সন্তান ৭

বেহুঁশ খুকুর চামড়া কুঁকড়ে যাচ্ছে। জিনাত পাশের বাড়িতে ছুটেছে, ‘অ আনোয়ার কাহা, দরজা খোলেন, খুকুর কী জানি হইছে!’
অতএব, অজ্ঞান খুকুকে কোলে নিয়ে সবাই মিলেই সদর হাসপাতালে ছুটল। ডাক্তার আপা খুকুর অবস্থা দেখে যেন আঁতকে উঠলেন, ‘ওরে কিডা কী করছে? ইডা তো অ্যাসিডির পুড়া!’
সবার তো প্রায় মাথায় হাত, ‘অ্যাসিড আবার কারে কয়?’
এই ‘কারে কয়’–এর উত্তর দেওয়ার সময় নেই তখন ডাক্তারের, তিনি খুকুকে নিয়ে পড়েছেন। সাড়ে চার বছরের খুকুর শরীরের অনেকটাই পুড়ে গেছে। তবু ডাক্তার–নার্সরা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এই পোড়ার চিকিৎসা ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে হয়তো সম্ভব, তবে ওই অজপাড়াগাঁয়ে নয়। সবার কয়েক ঘণ্টার চেষ্টাকে বিফল করে দিয়ে জীবনের ওপারে পাড়ি দিল খুকু।
ছোট্ট খুকুকে মাটির বিছানায় শুইয়ে থেকে থেকে মূর্ছা যাচ্ছিলেন আনোয়ার মিয়া। শরিফা বানু কোনো কিছুতেই সামলাতে পারছিলেন না আমেনাকে। মাটিতে আছড়ে পড়ে কাঁদছিল জিনাত, শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ফাতেমা।
আর খুকুর মৃত্যুর পর যেন গ্রামের বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিলেন আব্বাস আলী আর তার গুণধর পুত্রধন। কোথাও আর হদিস মিলছিল না তাদের দুজনের। এ ঘটনার পর কিছুটা সামলে উঠে একদিন বাবাদের নিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এল জিনাত-ফাতেমা, ‘ও স্যার, ওই অ্যাসিডির কথা তো বইতি পড়ছি। এ তো বিজ্ঞানের কামে লাগে। তয়, খুকুরে?’
মিনহাজ হোসেন বুঝতে পারলেন ফাতেমা ঠিক ধরতে পারছে না খুকুর কী হয়েছিল, ‘অ্যাসিড হইল পানির মতন দেখতি একটা জিনিস, তয় পানি কলাম মোটেই না। ইডা যার উপরই পড়বি, তারেই পুড়ায় ফেলতি পারে। যে পুড়া ঠিক করতি মেলা টাকা লাগতি পারে। খুকু বেশি ছোট ছিল, তাই ওরে আল্লাহ কষ্ট বেশি না দিয়া নিয়া গেছেন।’ কয়েক ফোঁটা অশ্রু চিকচিক করে উঠল মিনহাজের চোখের কোণে। বাকি সবার চোখেও পানি।
‘তয় তুরা যদি খুকুর গায়ে অ্যাসিড পড়তিই মেলা পানি ঢালতি পারতি, তয় হয়তো ওরে বাঁচানোর চেষ্টা করা যাতি পারত। মাইয়াডা এত্ত কচি আছিল, কোন ইবলিশে ওর মউত চাইব?’ মিনহাজের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
‘তয় মাস্টার সাব, আমাগো জানালার নিচে ওই জাগায় তো খুকু এমনিতে বইত না। ওই হানে জিনাতে বই পড়ত...’
আনোয়ারের মুখের কথা কেড়ে নিলেন জামাল উদ্দিন, ‘তালি তো এমন ও হবার পারে, ওই অ্যাসিড যেই মানশি ছুড়ছিল, সে খুকুরে না, জিনাতেরে পুড়াইতি চাইছিল?’
‘ওরে আল্লা গো, জামাল ভাইডি, এইডা কী কন?’ আনোয়ার মিয়া ডুকরে ওঠেন এবার।
‘হে, ইডা হবার পারে।’ সায় দিলেন মিনহাজ। ‘এই কামডা ওই নাজমুল বান্দরডাও করবার পারে।’
‘শালা ইবলিশের বাচ্চা!’ একপ্রস্থ গালাগাল ছোড়ে ফাতেমা।
‘তয় স্যার,’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে জিনাত, ‘আম্মায় এহন আমারে আর কলেজ যাতি দিবার চান না।’
‘আমি তো যাই করিমেরে সাথে নিয়া। আমার আর জিনাতের পড়া তো এক না, আমি তো চালিও উডারে আইনে দিতি পারব না, ওর পড়া...’ ফাতেমার কথায় বোঝা যায়, তার মোটেও ভালো লাগছে না একা লেখাপড়া করতে।
‘মাস্টার সাব, আমিও তো চাই আমার মাইয়াডা কলেজ পাস দিক, তয় ক্যামনে? খুকুরে হারাইয়া ওর আম্মায় আধা মরা, তায় জিনাতের কিছু হলি...’ আবার বাঁধভাঙা কান্নার ঢল আনোয়ারের চোখে।
আনোয়ারকে কিছুটা সময় দিলেন মিনহাজ হোসেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘আনোয়ার ভাইডি, আপনে আমারে বিশ্বাস যান?’
পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছলেন আনোয়ার মিয়া, ‘হে মাস্টার সাব, বিশ্বাস যাই।’
‘তয় জিনাতেরে যদি এহন আমি আমার বাড়ি রাইখে পড়াতি চাই, দিবা? ওরে আমার মাইয়ার মতোই রাখুম।’
মিনহাজ হোসেন থাকেন পাশের গ্রামে, যেখান থেকে জিনাতের বাড়ি একটু দূর হলেও কলেজ কাছে। আমেনা বেগম প্রথমে একটু আপত্তি করলেও পরে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজি হলেন। মিনহাজ আনোয়ার মিয়ার ভ্যানেই জিনাতকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি, যেন বাবা দেখে আসতে পারেন কোথায় থাকবে মেয়ে। পথে নতুন বাঁশে ঘেরা ছোট্ট কবরটা চোখে পড়লে জিনাত মনে মনে বলতে থাকে, খুকুবু, তোরে বাঁচাতি পারলাম নারে, বইন। বুবু রে, মাফ কইরে দিস।
ওদিকে বাড়িতে তখন ধান রোদে দিচ্ছিলেন শরিফা বানু। পোষা মুরগির দল থেকে বাঁচাচ্ছিলেন ধানের দানা। জামাল উদ্দিন গোসল সেরে দুপুরের ভাত নিয়ে বসেছেন ঘরের দাওয়ায়। এমন সময় চেনা কণ্ঠ হাঁক ছাড়ে, ‘ও জামাল কাহা, বাড়ি আছেন?’
স্বামীর হয়ে উত্তর দিলেন শরিফা, ‘ও কিডা রে? খাইতে বইছে ফাতুর বাপে।’
‘কাহি, আমি আবদুল করিম।’
‘অ তুই, আয় বাজান...’ বলতে বলতেই আরেক থালা ভাত বেড়ে ফেললেন শরিফা। দুপুরবেলা কেউ না খেয়ে বাড়ি থেকে গেলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয় যে!
‘তো ক বাজান, কাহারে আইজ মনে করলি ক্যারে?’
‘কাহা, না মানে...আমি...আমি...’
ধমকে ওঠেন শরিফা বানু, ‘আরে ধুরু ছ্যারা, তোরে কি বোবায় ধরছে? কইয়া ফালা না!’
‘না, মানে কাহি, আমি...ফাতুরে...আমি...বিয়া করতি চাই।’
শরিফা বানু সোজা তাকালেন করিমের চোখের দিকে, ‘ওই, তুই জানিস না উডা কেমন? উডা কী? তুই মানতি পারবি ওরে?’
শুনে হাসে করিম, ‘দেহেন কাহি, আপনেরা আমারে মানছিলেন না? পোলার মতন পালছিলেন না? হেই কুট্টি কালতে ফাতুরে ভালা পাই আমি, ডরে কই নাই, আপনেরা যদি...ওরে আমি মানতি পারুম না ক্যারে?’
‘খাড়া, মাইয়ায় কী কয় জিগাতি হবি না?’ জামাল উদ্দিন ডাকেন, ‘অ ফাতু, এদিক এটু শুনিস তো আম্মা।’
ফোলা চোখের ফাতেমা খুকুর পুতুলটা হাতে নিয়ে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায়, ‘ডাকছেন, আব্বা?’
খুকুর মিনুর দিকে করিমেরও চোখ পড়ে, ‘আহা গো, আমাগে আদরের বুনডা! আল্লায় জান্নাত দিক ওরে।’
ফুঁপিয়ে ওঠে ফাতেমা, ‘এহন আর কেউ ফাতুবু বইলে ডাক পাড়ে না রে!’
করিমের দিকে দেখান শরিফা, ‘ফাতু, তুই ইডারে নিয়া ঘর করতি পারবি? অয় বিয়া করবার চায় তোরে।’
ঘাড় নাড়ে ফাতেমা, ‘অয় আমারে সত্যি যদি চায়, আমিও পারুম, আম্মা।’

*জিনাত কেমন আছে? কেমন কাটবে ওদের ভবিষ্যৎ জীবন? জানবেন অন্তিম পর্বে । আগামী পর্বে সমাপ্য।
দ্রষ্টব্য: আমার প্রতি কিছু পাঠক বন্ধুর অভিযোগ, আমি ভীষণ পুরুষবিদ্বেষী। আবার কেউ বলেন, আমার গল্পে কেবল নারী চরিত্রই প্রাধান্য পায়। তাই কি? আমার কাছে ভালোভাবে বাঁচার জন্য নারী–পুরুষ উভয়ে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ গল্পে এই সব অভিযোগ খানিকটা খণ্ডাতে চেষ্টা করেছি। পেরেছি কি? জানান আমায়। আশা করি প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ভালো কেটেছে আপনাদের ঈদ। ক্ষমা করবেন, এ পর্বটি দিতে একটু দেরি হয়ে গেল।
[email protected]