প্রবাসে ঈদের সেমাই, আমার অভিজ্ঞতা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

জীবনে চলতি পথে কতই না অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। আর ঈদের দিনটা যদি বাবা-মা, ভাইবোন ছাড়া প্রবাসে কাটাতে হয় তাহলে সেটাকে তিক্ত অভিজ্ঞতা বলতেই হয়। কিন্তু আসলে কি আমার এবারের ঈদটা তিক্ত ছিল? উত্তর হবে, না।

শেষ রমজানের জন্য সাহরি খেতে উঠেই মনের মাঝে একটা অজানা ব্যথা আঘাত হানল। বাবা-মা, বোনদের ছাড়া এই প্রথম রোজার ঈদ উদযাপন করতে হবে।

মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছি ছয় বছরের বেশি সময় হয়েছে। কিন্তু প্রতি রোজার ঈদ আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে করতে দেশে যেতাম। একবার মাত্র সাত দিনের জন্য গিয়েছিলাম ছুটিতে। মাস্টার্সের সময় ফুলটাইম রিসার্চ শিক্ষার্থী থাকায় অন্যদের মতেন আমাদের কোনো লম্বা ছুটি পাওয়া যেত না। কিন্তু এবার পিএইচডি চলাকালীন ইচ্ছা ছিল থিসিস লেখাটা গুছিয়ে ঈদের আগেই দেশে চলে যাওয়ার। সব পাল্টে গেল মালয়েশিয়া সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল গেট পুরো লক হয়ে গেল সেই মার্চের ১৮ তারিখে। নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষার্থীদের বাইরে যাওয়াতে কড়া বিধিনিষেধ ছিল।

রোজার শেষ দিকে তাই চিন্তায় পড়ে গেলাম ঈদের দিন কী করব। নামাজ তো বাইরে পড়া যাবে না! আর সেমাই-জর্দা, পোলাও-মুরগি কীভাবে রান্না করব। বলে রাখা ভালো, সব সময় ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় খাওয়ার অভ্যাস থাকায় নিজে থেকে তেমন রান্না করা হয়ে ওঠেনি, ঈদের আয়োজন সে তো পরের ব্যাপার। যা–ই হোক, এক বাংলাদেশি দোকানদার ভাইকে সেমাই তৈরির আইটেম ডেলিভারি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। বাদল ভাই একেবারে হোস্টেলের বন্ধ গেটের সামনে এসে ডেলিভারি দিয়ে গেলেন। মনে একটা ভরসা পেলাম। যাক, ঈদের সকালের সেমাই তো রান্না করা যাবে। বাসায় বাবা-মাকে কিছুই জানালাম না। আমাদের ভার্সিটির থেকে ইফতার আর সাহরির খাবার সরবরাহ করা হতো শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে। মালয়েশিয়ানদের আথিতেয়তা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে। ঈদের তিন দিনও শুনলাম খাবারের ব্যবস্থা করবে কিন্তু ঈদে মালয় খাবারের ধরন বাংলাদেশ থেকে অনেকটা ভিন্ন। আমাদের দেশে সেমাই, পায়েশ, চটপটি, জর্দা ইত্যাদি আয়োজনে থাকলেও এই দেশে চলে হরেক স্বাদের কুকিজ, লেমাং, রেন্দাং নামক ঝাল আইটেম আর মুরগি বিরিয়ানি।

ঈদের আগেই ইন্টারনেট থেকে সেমাই রান্নার রেসিপি জেনে নিলাম। সব আইটেমও জোগাড় করে ফেললাম। হোস্টেলে ৬০ জনের মতো ছিলাম। বেশির ভাগই বিদেশি শিক্ষার্থী। স্বাভাবিক সময়ে হোস্টেলে প্রায় ৫০০ জনের থাকার ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশি ছিলাম মোটে চারজন। এর মাঝে আমি ছাড়া বাকিরা সবাই অনেকটা নতুন এসেছেন মালয়েশিয়ায়। এই দেশে বসবাসের হিসাবে তাই আমিই সিনিয়র ভাই। নিজ দায়িত্ববোধ থেকেই তাই সবার জন্য সেমাই রান্নার দায়িত্ব আমি নিলাম।

চাঁদরাতে ফজরের নামাজের আগেই সেমাই রান্না শেষ হলো। বোনদের কাছে রান্না করা ছবি-ভিডিও পাঠালাম। নিজেও একটু চেখে দেখলাম। যাক, ভালোই হয়েছে। মনটা খুশিতে ভরে উঠলো যখন ঈদের নামাজের আগেই দেশী ভাইদের রুমে রান্না করা সেমাইয়ের বক্স পৌঁছে দিলাম। মনের মাঝে একটা তৃপ্তি পেলাম যখন দেশি ভাইয়েরা সেমাই পেয়ে ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন এবার হয়তো সেমাই ছাড়াই ঈদের দিন পার করতে হবে!

এরপর সরকারের নির্দেশ মোতাবেক নিজেরাই ঈদের জামাতের ব্যবস্থা করলাম হোস্টেল রুমে। নামাজের আগে ঈদের সেমাই খেয়ে সবাই আমাকে অনেক কৃতজ্ঞতা জানাল। আমিও ঈদের দিন মাকে জানালাম আমার রান্না করা প্রথম সেমাইয়ের ব্যাপারে। মা কান্না জুড়ে দিলেন। মায়েরা তো এমনই! প্রবাসজীবনে মায়ের হাতের সেমাই ছাড়া এই ছিল আমার ঈদের দিনের অভিজ্ঞতা।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক (রিসার্চ ফেলো), ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স মালয়েশিয়া (USM), পেনাং।