করোনাকালে প্রবাস জীবন

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

একটি সুস্থ পৃথিবী হঠাৎ বদলে দিয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তৈরি হয়েছে সামাজিক দূরত্বের মাপকাঠি। প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটছে এক অদৃশ্য অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে। ইতিমধ্যে প্রিয় মাতৃভূমিতে করোনাভাইরাস আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে শুরু করেছে। এই সময়ে কেউই নিরাপদ নয়। প্রতিদিন মনে হয় এই তো আর কয়েকটা দিনের পর পৃথিবীটা আবার প্রাণ খুলে হাসবে। আবার আমরা নির্বিঘ্নে মাস্ক ছাড়া নিশ্বাস নিতে পারব। সবাই ফিরে যাবে নিজ নিজ কর্মস্থলে। সবাই মিলেমিশে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রেখে হ্যান্ডশেক আর ঈদে আবার কোলাকুলি হবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশিত দিনগুলো যেন দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে করোনার মধ্যেই রুটিরুজির টানে দেশ থেকে পাড়ি জমাই দক্ষিণ কোরিয়াতে। তখন কোরিয়াতে মাত্র ১৬ নম্বর রোগী করোনা শনাক্ত হয়েছিল। পরিস্থিতি কিছুটা থমথমে। সর্বোচ্চ সতর্কতার ওপর এখনো কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়ায় দীর্ঘ তিন মাস বাসা থেকে কোথাও যাওয়ার সহস তৈরি হয়নি। তবে ধন্যবাদ জানাতেই হয় দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু হালাল ফুডের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের। তাঁদের সহযোগিতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিত বাসায়। করোনাকালের মুহূর্তগুলো অনেকটাই আতঙ্কের মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়েছিল। আজ কিছুটা শঙ্কামুক্ত দক্ষিণ কোরিয়া। সরকার ও জনগণের সচেতনতায় করোনার লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে কোরিয়া। গত চার মাসে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১১ হাজারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে প্রতিনিয়ত দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আপডেট নিউজ দিয়ে যাচ্ছি। সফলভাবে করোনা প্রতিরোধের দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কারণ করোনার সাফল্যে কোরিয়ার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বিশ্বের।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

এখন নিজের চেয়ে ভয় আর আতঙ্ক প্রিয় মাতৃভূমিতে থাকা পরিবার এবং প্রিয়জনদের নিয়ে। না জানি কখন কোথায় কোনো প্রিয়জন আক্রান্ত হন। চারদিকে মানুষের অসহায়ত্বের কথা ভাবলে চোখের কোণে পানি চলে আসে। একদিকে ক্ষুধার আর্তনাদ, অন্যদিকে করোনার ভয়। এ যেন উভয়সংকটে পড়ে আছেন আমার মাতৃভূমির দিনমজুর গরিব মানুষগুলো। আমরা তো তা–ও দুবেলা দুমুঠো খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু যারা দিনে এনে দিনে খায়, তাদের তো আর বাসায় বসে থাকার উপায় নেই।

মানুষ কত সমস্যায় জর্জরিত করোনাকালে তার একটি চিত্র দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী মানুষকে বলা হলো স্টে হোম, স্টে সেইফ। কিছুদিন পর অধিকাংশ মানুষ বলে উঠল ভাতের জন্য তারা মরতে প্রস্তুত, তবু এভাবে ঘরে অভুক্ত থাকতে চায় না। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষের সঞ্চয় কত কম। আমেরিকার মতো দেশেও লকডাউনবিরোধী মিছিল করতে দেখা যায়।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই নিজ উদ্যোগে ঘরে না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও ইতালির চেয়ে ভয়ংকর অবস্থা হবে বাংলাদেশে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে করোনা সংক্রমণের পরিসংখ্যানের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় বিশ্বে এক শটির মতো দেশে যখন এই মহামারি ছড়ায়, তখন আমাদের বাংলাদেশে কোনো করোনা সংক্রমণ রোগীর অস্তিত্ব ছিল না। ঠিক তখন যদি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো সাময়িক বন্ধ থাকলে হয়তো আজকে আক্রান্তের সংখ্যা এমন হু হু করে বাড়ত না। অর্থনৈতিকভাবে সাময়িক দেশের যে ক্ষতি হতো, তা হয়তো বৃহৎ আকার ধারণ করত না। যে কাজটা করে ভিয়েতনাম করেছিল, তাই তারা আজ সফল।

এই করোনা পৃথিবীর কাছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। আমাদের ভাবনায় একসময় করোনার মতো ভাইরাস শুধু স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় হিসেবে ছিল, অথচ মহামারি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের লক্ষণ প্রকাশ্য। বলা হচ্ছে করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব আগামী কয়েক প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে। বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে হবে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে আমেরিকার মতো ধনী রাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু সর্বাধিক।

করোনায় মৃত প্রিয়জনকে শেষবার দেখার সুযোগ পায়নি বহু মানুষ। কোথাও আবার ভয়ে প্রিয়জনকে দাহ বা কবর দিতে আসেনি কেউ, হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা কোনো স্বেচ্ছাসেবীর হাত ধরে নিতে হচ্ছে শেষ বিদায়। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে আল্লাহ যেন আমাদের পরিবার, দেশকে হেফাজত করেন। প্রবাস থেকে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।