মায়ের ভাত খাওয়ানো বড় বেশি মনে পড়ে

মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি যখন আমার পাকা হয়ে যায় তখন থেকেই মনে হয় মায়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া মর্জি বা আবদারের বিষয়গুলো স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে আসছে। তার আগের কোনো ঘটনাই মনে করতে পারছি না। এর পরের অনেক বিষয় মনে নেই। তবে মা আমাকে কত আদর দিয়ে যে ভাত খাওয়াতো, সেই বিষয়গুলো বেশ মনে করতে পারছি।

বাড়িতে প্রতিদিন সান্ধ্যয় প্রার্থনা হতো। পরিচালনা করতেন বাবা। মা বাবাকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতো। তখনই মায়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা বলতে শিখিয়েছেন। স্কুলে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় থাকে, যা মায়ের কাছ থেকেই শেখা হয়। যে জন্য বলা হয়, প্রতিটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছেন মা। মায়ের কাছে আমি প্রথম শিখেছিলাম কিছু প্রার্থনা করা। এ কারণেই মনে হয় মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা এই প্রার্থনা করা নিয়েই হয়।

যেদিন বাড়ি থেকে মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করে বিদায় নিয়ে আসি, তখন মায়ের মেমরি ঠিক ছিলো না। তার পরও মা আমাকে ধরে বলেছিলেন, যখন মন খারাপ থাকে তখন মা মারিয়ার কাছে যেন প্রার্থনা করি। বলেছিলেন, ‘দেখবি তিনিই তোকে পথ দেখাবেন। প্রার্থনা করলে মনে শান্তি পাবি, আরো কত কি।’

খাবার খাওয়ানো প্রসঙ্গে সেই ছোটবেলার কথাই মনে পড়ে আমার বেশি। কখনো কখনো সন্ধ্যার সময়ে প্রার্থনা শেষ হলে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। মা ডেকে তুলে কোলে করে রান্না ঘরে নিয়ে অনেক আদর করে ভাত খাওয়াতো। সবার মা-ই তাঁর সন্তানদের বেলায় এমনটি করেন। কেউ স্মরণ করেন, কেউ করেন না। আমি মায়ের সব বিষয়ই স্মরণ করার চেষ্টা করি। মায়ের কাছ থেকে ভালো গুণগুলোর কথা মানুষকে বলতে চাই বলেই স্মৃতির পাতা ঘাঁটছি।

শুধু যে সন্ধ্যার পর, তা কিন্তু নয়। দিনের বেলাতেও মা কখনো কখনো ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিত। এ নিয়ে ছোট বোন অভিমান করলেও মা তাকে বাদ রেখে আমার আবদারটাই যেন প্রাধান্য দিত বেশি। যতটা মনে পড়ে, তখন চাইলেই আজকের দিনের মতো ডিম খাওয়াটা আমাদের জন্য সহজ ছিল না (মনে হয়েছে তাই বলা)। মাঝেমধ্যে কারিতে ডিম দেওয়া হলে ডিমের কুসুমের জন্য মর্জি করেছি। মা নিজের ভাগের ডিম কারি থেকে তুলে নিয়ে ভেতরের হলুদ কুসুম বের করে আমার প্লেটে তুলে দিত।

মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

বাড়িতে অনেক আগে থেকেই গরু পোষা হতো। নিজেদের গাভির দুধ বাড়িতে সব সময় থাকত। প্রতিদিন সেই দুধ জ্বাল দিয়ে পাতিলে ঠান্ডা করলে দুধের ওপর সর পড়ত। বাঙালি সব পরিবারেই যেহেতু কয়েক পদের কারি রান্না হয়, আমাদেরও তা–ই হতো। সব কারি দিয়ে ভাত খাবার শেষে দুধ দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাওয়াত। দুধের ওপর মোটা যে সর পড়ত, সেই সর নিয়ে মাঝেমধ্যে আমি আর ছোট বোন ঝগড়া করতাম। মাকে দেখেছি, ছোট বোনকে নানা কিছু সান্ত্বনা দিয়ে আমাকে সর খেতে দিত বেশি। প্রয়োজনে কখনো কখনো মা আগে সরটা তুলে আলাদা করে রাখত। বোনের অগোচরে সেই সর আমাকে খেতে দিত গুড় দিয়ে।

মা আমাকে কতব ছর বয়স পর্যন্ত এভাবে ভাত মাখিয়ে খাইয়েছে, তা মনে নেই। তবে আমার মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দেওয়ার কিছু স্মৃতি আমার এ বয়সেও মুছে যায়নি। আজ মাকে নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, তখন সেই স্মৃতিগুলো তুলে আনার চেষ্টাই অনেক ছোট সময়ের ঘটনা মনে আসছে। সেসবই গুরুত্ব দিয়ে লেখা।

সেই ছোটবেলা বাড়িতে কোনো মাংস রান্নার স্মৃতি মনে না করতে পারলেও কখনো কখনো রান্নার পর মুরগির মাংসের বড় টুকরোটা প্লেটে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি রান খাওয়ার জন্য দু–একবার যে মর্জি করিনি, তা কিন্তু নয়। বাবা বাজার থেকে কালেভদ্রে আলাদা কিছু নিয়ে এলে সেটা নিয়ে ছোট বোনের সঙ্গে হিংসা করেছি আমি। বোনটি অনেক ছাড় দিত আমার জন্য। মা কীভাবে গালে–পিঠে আদর দিয়ে ম্যানেজ করেছে, সব যেন চোখের পর্দায় উজ্জ্বল ভেসে উঠছে। চলবে...