আবহাওয়ার হেঁয়ালিতে করোনার দিনগুলো

রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে নীলাকাশের নিচে বাংলার উর্বর জমিন। ছবি: সামছু দ্দৌজা নয়ন
রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে নীলাকাশের নিচে বাংলার উর্বর জমিন। ছবি: সামছু দ্দৌজা নয়ন

চোখজুড়ানো অপূর্ব নীলাকাশের নিচে বাংলাদেশের সুবিস্তীর্ণ উর্বর জমিনে সবুজের সমারোহ। দুপাশে সবুজের মাঝ দিয়ে কোথাও খাল, বিল, আর বয়ে যাওয়া নদীর অপরূপ সব নান্দনিক প্রাকৃতিক দৃশ্য চারদিকে। দৃষ্টিনন্দন এই প্রকৃতি অনেক আনন্দ দেয়। হৃদয়ে মিষ্টি দোলা দেয়। প্রকৃতির এই মোহে মানুষের মনের সব দরজা খুলে যায়। মনের দরজা খুলে বৈচিত্র্যময় সব সৃষ্টির রহস্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে মানুষ প্রকৃতির মুক্ত বাতাস নেয়। নগরীয় জীবনের ক্লান্তিকর ব্যস্ততা ঝেড়ে বাইরে এসে এই মুক্ত পরিবেশে দুই নয়ন প্রসারিত করে রেটিনায় বহমান বাতাসের নরম স্রোতের পরশ পায়।

জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ কানাডা। নিজের নতুন দেশ। খুব সুন্দর, বিভিন্ন রূপে ভরা এই সুবিশাল দেশ। তবে আবহাওয়ার এক অন্য রকম হেঁয়ালি চলে এখানে। বছরের প্রায় ৯ মাস ঠান্ডা থাকে। সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস। যদিও মূল শীতকালটা হলো ডিসেম্বর, জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি। জুন, জুলাই আর আগস্ট মাস হলো সবচেয়ে আনন্দের সময় এখানে।

২.
মানুষ ও মানবতার কাজে সরকারি বড় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রকৃতিপ্রেমী এক নয়ন ছুটে বেড়ান কক্সবাজারের আনাচকানাচে। মিষ্টি কথার ফুলঝুরিতে বাঁধনে জুনিয়রদের জড়িয়ে রাখেন নরম মনের নয়ন ভাই। সামছু দ্দৌজা নয়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফজলুল হক হলের বড় ভাই। সরকারের উপসচিব তিনি। কক্সবাজারে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে নীলাকাশের নিচে বাংলার উর্বর জমিনের সেই ছবিটা তাঁর কাছেই পাওয়া। বর্তমান সময়ে করোনার আগ্রাসনে ভেঙে পড়া জীবনযাত্রাকে রক্ষায় তাঁর মতো শত শত মানুষ কাজ করছেন দেশব্যাপী।
করোনায় কুপোকাত, কী করবেন(https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1645425)। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্য সচেতনতার সব বিষয় মেনে চলতে হবে। ঘরে থাকতে হবে। তবে, ঘরে বন্দী জীবন যেন আজ আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মহামারিতে বন্দী জীবনে পেটের ক্ষুধা, করোনা টেস্ট, লাশের সারি, মৃত মানুষের সৎকার সবই যেন ঘন কালো কালিতে মোটা অক্ষরে লেখা সমার্থক শব্দ। প্রথম আলোর খবরে চোখ যায়, স্বজনেরা এগিয়ে না আসায় মৃত ব্যক্তির সৎকার করলেন ইউএনও। কী সাংঘাতিক সময় পার করছি আমরা!
