি ও পর্তুগাল তাদের অভিবাসী নাগরিক আইনে কিছুটা বিশেষ সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতা গত মঙ্গলবার (১৯ মে) স্পেনের সংসদ অধিবেশনে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতাকরণে একটি প্রস্তাব উঠেছে।

সিনেটর পিকরনেল গ্রেন্সনা দেশটির অভিবাসীবিষয়ক মন্ত্রীর উদ্দেশে এ প্রস্তাবটি আনেন। তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর সরকার জোর দাবি দিয়ে বলে যাচ্ছে, এই ভাইরাস আমরা সবাই একত্রে মিলে প্রতিহত করবে এবং এর থেকে কাউকে পেছনে পড়ে থাকতে দেবে না। সরকার যদি আসলেই তা মনে করে, তাহলে স্পেনে যত অবৈধ অভিবাসী আছে, তাদের সবাকেই এখন বৈধতা প্রদান করা উচিত। যদি বৈধ কাগজ না থাকে তাহলে তারা তাদের অধিকার ঠিকমতো আদায় করতে পারে না। এটা আসলে এই সময় খুবই বড় ভাবনার বিষয়, বিশেষ করে কোভিড-১৯–এর এই মহামারির সময়। যদি কাগজ না থাকে, তাহলে কাজ থাকে না, থাকে না একটা ভালো বেতন, কোনো ভালো বাসা থাকে না, না থাকে একটা মর্যাদাপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা সমাজ থেকে তাদের আলাদা করে দেয়। তাই আমাদের এদের প্রয়োজনে যা কিছু করা দরকার তা করা উচিত।’ তিনি পর্তুগাল ও ইতালির উদাহরণ টেনে দেখান যে বর্তমান এই সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই দুই দেশের সরকার তাদের দেশের অভিবাসীদের জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

জবাবে দেশটির সামাজিক নিরাপত্তা ও অভিবাসীবিষয়ক মন্ত্রী খোসে লুইস এসক্রিভা বেলমন্তে জানান, ‘পর্তুগাল বা ইতালি যা করেছে, তা কিছু শর্তাবলির ওপরে করেছে। ইউরোপীয় রিফিউজি অধ্যাদেশ ২০০৮-এ বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সাধারণভাবে অভিবাসীদের বৈধ করা যাবে না। এবং তা এখনো কেউ ভঙ্গ করেনি। তবে একটু ব্যতিক্রমীভাবে পর্তুগাল যা বের করেছে, এটা স্পেনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার কিছুই নেই, কেননা পর্তুগালে যাদের বৈধ কাগজ নেই, তারা চিকিৎসাসেবা পায় না কিন্তু স্পেনে সেটা পায়। আর যা ইতালি করছে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা ধরে রাখাতে তার দেশের কৃষিখেতে কাজ করার জন্য লোক নিচ্ছে, এটাও স্পেনের সঙ্গে যায় না, কেননা স্পেন অস্থায়ী ভিত্তিতে অবৈধ বসবাসকারী ১৮ থেকে ২১ বছরের মানুষদের জন্যও মাঠে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। এ দুটি কারণেই স্পেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ আইনের কোনো ক্যাটাগরিতে পড়ে না, তাই স্পেনের পক্ষে বিশেষ কোনো প্রস্তাবনায় এ দেশে অবৈধ জনবলকে বৈধকরণের কোনো সুযোগ নেই।

তবে মন্ত্রী সিনেটরকে পুরোপুরি আশাহত করেননি, কিংবা তাঁর প্রস্তাবটি পুরোদস্তুর উড়িয়ে দেননি। তিনি সিনেটরের প্রস্তাব গ্রহণ করে জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে এই প্রস্তাবনার আলোকে কাজ করে যাচ্ছে, এবং তাঁরা নিজেরা আরও খুঁজে দেখছেন যদি আরও কিছু করা যায়। তাঁরা কিছু সুবিধা ব্যবস্থা পেয়েছেন আর দেখছেন যদি আরও কিছু পাওয়া যায়। বিশেষত ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রের অভিবাসী সচিব এই বিষয়ে কাজ করছেন এবং দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বিষয়টির ওপর অবগত আছেন।
দেশটির বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন জানায়, স্পেনে সোশ্যালিস্ট পার্টির সরকার অভিবাসীবান্ধব সরকার হিসেবেই পরিচিত। বর্তমান সোশ্যালিস্ট পার্টির সরকারের আমলে ২০০৫ সালে অভিবাসীদের সাধারণ ক্ষমা ও সহজ শর্তে বৈধতা দেওয়া হয়।

