বাবার সঙ্গে ঈদ

আম্মার হাতসেলাই মেশিনের সুঁই অপূর্ব ছন্দে সুতা গেঁথে চলে নতুন কাপড়ে। আমি নিবিষ্ট মনে অপলক তাকিয়ে থাকি আম্মা এবং মেশিন ও কাপড়ের কর্মপ্রক্রিয়ার দিকে। তৈরি হচ্ছে জগৎশ্রেষ্ঠ জামা। আমরা বোনেরা ঈদের দিন পরব।আমি তখন পাঁচ বছরের। বড় বোন সাড়ে ছয়। ছোট বোনটির এক বছর। শীতের সকাল। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। এরই মাঝে গোসল সারা, নতুন জামা পরনে। গলায় মালা, চুলে নতুন ফিতা, পায়ে ঝকঝকে জুতা বা স্যান্ডেল। মনে যারপরনাই আনন্দ!একটু বেলা বাড়তেই আশপাশের বাড়ি থেকে ছোট-বড় নানাজন আসেন। আমাকে আর বড় বোন রিপিকে আদর করে সঙ্গে নিয়ে যান কেউ। সবার বাড়িতেই উৎসবের আমেজ। তারপর যখন বাসায় ফিরে আসি, অজান্তেই সূক্ষ্ম এক অপূর্ণতা কাজ করে মনে। সবার বাড়িতে বাবা আছেন, কিন্তু আমাদের বাবা সেই কোন সুদূর ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী।ঈদের কিছুদিন পর আম্মা বলেন, আমরা দুই বোন বাবার সঙ্গে দেখা করতে ময়মনসিংহে যাব। ভোর ছয়টা বেজে পাঁচ মিনিটে আমাদের ট্রেন ছাড়বে। ঢাকা থেকে রওনা দেওয়ার আগের রাতটা আমার কাছে ঈদের মতোই লাগতে লাগল। আম্মা নানা রকম খাবার রান্না করছেন সঙ্গে নিয়ে যাবেন। কী সুন্দর একখানা বেতের ঝুড়িতে খাবারের বাটিগুলো সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। আমরা দুই বোন অতি উৎসাহে আমাদের কাপড় গুছিয়ে রাখছি। ঈদের সেই জামা সবার আগে। এক রাত ময়মনসিংহে থাকতে হবে। এভাবে প্রায় তিন বছর আমার ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পায় ব্রহ্মপুত্রের নগর ময়মনসিংহে।বাবা মুক্তি পান। বছর ঘুরে আসে ঈদ। ঈদের আগে বাবা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে যান বইয়ের দোকানে। কোনো দিন নিউমার্কেটে। কোনো দিন বাংলাবাজারে ফেরার পথে স্টেডিয়াম মার্কেটের দোতলায় প্রভেন্সিয়াল বুক স্টোরে। নিজ হাতে নতুন বই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা, চোখের সামনে মেলে ধরা যেন বিশ্ব!আরও কিছুদিনে আমি বুঝে গেছি, বাবা শুধু আমাদের নন। গোটা দেশটাই তাঁর পরিবার। একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালে ঈদ এলে যখন শুনতে পাই, বাবা যুদ্ধের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে, গর্বে আনন্দে মন ভরে ওঠে। একাত্তরের ঈদে আম্মা রান্না করেন ডাল, ভাত, ভর্তা। তাই-ই হয়ে ওঠে অমৃত।১৯৭৩ সালের ঈদ আমার জন্য আশ্চর্য এক ঈদ। এই ঈদে আম্মা বিদেশে। আমাদের মেজোকাকু ভীষণ অসুস্থ। আম্মা তাঁর সঙ্গে গেছেন। প্রায় দুই মাস সংসারের সব দায়িত্ব আমার। স্কুলে যাচ্ছি, বাড়ির সব দেখাশোনা করছি, ভালোই কেটে যাচ্ছিল সব। মাঝে দিয়ে সপ্তাহ দুইয়ের জন্য বাবাও দেশের বাইরে গেলেন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মিটিংয়ে যোগ দিতে। ফিরে এলেন ঈদের কিছুদিন আগে। একদিন বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, তোর কাকুর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে আরও কয়েকটা দিন লাগবে। তাই তোর মা তো ঈদের আগে ফিরতে পারছে না। ঈদে কিছু খাবারদাবারের ব্যবস্থা তো রাখতে হবে। মানুষজন আসবেন। আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম, আমি সব পারব। বাবা কোনো সংশয় প্রকাশ করলেন না। আমাকে বললেন, আমার পছন্দমতো যা খুশি করতে। জানতে চাইলেন, খরচের টাকা কতটুকু আছে, যা আছে তাতে হবে কি না। সবশেষে বললেন, ‘দেখিস, সেমাই যেন তোর মায়ের মতো হয়।’আম্মার রান্না তুলনাহীন। বিশেষ করে, এ কারণেই আমার মধ্যে বেশ ভয় কাজ করতে লাগল। একদিকে আমার জন্য এ ছিল এক বিশাল দায়িত্ব, অন্যদিকে আমার ওপর বাবার নিশ্চিন্তে ভরসার ভারও ছিল প্রচণ্ড।আমি পারলাম। সুন্দর সুচারুভাবে পারলাম। মনেই হয়নি আমি তখন সবেমাত্র ১২ বছরের একজন মানুষ। এই একটি ঈদকে উপলক্ষ করে বাবা যেন আমাকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পৃথিবীর পথে হাঁটতে শেখালেন। দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে শেখালেন। কাজের ভেতর দিয়ে আনন্দ ভাগ করে নিতে শেখালেন।এবার বলি, বাবার সঙ্গে সর্বশেষ ঈদের কথা। বাবা তখন জেলে বন্দী। স্বাধীন দেশে। নিজেদের হাতে গড়া দেশে। বন্দী ঢাকার জেলখানায়। শিশু বয়সে ঈদের আনন্দকে খুঁজে পেতাম ময়মনসিংহ জেলখানায়। পঁচাত্তরে ঈদ এল; কিন্তু নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানা এক নিমেষে রচনা করল লাশের পাহাড়।