তবু আশা আছে। জীবন বাঁচাতে আর মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কাজে রাত–দিন কাজ করছেন আমাদের চিকিৎসক, নার্স, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আমলাসহ অনেকে। করোনাকালে কর্মহীন ও হতদরিদ্রদের খাদ্য সহায়তার জন্য ডিসি-ইউএনওদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ-মানবতার ঘর, ভাসমান কোয়ারেন্টিন, ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, সময়ের দাবি ত্রাণ যাবে বাড়ি ইত্যাদি অনেক আশাজাগানিয়া। সর্বোপরি বাংলাদেশ পেয়েছে প্রকৃতির এক বিশাল সুন্দর উপহার। খাল, বিল, নদী ও বৃষ্টির পানি, উর্বর ভূমি, আর ফসল ফলানোর উপযুক্ত আবহাওয়া।
৩.
আবহাওয়া–বৈচিত্র্যে ভরা কানাডায় ঝিরঝিরে বাতাস আর তাপমাত্রার ক্রমাবনতির শুরুটা সেপ্টেম্বরে। তখন কোমলমতি ছেলেমেয়েদের স্কুলে নতুন বছরের পড়া আরম্ভ হয়। মা-বাবার কোল ছেড়ে চার বছরের শিশুরও নতুন জীবনের শুরু। জুনিয়র কিন্ডারগার্টেনের এই কচি শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীর জীবন তৈরির জন্য প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষার আশায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের এই ব্যস্ততার দৌড়ে সহায়তায় থাকেন পরিবারের মা, বাবা ও অন্য অভিভাবকেরা। আয়ের জন্য ছোটাছুটি করা কর্মজীবী অভিভাবকদের চিরচেনা ব্যস্ততায় যোগ হয় নতুন সংগ্রাম। আনন্দ আছে এতে, শিক্ষানন্দ। চারদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। শিক্ষা উৎসব। সাধারণ নববর্ষ হয় জানুয়ারিতে। আর জীবনের জন্য অপরিহার্য এই শিক্ষাবছর শুরু হয় সেপ্টেম্বরে।
উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষাবর্ষ শুরুর মাসে নাতিশীতোষ্ণ রৌদ্রোজ্জ্বল কোমল দিনগুলো শেষে অক্টোবরে আসে শীতের হিমেল হাওয়া। হঠাৎই ঠান্ডায় জবুথবু অবস্থা। নবেম্বর মাসে মাঝে মাঝে শিমুল ফুলের মতো হালকা তুষারের সাদা কণাগুলো বাতাসে ভাসে। ভাসমান তুষারের সাদা কণাগুলো কানাডায় মানুষকে জানান দেয় বরফ পরিষ্কারের জন্য তৈরি হতে। এ আর নতুন কী। অনেক বছর থেকেই তো এই সময় বরফ পরিষ্কারের কঠিন কাজটা করে আসছি। তবু তৈরি হয়েছি, ভারাক্রান্ত মনে।
ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির কনকনে ঠান্ডা সহ্য করে ক্ষণে ক্ষণে জমে যাওয়া ওজনে হালকা তুষারপাত আর ভারী বরফ পরিষ্কার করতে শরীরের ব্যথা হয়ে যায়। এই কাজটা দেখে খুব সহজ মনে হলেও, আসলে সহজ নয়। হিমাঙ্কের নিচে এত কম তাপমাত্রায় আর হু হু করা বাতাসের মাঝে প্রতিকূল আবহাওয়া যেন শরীরের আবরণ ভেদ করে সব হাড়গুলোকে হাতুড়ি দিয়ে পেটায়।


