জন্মদিনে নজরুল এসেছিলেন জন্মভূমি বর্ধমানে

র বাংলার মটিতে অজয় নদের দুপারে এমন দুজন মানুষ রয়েছেন, যাঁদের নাম প্রায় একসঙ্গে উচ্চারিত হয়—রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল। এই দুজন মানুষ বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে এক বাঁধনে বেঁধেছেন বিভক্ত দেশের সব সীমারেখা মুছে দিয়ে। বলা চলে, বাঙালির সংস্কৃতিকে অবিচ্ছেদ্য করে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম।

অবিভক্ত বর্ধমান, বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ (২৪ মে, ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে) জন্মগ্রহণ করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘কবিরে পাইবে না তাহার জীবনচরিতে’। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, কবি বা সাহিত্যিকদের জীবনদর্শন এবং কাজ কিছুটা হলেও তাঁর চারপাশের পরিবেশের দ্বারা নির্ধারিত হয়। সেই জীবন কোনো না কোনো ভাবে ছাপ ফেলে যায় তাঁদের সাধনায়। নজরুলও ব্যতিক্রম নন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,/ মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!/ আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,/ আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার!’ প্রশ্ন জাগে, তিনি কোথায় পেয়েছিলেন এই প্রতিবাদী সত্তা? এর উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে তাঁর ব্যক্তিজীবনে।

১৯৬৭ সাল। অবিভক্ত বর্ধমান জেলায় নজরুল একাডেমির উদ্যোগে পালিত হবে কবির জন্মদিন। কিন্তু সেবারের উৎসবের চেহারাটা কিছুটা আলাদাই ছিল। কারণ, সেবার তাঁর জন্মদিনে উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং কবি নজরুল। কবির ভাইপোরা তখন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন সেই সময়ের বিশিষ্ট মানুষজনের বাড়িতে। আয়োজকেরা জানান, এবারের অনুষ্ঠানে কবির সঙ্গে তাঁর জন্মভূমি সেকালের আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত চুরুলিয়াতে আসছেন কবির পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। আসার কথা ছিল তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও। প্রতিবারের মতো সেবারও অনুষ্ঠানের পুরোভাগে রয়েছেন কবির ভাইপোরা।

কবি নজরুল জন্মেছিলেন এই ঘরেই। ছবি: শ্যামসুন্দর বেরা
কবি নজরুল জন্মেছিলেন এই ঘরেই। ছবি: শ্যামসুন্দর বেরা

নির্দিষ্ট দিনে শুরু হলো অনুষ্ঠান। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমকে উপেক্ষা করে বহু সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন সে দিন ভিড় জমিয়েছিলেন চুরুলিয়ায়। কবির ছোট্ট জন্মভিটা তখন লোকে লোকারণ্য। পশ্চিম বর্ধমানের পাথুরে গরমে সবাই ক্লান্ত, তবুও কবিকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য চোখেমুখে উপচে পড়ছে কৌতূহল। যে ঘরে তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, সেখানে একটি নিচু খাটের ওপর তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর সেই বড় চোখ দুটি তখন উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। কালো কোঁচকানো চুলের রংও গেছে সাদা হয়ে। মাথাজুড়ে দেখা দিয়েছে টাক। ওই গরমেও কবি পরে রয়েছেন গরদের পাঞ্জাবি। গলায় ফুলের মালা। কবির চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি অন্তরে অন্তরে কোথাও যেন ভীষণ অশান্ত। কলকাতা থেকে আসা এক শিল্পীকে এগিয়ে দেওয়া হলো গান গাওয়ার জন্য। লাল শাড়িতে তাঁকে সে দিন বেশ সুন্দর লাগছিল। কিন্তু গান কিছুটা এগোতেই কবি অশান্ত হয়ে উঠলেন। বাক্যহারা কবি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে সরিয়ে দিলেন হারমোনিয়াম। ঠিক সেই সময় এগিয়ে দেওয়া হলো দুজন বালিকাকে।

এই দুই বালিকার বাবার সঙ্গে আগেই কবির ভাইপোদের পরিচয় ছিল। কবির জন্মদিনে গান গাওয়ার জন্য তাঁদের আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। বিশেষ করে বলে দেওয়া হয়েছিল ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’ গানটি রপ্ত করার জন্য। গানটি শুরু হতেই কবি যেন কেমন শান্ত হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। তিনি হাঁটুতে হাত দিয়ে তাল ঠুকতে লাগলেন এবং আস্তে আস্তে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিছুক্ষণ পরে গলার মালাটিকে খুলে রাখার চেষ্টা করলেন কবি। পাশ থেকে কেউ একজন মালাটা খুলে তাঁর হাতে দিতেই সেটিকে কাঁপা হাতে হারমোনিয়ামের ওপর ছড়িয়ে দিলেন। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই মালাটা সরিয়ে নেওয়া হলো। তারপর নানা অনুষ্ঠানের শেষে সন্ধ্যা ঘনাল।

