ভালোবাসার টানে দূরে থেকে কাছে থাকার ঈদ

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। বছর ঘুরে আপন নিয়মে ঈদ এল, আবার চলেও গেল। প্রবাসে গত কয়েক বছরে ঈদ করেছি বেশ অনেকগুলো, প্রতিটি ঈদেই টের পাই দেশের সঙ্গে বিদেশের উদ্‌যাপনের ভিন্নতা। ঈদের জামাতে নামাজ পড়ে আর পরিচিত বাঙালি বন্ধু-বান্ধব ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই সবাই। ছোট–বড় নানা পরিসরে কমিউনিটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়ে থাকে।

ঈদ এলেই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে দেশে থাকা মা–বাবা আর পরিবারের কাছের জনদের কথা। অনলাইনে কেবল সালাম আর শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, ছুঁয়ে দেখা কিংবা জড়িয়ে ধরা যায় না। বাড়ির টেবিলে প্রিয় কত খাবারদাবার, ব্যস ছবি দেখা পর্যন্তই! চেখে দেখব কি, ঘ্রাণ নেওয়াও উপায় নেই। বাচ্চারা তো বুঝতেই শেখে না চাঁদ রাতে চাঁদ দেখা, সবাই মিলে মেহেদি দেওয়া আর ঈদের দিন সালামি গোনার মজা।

কিন্তু এবার তো শুধু দেশের বাইরে নয়, দেশের পরিস্থিতিও অন্যবারের মতো নেই, করোনাভাইরাসে পৃথিবীটাই তো বদলে গেছে। বিদেশে থেকে আমরা যেমন সব সময় ‘দূরে থেকেও কাছে থাকি’ বা ‘ভালোবাসা তো মনের টানে’ এই সেই নানা কথা ভেবে সান্ত্বনা পাই। এবার আমাদের সেই অলিখিত অধিকারে সবাই না হলেও, ভাগ বসিয়েছে দেশে থাকা অনেকেই। তাতে আমাদের কিন্তু কোনো দুঃখবোধ হয়নি, বরং বিশ্বাস জেগেছে যে তাঁরাও অন্যকে নিরাপদে রাখতে ভালোবাসার টানেই ‘কাছে থেকেও দূরে’ থাকতে পেরেছেন এবং যত দিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়, সেই সামাজিক দূরত্বটা বজায় রাখতে পারবেন। আমাদের মনের এই বিশ্বাসটা যেমন প্রশান্তির, তেমনি তাঁদের এই ত্যাগটাও তাঁদের জন্য নিশ্চিতভাবে ততটাই আত্মতৃপ্তির। আমরা যেটা বছরের পর বছর করে যাচ্ছি, আশা করি তাঁদের ক্ষেত্রে অন্তত তেমনটা হবে না। ঈদগাহে নামাজ, কোলাকুলি, এ–বাড়ি ও–বাড়ি বেড়ানো আর খাওয়াদাওয়াটা এবার হয়তো হয়নি, কিন্তু সামনাসামনি দেখা না হলেও ফোন আর ভার্চ্যুয়াল আড্ডাটা নিশ্চয়ই জমেছে।

পুরো এক মাস রোজা শেষে ঈদের দিনটি সবার জন্য উপহার হিসেবে আসে। ব্যাপারটিতে বোধ করি দেশে কিংবা দেশের বাইরে সবার আনন্দের অনুভূতিতে কোনো ফারাক থাকে না। আমরা যে যেখানেই আছি, যারা সুস্থ ও নিরাপদে রোজা, ইবাদত ও ঈদ করতে পেরেছি, ঘরে থেকেও জীবনের নিত্য প্রয়োজনগুলো এখন পর্যন্ত মেটাতে পারছি, তাদের কি সন্তুষ্ট না হয়ে উপায় আছে? এখন যদি ভাবি তাদের কথা, যারা খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই পরিবারের খুব আপন কাউকে হারিয়েছে, তাদের জন্য শুধু এই ঈদ কেন, জীবনের আর কোনো ঈদই তো কখনো আর আগের মতো হবে না।

তাই পৃথিবীজুড়ে যে যেখানেই থাকি না কেন, নিজেদের মতো করেই ছোট ছোট আনন্দগুলো খুঁজে নিয়ে আমরা ঈদটাকে অর্থবহুল করার চেষ্টা করেছি। কত কত স্বেচ্ছাসেবীরা অন্যের জীবনকে একটু সহজ করতে দিন–রাত বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবারের খুবই আপন কয়েকজন যাঁরা ডাক্তার এবং খুব কাছের ডাক্তার বন্ধুদের যখন দেখছি অদম্য মনোবল নিয়ে ছুটি বিশ্রাম ভুলে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য গর্ব করতে যেমন আনন্দ হয়, আবার তাঁদের মতো অনেকেই যখন কাজ শেষে ঘরে ফিরে তাঁদের আদরের সন্তানকে একটিবার বুকেও জড়িয়ে ধরতে পারেন না, সেটা জেনে নিজের ধৈর্যশক্তি আপনা থেকেই আরও জোরাল হয়। পরিবার আর বেশ কজন বন্ধুর ছোট ছোট বাচ্চারা দেখলাম টানা স্কুল বন্ধ থাকার সুযোগে সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবারে পুরো ৩০টা রোজা রেখে ফেলেছে। দেশে ছোট্ট ভাতিজি জারাও প্রথমবার এই কঠিন কাজটি করতে পেরে নিজেও মহা খুশি, আর তার এই অর্জনে আমাদের আনন্দটাও সীমাহীন। আমার প্রায় ৯ বছরের যারিফেরও দেখলাম ব্যাপক উৎসাহ, এখানে যখন রাত ৯টায় ইফতার হয়, সেখানেও ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করে জীবনে প্রথম ১৮ ঘণ্টার লম্বা রোজা সে কয়েকটা রাখতে পেরেছে, সেই আনন্দটার কি কোনো তুলনা হয়?

বিদেশের মাটিতে আমরা যেমন হঠাৎ করেই নানা পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি, আগামীকালটাও যে ঠিক কেমন হবে কেউ বুঝে উঠতে পারছি না, তেমনি দেশের মানুষও প্রথমবার হলেও তাদের মতো করেই মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে। বরাবরের মতো করে উদ্‌যাপনটা এবার হয়নি, কেউ একটু কম ছাড় দিয়েছে, কেউ একটু বেশি। এমন ঈদ আর কখনো আসবে কি না, সেটা ভাবতে ভাবতে আর এভাবেই হাতের নাগালে ছড়িয়ে থাকা নানা রঙের আনন্দ-অজুহাত জোড়া দিয়ে ঈদের খুশিটা ছুঁতে চেয়েছি আমরা সবাই। আগামীতে কোনো এক ঈদে আমরা আবারও মেতে উঠব উচ্ছ্বাসে আর উৎসবের আয়োজনে—এটাই সবার প্রত্যাশা।

এভাবেই কেটে গেল আমার, আপনার, আমাদের সবার ‘ভালোবাসার টানে দূরে থেকেও কাছে’ থাকার ঈদ!