প্রয়াত শিক্ষক

সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর। ছবি: সংগৃহীত
সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর। ছবি: সংগৃহীত

মাত্র দুদিন হতে চলছে বাংলাদেশে একজন বিদুষী শিক্ষাবিদ নিলুফার মঞ্জুর করোনা আক্রান্ত হয়ে বিদায় নিয়েছেন। ঢাকা শহরের নামকরা স্কুল সানবিমসের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ছিলেন তিনি। মিডিয়াতেই নাম ও পরিচয় জানলাম। যেহেতু বিদেশে থাকি, তাই বাংলাদেশের খুব সাধারণ ঘটনা আমাদের অনেকের কাছেই অনেক রকমের আবেদন জাগায়, ভালো-মন্দ কম বা বেশি। নিলুফার মঞ্জুরের চলে যাওয়া আমার কাছে তা–ই করল।

এই যে বসে আছি একান্ত নিজের ঘরে, কিছু লিখতে চেষ্টা করছি, হয়তো আগামীকাল এই আমিই চলে যেতে পারি। একটা মাত্র খবর, ‘লুনা করোনা আক্রান্ত হয়ে চলে গেছেন।’ কবি নাজিম হিকমত বলেছেন, শোকের আয়ু মাত্র তিন দিন।

বহমান পৃথিবী সামান্য কারণেও এক সেকেন্ডের জন্য পিছু ফেরে না। একজন দিনমজুর, নিলুফার মঞ্জুর বা লুনার চলে যাওয়া মানেই চলে যাওয়া। তবু মানুষ পেছনে ফেরে, ফিরতেই হয়। যেমন ফিরেছেন মঞ্জুরের জন্য প্রিয় অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। শোকগাথা পড়ছিলাম প্রথম আলোয়। আরও একজন কৃতী ছাত্রী ছিলেন, তিনি লিখেছেন আমেরিকা থেকে। কী করে নিলুফার মঞ্জুর দাগ ফেলে আছে তাঁর জীবনে। লেখাগুলো পড়তে পড়তে আমিও কেমন স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। অতিসাধারণ এই জীবন, ভীষণ সাধারণ, এত সাধারণ যে বলতে লজ্জা হয়, কোনো দিন ভালো ছাত্রী হতে না পারার বেদনা বারবার নিজেকে লেখা থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে প্রেরণা জোগায় কী লিখব? কোন শিক্ষকদের কথা লিখব—কী হবে লিখে?

১৯৮০ সালে পড়তাম ঢাকার ধানমন্ডি স্কুলে। সব মিলিয়ে চার বোনের জন্য মা-বাবা ১০০ টাকা বেতন দিতেন। কী শিখেছিলাম। ক্লাস নাইন থেকে এইচএসসি অব্দি পড়লাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯। সেসব তারকা শিক্ষকের কাছে শিখেছি অনেক। স্কুলের পড়া তো পড়ে পাস করলেই হলো। কিন্তু মানুষ করেছিলেন সেসব শিক্ষক, শিখিয়েছিলেন জীবনের মূল্যবান সব সততা আর নিষ্ঠা, তাই কি আজ চোখ ভরে আসে নোনা পানি দিয়ে?

নর্থ আমেরিকার চাকরির বাজারে প্রচলিত কিছু ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়, বলা হয়, গৎবাঁধা ভালো ছেলেমেয়ে, যারা কেবল পড়াশোনায় ‘এ ক্লাস’ মার্কস পায়, তাদের দিয়ে কিছু হবে না। জীবনকে জয় করার জন্য চাই এমন মানুষ, যাঁরা বারবার হেরে গিয়েছেন, পৃথিবীর সব শক্তি সঞ্চয় করে বারবার নেমে পড়েছেন লড়াইয়ের জন্য, যাঁরা বীর দর্পে গতানুগতিক পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর পথে বের হয়ে গেছেন, তাঁদের চায় নর্থ আমেরিকা, কিন্তু আমি এসব বকছি কেন?

খুব ছা-পোষা এক শিক্ষক বাবার মেয়ে আমি। আজন্ম যে কোনো চাকরিকে এত মহান করে দেখেছি যে সেটা ছাড়ার আগে নিজের জান যায়, তাও ভালো কিন্তু চাকরি ছাড়ব না। আর এ অভ্যাস আমি কপি–পেস্ট করে পেয়েছি বাবার কাছে থেকে। তাহলে কী বলতে চাই এই লেখায়? আমার কি তাহলে এই চাকরিও পাওয়ার কথা ছিল না নর্থ আমেরিকায়? বিশ্বাস করুন, পাঠক টরন্টো শহরের এই অস্বাভাবিক চাকরির বাজারে আমি যে একটা স্ট্যাবল চাকরি করি, এটাই আমার বাঁচার একমাত্র প্রেরণা। তাহলে কী করে এই পরম প্রাপ্তি হলো আমার? সেসব কথাই যেন মনে করিয়ে দিলেন নিলুফার মঞ্জুরের শোকগাথা।

ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাবা সামলাতেন চাকরি, মা, সংসার। এর ভেতরে আছে মাসের ১০ তারিখে বাবার বেতন ফুরিয়ে যাওয়ার নিত্য গল্প। কোনো কোনো মাসে বেতন আসার আগেই বেতনের হিসাব করা শেষ, কাকে দেখবেন মা—আমাদের পড়াশোনা নাকি সংসার?

