প্রবাসে আনন্দ-বেদনার ভার্চ্যুয়াল ঈদ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঈদ মানে প্রীতি-সম্প্রতি, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধন। ঈদে মুসলমানের অন্তরে বয়ে যায় আনন্দ-উল্লাস আর উচ্ছাসের বাঁধভাঙা জোয়ার। নিভিয়ে ফেলে হিংসা-বিদ্বেষ, দম্ভ-অহংকার, কাম-লোভ ও রাগ-ক্রোধের আগুন। ভুলে যায় উঁচু-নিচু, আমির-ফকির আর ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। সবাই হয়ে যায় ভাই ভাই, আপন। মেলায় হাতে হাত। করে কোলাকুলি। একজন আরেকজনকে টেনে নেয় বুকে। কণ্ঠে বাজে শান্তি, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব আর সাম্যের গান। সারা মাস রোজা রেখে মুসলমানেরা আল্লাহর দরবারে পেশ করে ত্যাগের সর্বোচ্চ নজরানা। এতে তারা হয়ে ওঠেন আরও উজ্জীবিত। তারা মহান আল্লাহর অপরসীম গুণ-কীর্তন ও স্তুতি-বন্দনা করেন। বছর পেরিয়ে পবিত্র রমজান শেষে আমাদের দোরগোড়ায় মহিমান্বিত সেই ঈদ। কবি কাজী নজরুলের ভাষায় ঈদের আনন্দ আজ সকলের মাঝে পড়ুক ছড়িয়ে। হিংসা-বিদ্বেষ, ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মিলিত হই ঈদের এই সীমাহীন আনন্দ-উৎসবে।

আমরা জানি ঈদ মানে আনন্দ, উৎসব ও আয়োজন। তবে এ বছর ঠিক বিপরীত ঈদ উদযাপন করছি আমরা। বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য এমন বিবর্ণ একটা ঈদ এসেছে, যা আগে কখনো আসেনি। এবারের ঈদ হবে কষ্টের, এবারের ঈদ হবে বেদনার। এবারের ঈদ স্বজন হারানোর এবং বন্দীদশার মধ্যে ঈদ হবে। করোনা দিনে ব্যতিক্রমী এক ঈদ হতে যাচ্ছে আমাদের স্পেনে। কারণ স্পেনে লকডাউন ৭ জুন পর্যন্ত চলবে। সুতরাংসামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে সবাইকে। কোথাও ঈদের জামাত হবে না। ঘরে বসেই ঈদের নামাজ হবে। ১০ জনের বেশি একত্রিত হতে পারবে না। দুই মিটার দূরত্ব মেনে চলতে হবে।

ঈদের অনাবিল আনন্দের আবহ এবার নেই। খুশির জোয়ারও নেই। সবকিছু থমকে গেছে। দেশে বিদেশে অনেকে মারা গেছেন। অনেকেই হাসপাতালে রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। স্বজন হারানোর বেদনা সবখানে। এই বৈশ্বিক মহামারী পৃথিবী থেকে খনিকের জন্য যেন সব আনন্দ তুুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তবুও ঈদ এসেছে।

ডিজিটাল এই দুনিয়ায় আপ্যায়ন, গল্প, ডেটিং, শুভেচ্ছা ও উপহার বিনিময় সবই চলতে পারে ভার্চ্যুয়ালি। আমরা যারা দূর প্রবাসে থাকি এখানেও রোজা আসে, তারাবি হয়, ইফতার পার্টি হয়। সবকিছুই হয়। কিন্তু কোনোভাবেই তা দেশের মতো না। দেশে যেমন রোজা শুরু হলেই একটা উৎসবের আমেজ তেরি হয়। কেনাকাটা, ঈদের বোনাস, লাইটিং, ঈদ ফ্যাশন, ঈদ সংখ্যা পত্রিকা, টিভিতে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান, ঈদ পুনর্মিলনী, সিনেমা হলে নতুন সিনেমা মুক্তি পাওয়া কত কি। প্রবাসে এসব কিছুই নেই। প্রবাসে ঈদের দিনটা উইকএন্ডে হবে কি না এই নিয়ে চলে গবেষণা। কারণ উইকডেতে হলে ঈদের দিন কাজে যেতে হবে। বাচ্চাদের যেতে হবে স্কুলে। দেশে যখন সবাই ঈদ উৎসবে মেতে থাকবে তখন প্রবাসে আমাদের থাকতে হয় কর্মস্থলে। কখন ঈদের দিনটা চলে যায় টেরও পাওয়া যায় না। বাসে-সাবওয়েতে বসে বা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে হাত রেখে আর চোখের জলে বাবা-মা, ভাই-বোনদের কথা মনে পড়ে যায়। যারা বাবা-মাকে হারিয়েছেন বা হারিয়েছেন কোন আপনজনকে তাদের কথা বেশি বেশি মনে পড়ে এই দিনে। প্রবাসে অনেক সন্তান হারা মা লুকিয়ে কাঁদেন। তার সন্তান ফিরবে না এই আনন্দের দিনে।

আনন্দ-বেদনার ঈদের নাম হচ্ছে প্রবাসের ঈদ। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিজের মতো করে আনন্দ খুঁজে নেয় প্রবাসীরা। তারাও ঈদের নামাজ পড়ে, কোলাকুলি করে, বেড়াতে যায় বন্ধুর বাড়িতে। কিন্তু তারা প্রিয়জন থেকে অনেক অনেক দূরে। তাদের শূন্যতা কিছু দিয়ে পূরণ হওয়ার নয়।এই করোনার কারণে সৃষ্ট অভাব আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল 'সাধ্যের বাইরে যে সাধ তা কোন কালে পূরণ হবার নয়, সাধ্যের মধ্যেই আছে সকল সত্য।' আসুন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচি। আর সেটাই হবে এই করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে ভার্চ্যুয়াল ঈদের আনন্দ।