তুষারাবৃত আকাশের নিচে কানাডায় শান্তির শহর। ছবি: লেখক
তুষারাবৃত আকাশের নিচে কানাডায় শান্তির শহর। ছবি: লেখক

সেদিন জানুয়ারির ১৯। অনেক তুষারপাত হলো। টরন্টোতে অবশ্য তুলনামূলক কমই। ১৫ সেন্টিমিটার। নিউফাউন্ডল্যান্ডে প্রায় ৮০ সেন্টিমিটার! তুষার পড়া দেখতে ভালোই লাগে। প্রকৃতি বরফের সাদা চাদরে ঢাকা যেন। কষ্টটা হয় সেগুলো পরিষ্কারে, ড্রাইভওয়ে আর সাইডওয়াক। কোমর ও হাতে ব্যথা, কী করি। যুবক পেরিয়ে বয়সে একটু ভারিক্কি আসছে। জীবনের প্রয়োজনে জীবনসঙ্গীকেও বরফ পরিষ্কারের একটু ট্রেনিং দিলাম সেদিন। কাজটা যে সহজ নয় তিনি বুঝেছেন মনে হলো। এই কষ্ট এড়াতে সহধর্মিণীরা শীতকালে অনেক বেশি ভালো বন্ধু হয় বলেই ধারণা। তাঁরা রাগ জমা রাখেন গরমকাল গ্রীস্মে প্রকাশের জন্য। সুদে আসলে রাগ বেশি করে উঠিয়ে নেওয়া যাবে। সেই জন্য প্রকৃতিও ভারসাম্য বজায় রাখে। কানাডায় শীতকালটা অতিদীর্ঘ হয়, আর গ্রীষ্মকাল অল্প সময়ের।
ঠান্ডার কিছুটা কমতি থাকলেও কানাডায় মার্চ থেকে শুরু হলো করোনার আগ্রাসন। একসময় জরুরি অবস্থা জারি। অধিকাংশ মানুষ হলো ঘরবন্দী। অতি জরুরি পেশাদার মানুষের কাজ বন্ধ হয়নি। তাদের কাজ অনেক বেড়েছে বৈকি। এপ্রিল মাসে তাপমাত্রার খুব হেঁয়ালি খেলা। একদিনেই ১০-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তারতম্য। মাথায় টনটনে ব্যথা হয়। শীতের শেষ হয়নি। তাপমাত্রা ২ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামার খেলায় নিমগ্ন ছিল। এরই মাঝে প্রায় মৃতদশা থেকে উঠে বিবর্ণ মেটে ঘাসগুলো সবুজ রং ফিরে পেয়ে ধাই ধাই করে বড় হয়ে গেল। বরফ পরিষ্কারের ঝামেলা পেরিয়ে এবার ঘাস কাটার সময় এল। ইয়ার্ড মেসিন ঠিক করে করাত করাত কাটছি সেগুলো।
ঘাসের মাঝে লুকিয়ে থাকা ডেইজির মূলগুলো অল্পতেই তরতাজা হয়ে মাটি থেকে উঠে দ্রুতই বড় হয়ে উচ্চতায় শীর্ষে অবস্থান করছে এখন। সেগুলোর মাথায় বাহারি সুন্দর হলুদ ফুল। এই সুন্দরকে এড়াতে না পারলেই হাঁচি-কাশি-চোখ ওঠা আর জ্বর। সেই সুন্দরের মাঝে লুকিয়ে থাকা পোলেন বাতাসে ভেসে বেড়ায়, আর মানুষের নাকে-মুখে আর চোখে ঢুকে। এসবে খুব এলার্জি হয়। অনেকটা করোনার মতোই উপসর্গ সেগুলো। এপ্রিল পেরিয়ে মে মাসের শেষ এখন। এর মাঝেই এখানে হালকা তুষারপাতও হলো! নিকট অতীতে হয়নি, সচরাচর এটা হয় না।
৫.
প্রকৃতির অনেক সুন্দর উপহার বাংলাদেশ ও কানাডার জমিনে। দুই দেশেই বিরাজমান। ভিন্নতা আছে। সেগুলো উপভোগ করতে হয়। বাংলাদেশে খাল, বিল, নদী ও বৃষ্টির পানি আর ফসল ফলানোর উপযুক্ত আবহাওয়া আছে। কানাডায় শীতকালে সাদা তুষারপাতের মাঝেই আনন্দ খুঁজি। সুবিশাল এই দেশে গ্রীষ্মের সময়ে দৃষ্টিনন্দন সব পার্ক, খোলা মাঠ, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা জনজীবনে সীমাহীন আনন্দ বয়ে আনে।

এপ্রিল মাসে মনে হয়েছিল আবহাওয়া ভালো হচ্ছে। তাই বাগানের ঘাস পরিষ্কার করে তাতে সবজির বীজ ছিটিয়েছিলাম। আবহাওয়ার হেঁয়ালি খেলায় সেসব বীজের প্রাণ মরে গেছে। মাটি ভেদ করে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি সেগুলো। ঠান্ডার কারণে এ মাসেও বাগান করা হবে না। বাকি আছে জুন, জুলাই আর আগস্ট। কানাডায় সব থেকে আনন্দের সময়। তবে এবার করোনার আগ্রাসনে জনজীবন কুপোকাত। ভেবেছিলাম বাগানে সবজি করে বাজারে যাওয়া কমিয়ে করোনা থেকে দূরে থাকব। হবে তো? আগামী তিনটা মাসই ভরসা।
ঠান্ডার দেশ কানাডায় মে মাসের বিরল তুষারপাতের মাঝে পবিত্র রমজানের রোজার দিনগুলো করোনার ভীতিকর পরিবেশে কাজের ব্যস্ততায় ভালোই কেটেছে। আছে রসায়নের গবেষণা। সহকর্মীদের সঙ্গে কোভিড-১৯ টেস্ট কীটের উপাদানসহ অন্যান্য ওষুধ–জাতীয় জৈব যৌগ তৈরির প্রতিষ্ঠানে। আর নিজ পরিবারে ছোট ছোট বাচ্চাদের হাসিমাখা মুখে হাজারো কায়দায় বলতে থাকা সব মিষ্টি মিষ্টি শব্দ শুনে পায় নির্মল আনন্দ। ১০ বছর পেরিয়ে ১১–তে পা দেওয়া আমার ছোট্ট মা, তার এই প্রিয় বাবাকে প্রথমবারের মতো নিজ হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়েছে। তাও সেটা মা দিবসে, কাকতালীয় কি না জানি না। দেশের মাটিতে লেবুর বাগানের নিচে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা চিরশায়িত মাকে প্রতিদিন মনে করি। ভালোবাসি। মা দিবসে শুধু না।
*লেখক: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, টরন্টো, কানাডা। [email protected]