সন্ধ্যা নামতেই কবিকে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো উৎসবের মঞ্চে। বিরাট মঞ্চ। মঞ্চের পাশেই কবির স্ত্রী প্রমীলা দেবীর সমাধিস্থল। তার পাশের জায়গাটা রয়েছে কবির জন্য। কিন্তু ভাগ্যের এমনই এক বিচিত্র পরিহাস, ওপার বাংলার মেয়ে প্রমীলা দেবী চুরুলিয়ায় সমাধিস্থ, আর বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল সমাধিস্থ হলেন এপার বাংলায়। বাংলাদেশেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে। সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে দেশের সরকার। মঞ্চে কবিকে নিয়ে আসা হলো। সামনে বিশাল জনসমাবেশ কবিকে একটি বার চোখের দেখা দেখতে এসেছিলেন তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ। কবির প্রাক্তন ছাত্রী রেণু ভৌমিকও ছিলেন তাঁদের দলে। তবে তিনি নিজে সে দিন কোনো সংগীত পরিবেশন করেননি। কবি কেন যেন শ্রোতাদের দিকে তাকাচ্ছেন না। আবারও ডাক পড়ল দুই কিশোরীর। তারা গেয়ে উঠল ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’। কিছুক্ষণ পর কবি মুখ ফেরালেন। আবার সেই অশ্রু বিসর্জন, তাল ঠোকা, অবশেষে গলায় বেলফুলের মালা খোলার চেষ্টা। শেষে খুলে ফের হারমোনিয়ামের ওপর বিছিয়ে দেওয়া। এবার সেই বেলফুলের মালাটি তুলে নিল সেই বালিকাদের মধ্যে একজন।

কবি নজরুলকে নিয়ে আরও কয়েকটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। কবি নজরুলের গুণমুগ্ধ ব্যক্তিদের অনেকেই তখন তাঁর দুই ছেলে অনিরুদ্ধ ও কাজী সব্যসাচীর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন গানের খাতা, একটি স্বাক্ষরের আশায়। না কবিপুত্ররা তাঁদের নিরাশ করেননি। কয়েকজনের খাতায় নিজের স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে কবিপুত্র অনিরুদ্ধ একজনের খাতায় নিজের নাম লেখার আগে লিখে দিয়েছিলেন ‘সঙ্গীত হল ঈশ্বরের আশীর্বাদ’। সারা দিন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই কেটেছিল কবি নজরুলের জন্মদিন।

বর্ধমানে নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বেশ কয়েকটি কথা প্রচলিত ছিল। তিনি নাকি শেষ জীবন পর্যন্ত খুব সাজতে ভালোবাসতেন। পছন্দ করতেন পারফিউমের সুবাস। সে দিনের অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছিল গরদের পাঞ্জাবি পরে দরদর করে ঘামছিলেন কবি। কিন্তু চোখেমুখে কেমন যেন একটা অদ্ভুত আনন্দ।

প্রমীলা দেবীর সমাধির পাশে নজরুলের প্রতীকী সমাধি, চুরুলিয়া, বর্ধমান, ভারত। ছবি: লেখক
প্রমীলা দেবীর সমাধির পাশে নজরুলের প্রতীকী সমাধি, চুরুলিয়া, বর্ধমান, ভারত। ছবি: লেখক

সেই অনুষ্ঠানের পরের দিনই কবিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জামুড়িয়ায়। সেই সময় এখানকার থানার যিনি অফিসার-ইন-চার্জ ছিলেন, তিনি ছিলেন নজরুলের পুত্র কাজী সব্যসাচীর বন্ধু। সেই কারণে তৎকালীন ওসি সাহেবের বাড়িতেও কবিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ঘরোয়াভাবে সে দিন তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন জামুড়িয়াবাসী। এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে সপরিবারে কবি নজরুল ইসলাম চলে যান কলকাতায় পরে সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পূর্ববঙ্গে। ঘটনাচক্রে সেটাই ছিল কবির শেষবারের মতো তাঁর জন্মভূমি বর্ধমানে আসা। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তাঁকে আর বর্ধমানে আনা সম্ভব হয়নি। সে দিনের কবির সেই সফর আজও বর্ধমানবাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।

তবে কিছুটা কুণ্ঠা সত্ত্বেও আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় আমাদের নজরুল চর্চায় খামতির কথা। বাংলাদেশের কিছু উদ্যোগ সাধুবাদ জানানোর মতো হলেও এখন অনেক কাজ বাকি রয়েছে। সে কাজ নজরুল সাহিত্য অর্থাৎ নজরুলের লেখা সাহিত্য নির্ভর 'সেকেন্ডারি ডেটা' বিশ্লেষণ মূলক গবেষণা প্রবন্ধ রচনার কাজ নয়। সে কাজ হল নজরুলের দর্শনের উৎসে পৌঁছানোর। অন্তত আজকের পৃথিবীতে যখন মানুষ সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হতে হতে ক্রমশ ছোট হতে বসেছে, শেষ হতে বসেছে সম্প্রীতি, সমানুভাবের মতো শব্দমালা, তখন বোধ হয় নতুন করে কাজী নজরুল ইসলাম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে আমাদের চর্চায়, আমাদের মননে এবং সর্বোপরি যাপনে। চুরুলিয়া ঘেঁষে আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের অন্যতম উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে 'নজরুল সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালাচারাল স্টাডিজ'। 

১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কবিতীর্থ চুরুলিয়ার নজরুল একাডেমির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় তথা সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ এক যোগে প্রতি বছর নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মে-তে আয়োজন করে সপ্তাহব্যাপী নজরুল মেলা। নজরুলচর্চা শহরকেন্দ্রিক মানুষকে চুরুলিয়ামুখী করে তোলে এই সময়। চুরুলিয়াকে কেন্দ্র করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সাধারণ মানুষের যোগদানকে নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও রয়েছে অদূর ভবিষ্যতে।