কত যে গল্প আছে। ১৯৮১-৮২ সাল হবে। আমরা চার বোন তখন ফোর থেকে নাইনে পড়ি। আমাদের নিচতলায় নামকরা এক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ থাকতেন। তাঁরাও চার বোন, আমরাও। তারা পড়ত হলিক্রসে, আমরা ধানমন্ডি, কামরুন্নেসা স্কুলে। ওই শিক্ষক খালাকে একদিন আম্মা দুঃখ করে আমার আর বড় আপার পড়াশোনার কথা বলছিলেন। তিনি আম্মাকে নাম ধরেই ঢাকতেন। বললেন বুলি, তোমার মেয়েরা যে এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে উঠছে, সে জন্য তুমি শুকরিয়া করো। তুমি আবার ওদের ভালো রেজাল্ট চাও নাকি? মনে রাখা দরকার, তিনিও কিন্তু শিক্ষক।

আমি যেবার এইট থেকে নাইনে উঠি, তখন স্কুলের এক শিক্ষক বললেন, তুমি আর্টস ছাড়া আর কী পড়বে, তাও দেখো পাস করতে পারো কি না? আমার স্যারও শিক্ষক। তিনি স্বপ্ন দেখানোর বদলে আমাকে দিলেন অপমান আর হীনম্মন্যতা।

সেই একই স্কুলে, একই শ্রেণিতে সে বছর একজন নতুন শিক্ষক এলেন। তিনি আমাদের জেনারেল ক্লাস নিচ্ছিলেন। আমরা আর্টস-সায়েন্স সব মেয়ে একসঙ্গে বসা। সামনের বেঞ্চে বসে আছি। আপা জানতে চাইলেন বড় হলে আমরা সবাই কে কী হতে চাই। আমার পালা যখন এল, ক্লাসে সবাই তখন চাপা হাসি হাসছে। কারণ আমি এতই ফেল্টু ছাত্রী যে আমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে? আপা সবাইকে জোরে ধমক দিলেন। বললেন, কেন তোমরা লুনাকে এমন ভাবছ। দেখো, একদিন ও হয়তো তোমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে অনেক অনেক উঁচুতে উঠে যাবে। তিনিও শিক্ষক, আমি সেই একবারই মাত্র ওই আপার ক্লাস পেয়েছিলাম। এরপরই আমরা ঢাকা থেকে সাভারে চলে যাই। সেই স্বপ্নবান শিক্ষক মাত্র তিন মিনিটে আমাকে অনন্য করে তুলেছিলেন? আপা কি দেখছেন আমাকে এই মুহূর্তে, একান্ত পড়ার টেবিলে সেই তারকার মতো উজ্জ্বল শিক্ষককে মনে করে ব্যাকুল হয়ে পড়ছি এই পড়ন্ত বেলায়?

জাহাঙ্গীরনগর স্কুলে একজন ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন নাম রামকান্তি ঘরামি। স্যারের মাত্র অল্প কিছু ক্লাস পেয়েছিলাম। ক্লাস টেনে ফেল করে এক বছর বেশি ছিলাম, ক্লাস করতে হতো ছোট বোনের সঙ্গে। সব সময় মন ছোট করে ক্লাসে যেতাম। খুব দুঃসহ সময় সেটা। অনেকটা করোনা-কালের মতো মনে হতো। দম আটকে আসত স্কুলে যাওয়া–আসা করতে। ঘরামী স্যার মনে হয় সেটা বুঝে ফেলেছিলেন। একদিন ক্লাসে সবার সামনে বললেন, ‘তুমি মন খারাপ করো ক্যান, তুমি জানো আমি ম্যাট্রিকে ৪ বার ফেল করছি। ফেল করলে কিছু হয় না, সমস্যা হয় জীবনে যদি তুমি হার স্বীকার করো, তুমি সেদিনই পরাজয় বরণ করলা, বুঝলা?’

স্যার কি তাহলে ২৮ বছর আগেই নর্থ আমেরিকার থিওরিটা জেনেছিলেন? আমার ভেতরে বুনে দিয়েছিলেন রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায়ের ধারণা। আজ যেমন বিশ্বাস করি হাল ছেড়ে দিলেই পরাজয় হয়। হাল ধরে থেকে যদি জীবনের খেয়া পাড়ি দিতে নাও পারি, তাও আমার জয় আটুট থাকবে। আমি জানব আমি নিরন্তর চেষ্টা করে গেছি।

মিসেস নিলুফার মঞ্জুর নিশ্চয় একজন মানবিক টিচার ছিলেন, যিনি স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন তার ছেলেমেয়েদের ভেতরে। আমিও পেছন ফিরে দেখেছি বারবার দেখেছি এখনো বাংলাদেশের আনাচকাচানে শিক্ষক আছেন, সত্যিকার মানুষ আছেন। না হলে দেশ বাঁচে কী করে? ইচ্ছা ছিল অনেক অনেক বড় করে সব শিক্ষকের কথা লিখি, নিজের মনকে জানাই, একদিন সেসব মহান শিক্ষকের কাছে পেয়েছিলাম বলেই আজ জীবন এত সাহসের সঙ্গে অর্জন করতে পারছি। মহান শিক্ষক মিসেস মঞ্জুরসহ সব প্রয়াত শিক্ষককে অভিনন্দন, যাঁরা চলে যান না বরং রয়ে যান জীবনের সব অর্জনে।

*লেখক: উন্নয়নকর্মী