স্লোভেনিয়ায় এবার অন্য রকম ঈদ

স্লোভেনিয়ার প্রথম মসজিদ। এখানেই ঈদের নামাজ হয়। ছবি: লেখক
স্লোভেনিয়ার প্রথম মসজিদ। এখানেই ঈদের নামাজ হয়। ছবি: লেখক

প্রতিবছর মাহে রমজানের শেষে যখন পবিত্র ঈদ আমাদের সামনে আসে, তখন বারবার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই গানটি আমাদের মনের পর্দায় প্রতিধ্বনিত হয়:

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’

বছর ঘুরে আবারও দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর এসেছে। রোববার ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোও স্লোভেনিয়ায় ঈদুল ফিতর উদযাপিত হচ্ছে। তবে এবারের ঈদ যেনও খুশির পরিবর্তে এক হতাশার চাদরে মোড়া।

সত্যিকার অর্থে এ বছর তেমনভাবে কারও মাঝেই সে অর্থে ঈদ আনন্দ হচ্ছে না বললে চলে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস আজ গোটা পৃথিবীর মানুষের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের এক আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবীর মানুষই অসহায়। প্রতিদিন যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজারো মানুষ করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছেন, ঠিক তেমনিভাবে প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে শত শত প্রাণ। গোটা পৃথিবী যেনও আজ মৃত্যুপুরী। এমনকি বিশ্ব অর্থনীতি আজ আবারও এক ভয়াবহ দুর্যোগের সামনে দাঁড়িয়ে।

অন্য রকম এক রমজান দেখল এবার গোটা দুনিয়া। এবার রমজানে ছিল না সে অর্থে কোনো আনুষ্ঠানিকতা। অনেকটা হতাশার মধ্য দিয়েই এবার রমজানেকে বিদায় জানাতে হয়েছে।

মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়া বরাবর অন্য দেশ থেকে একটু ভিন্ন দেশের মানুষের চোখে। প্রথমত, দেশটি সে অর্থে আমাদের দেশের মানুষের কাছে পরিচিত নয়। দ্বিতীয়ত এ দেশটিতে সে অর্থে বাংলাদেশিদের বসবাস নেই। ২১ লাখের জনসংখ্যাবিশিষ্ট এ দেশে সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো বাংলাদেশি বসবাস করেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়ায় বাংলাদেশিদের মধ্যে তেমন কোনো সুসংগঠিত কমিউনিটি নেই। একই সঙ্গে এখানে যাঁরা প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও তাঁদের কারও তেমন শক্তিশালী অবস্থান না থাকায় ঈদের দিনও আসলে সুযোগ হয়ে উঠে না একে অন্যের সঙ্গে এক হয়ে উৎসবের আনন্দে শামিল হওয়ার। ঈদ আনন্দ বলতে গেলে এখানে অনেকটা একাকী।

এ বছর ঈদের দিন রোববার। এখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃত, অন্য সময় হলে দেখা যায় ঈদের দিনও আর দশটি সাধারণ দিনের মতো ব্যস্ততার সঙ্গে অতিবাহিত হয়ে যায়। যাঁরা শিক্ষার্থী, তাঁদের ঈদের দিন চলে যায় ক্লাস, পরীক্ষা, থিসিস এবং ল্যাবের মধ্য দিয়ে। যাঁরা কর্মজীবী, তাঁদের জন্য ঈদের দিনটি অন্য ব্যস্ত দিনগুলোর মতোই একটি অনাড়ম্বর দিন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়ায় করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক। ১৫ মে ইউরোপের প্রথম কোনো দেশ হিসেবে স্লোভেনিয়া করোনাভাইরাসের এ মহামারির অবসান ঘোষণা করে। ফলে এখন থেকে দেশটিতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে এখনো কড়া বিধিনিষেধ রয়ে গেছে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানার শিশকাতে দেশটির ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক মসজিদের উদ্বোধন করা হয়। আশা ছিল যে হয়তো এবার ধুমধামের সঙ্গে অন্তত ঈদের নামাজ আদায় করব এ মসজিদে। অন্যান্য সময় যেটি হতো যেকোনো একটি নির্দিষ্ট বিল্ডিং থেকে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে সেখানে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। জুমা কিংবা ঈদের নামাজ ছাড়া অন্যান্য নামাজ জামাতবদ্ধ হয়ে আদায়ের সুযোগ সে অর্থে ছিল খুবই কম।

এক বসনিয়ান বন্ধুর থেকে জানতে পারলাম করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর স্লোভেনিয়ার সরকার ঈদুল ফিতরের নামাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জামাতবদ্ধ জুমা এবং তারাবির নামাজবিহীন রমজানের পর জামাতহীন এক ঈদুল ফিতরের সকালও দেখতে হবে। এমন ঈদ, এমন রমজান বোধ হয় এ শতাব্দীর কোনো মানুষই দেখেননি। কোনো কিছু না হারালে মানুষ কোনো দিনও বুঝতে পারে না হারানোর বেদনা কতটা তীব্র হতে পারে। এখন আর কেউই ঈদে নতুন জামা কিনে দেয় না। এখন আর কেউই ছেলেবেলার মতো সালামি প্রদান করে না। মায়ের হাতে সকালে রান্না করা সেমাই কিংবা জর্দা এখন কেবল এক অলীক স্বপ্ন বৈ আর কিছুই নয়। বাবার সঙ্গে করে এখন আর ঈদগাহে যাওয়াও হয় না, নামাজ শেষে কারও সঙ্গে কোলাকুলিও করা হয় না। দুপুরবেলা পরিবারের সবার সঙ্গে এক টেবিলে বসে বিরিয়ানি কিংবা পোলাওয়ের স্বাদও জোটে না আর। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও ঘুরতে বের হওয়া হয় না এখন আর। ঈদ উপলক্ষে কেউ আর এখন দাওয়াত তো দেয় না। যান্ত্রিকতার ভিড়ে আসলে সব অনুভূতি চৈত্রের দুপুরের মতো শুকিয়ে গেছে।

অন্যান্য বছরে এ সময় ইতালি কিংবা অস্ট্রিয়ায় চলে যেতাম। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মনে রাখার মতো একটি সময়ও অতিবাহিত করতে পারতাম। করোনার কারণে সীমান্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন, ইতালি অস্ট্রিয়া যাওয়া সম্ভব নয়। ঘরে রান্নার যতটুকু মসলা ছিল, সব শেষ। ইউরোপিয়ানদের মতো আধা সেদ্ধ মসলাবিহীন খাবারে দিন কাটছে। এককথায় বিস্বাদের। সীমান্ত খোলা থাকলে ইতালি কিংবা অস্ট্রিয়ায় গিয়ে কিছু সদায় করে নিয়ে আসতাম।

ঈদ সবার জীবনে বয়ে নিয়ে আসুক অনাবিল শান্তি আর আনন্দ। মানুষের মধ্যাকার সব ধরনের বিভেদ চিরতরে দূর হয়ে যাক। করোনাকে একটি বিশেষ কারণে ধন্যবাদ জানাতে হয়। করোনার এ পরিস্থিতি না হলে আমরা কখনো আশপাশের মানুষের দুঃখ-কষ্টকে এভাবে বুঝতে পারতাম না। তাই এবারের ঈদের মূলমন্ত্র হোক মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা।

সবাইকে জানাই পবিত্র ঈদেরর শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া