২০১৬ সালের ২৪ জুন স্থানীয় গণমাধ্যম ‘ইউরোপা প্রেস’–এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছিলেন সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধান পেদ্রো সানচেজ। অবৈধদের বৈধভাবে দেশটিতে বসবাস করার ব্যবস্থা নেওয়ার আগ্রহের কথা বলেছিলেন তিনি।
বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা সোশ্যালিস্ট পার্টি অভিবাসননীতি নমনীয় করবে, এমনটি প্রত্যাশা করছেন স্পেনের অভিবাসীরা।

দেশটিতে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা নিবন্ধনকৃত মানবাধিকার সংগঠন ‘ভালিয়েন্তে বাংলার’ সভাপতি ফজলে এলাহি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে আমরা যে তথ্য পেয়েছি তাতে পুরো স্পেনে প্রায় ১০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি আছেন, তারা স্পেনে বসবাস করার অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। স্পেনের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে এ সরকারের কাছে আমরাও দাবি জানিয়েছি, যাতে অভিবাসীদের সহজ শর্তে বৈধতা দেওয়া হয়।’

প্রধানমন্ত্রী সানচেজ তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে কাজ করলে স্পেনে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ তৈরি রয়েছে বলে জানান ফজলে এলাহি। তিনি বলেন, আগামী জুন মাসে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ আসার সম্ভাবনা আসতে পারে।
বাংলাদেশি সমাজকর্মী ও অনুবাদক নাসিরুল ওয়াহাব অপু বলেন, ‘সরকার এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে, হয়তো অচিরেই আমরা ভালো সংবাদ পেতে পারি অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার বিষয়ে।’

অতীতে দেখা গেছে, সোশ্যালিস্ট পার্টি যখন স্পেনের রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকে, তখন অভিবাসীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধান খসে লুইস রদ্রিগেজ জাপাতেরো প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অবৈধ অভিবাসীরা সহজ শর্তে স্পেনে বসবাসের বৈধতা পেয়েছেন। বিশেষ করে ২০০৫ সালে সাধারণ ক্ষমা ও সহজ শর্তে বৈধতা পেয়েছেন কয়েক হাজার অভিবাসী।

ইতিমধ্যে মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্পেনে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, বছরের পর বছর অবৈধ অভিবাসীরা ব্যবসাসহ বিভিন্ন রকমের পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। অথচ এসব অবৈধ অধিবাসীদের বৈধতা দিলে বৈধ কাজ করে নিয়মিত সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করতে পারবে। এতে দেশটির অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।

স্পেনের অর্থনীতির মূল খাতগুলোর মধ্যে কৃষি ও পর্যটন শিল্পপ্রধান। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু থেকেই দেশটির পর্যটনশিল্পে ধস নামে। পুরো স্পেন বর্তমানে পর্যটকশূন্য অবস্থায় রয়েছে। কৃষি খাতেও ধ্বংস অবধারিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কাস্তিইয়া লা মানছা, ভ্যালেন্সিয়াসহ কয়েকটি এলাকা কৃষিকাজের জন্য প্রচুর কাজের লোকের সংকট শুরু হয়েছে।

স্পেনের অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, দেশটিতে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশিসহ অবৈধ হয়ে পড়া মোট অভিবাসীর সংখ্যা ২ লাখ। দেশটির এই দুঃসময়ে সরকারের কাছ থেকে আশার কোনো নতুন সূর্য দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন এই বিপুলসংখ্যক অভিবাসী।