রশিদ মাস্টার

গ্রামের ছোট বাজার। মাঠচেরা সাপের মত একেবেঁকে চলা গিরাই নদির পাড়ঘেঁষা বাজার। রাশেদ অনেক এসেছে এ বাজারে। কিন্তু আজ এল কুড়ি বছর পরে। টানা একঘণ্টা বাজার সওদা সেরে ব্যাগটা হাতে করে সামনেই একটা ভাঙাচোরা চায়ের দোকানে ঢুকল। লম্বা কাঠের বেঞ্চের এক কোনায় বসতেই চমকে উঠলো সে। গায়ে সাদা ছেঁড়া গেঞ্জি, পায়ে সেকেলে চপ্পল, চুলার উপরে উপুড় হয়ে মাথা ঘুরে ঘুরে কাঠখড়ির আগুনে ফু দিচ্ছেন, চায়ের কেটলি পরখ করছেন। রশিদ স্যার না? বয়সের ছাপ পড়েছে চেহারায়, তবু চেনা যায়।

চোখে বেশি পাওয়ারের মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য রুমাল বাঁধা মুখটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্লান্তি সুস্পষ্ট! হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যায় রাশেদ। চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা যে এই তার প্রিয় রশিদ স্যার। মন ফিরে যায় কুড়ি বছর পেছনে।রাশেদকে বাড়িতে পড়াতে আসতেন, হাড়-কাঁপানো শীতের সকালে এসে পড়িয়ে সোজা স্কুলে চলে যেতেন।বাড়ি বাড়ি ঘুরে, ছাত্রদের জোগাড় করে ইস্কুলে নিয়ে যেতেন। সদ্য চালু হওয়া স্কুলের সামান্য মাইনে আর টিউশন পড়িয়েই সংসার চলত তাঁর। নিজের দুটি শিশু সন্তান থাকলেও ছাত্র ছাত্রীরাও যেন ছিল তাঁর আর এক সন্তান। যে পারত মাইনে দিত, যে পারতো না দিত না। কিন্তু রশিদ স্যারের পরিশ্রম কারোর জন্য কম ছিল না। মুখ দেখে, পকেট দেখে ছাত্র পড়ানো তখন ছিল না। বিদ্যালয়ের সেই সময়ের হাল ও হকিকত যা, তাতে তাকে বাইরে থেকে দেখলে কেউ স্কুল বলে মনেও করবে না। এক ঘরে গাদাগাদি করা বসা চল্লিশ-পঞ্চাশ জন ছাত্র। কিন্তু সেখানকার পড়ুয়ারা আর যাই হোক-প্রাণশক্তিতে ভরপুর।শামুকের খোলস ফেলে মুক্তা বের করার মতো, একটার পর একটা খোলস ফেলে দিয়ে চাত্রদের ভেতরের মেধাটাকে বের করে বিকশিত করার সুযোগ করে দিত।উচ্চশিক্ষা আর কর্মসূত্রে বহু বছর পরিযায়ি পাখির মত বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য স্যারের সাথে যোগাযোগের সম্পর্কটাতে অনেক আগেই জং ধরেছে। তাই আজ তাঁকে এ অবস্থায় দেখে হতচকিত হয়ে পড়ে রাশেদ।

একটু পরে চোখাচোখি হতেই স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রাশেদ, হাঁটু গেড়ে বসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।অবাক হন রশিদ মাস্টার।তোমায় তো ঠিক চিনতে পারলাম না বাবা... স্যার আমি রাশেদ, আপনার ছাত্র, মনে আছে স্যার রোজ রোজ অঙ্ক না পেরে কানমলা খেতাম আপনার কাছে, দুষ্টুমি করলে নিল ডাউন করে রাখতেন...মাথায় হাত ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করেন।.ক্লান্ত মুখে এক প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে, হয়তো বা প্রৌঢ়ের মনে ফুটে ওঠে কোনো চঞ্চল কিশোরের ছবি! তার মলিন কোটরাগত মুখ আচমকা ঝলমলে হয়ে ওঠে আলোকিত করে প্রায়ন্ধকার চায়ের দোকানটিকে। নিজেকে সামলে নিয়ে স্যারকে হাত ধরে একটু আড়ালে টেনে আনে রাশেদ, স্যার আপনি এ ভাবে টংঘরে চা।

আরে তাতে কি হয়েছে! স্কুল থেকে অবসরে গেছি, এখন চোখে কম দেখি, বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারিনা, তাছাড়া নতুন নতুন শিক্ষক আসায় বাচ্চারা এখন আমার মতো বুড়ো মানুষের কাছে পড়তে আসেনা। বাড়ি বসে করবো কি বল বাবা, তাছাড়া তোর চাচি অসুস্থ্, ওর চিকিৎসার অনেক খরচ, তাই এ টংঘরে চা বেচি। চা টা দারুণ বানিয়েছি... খেয়ে দেখ? আর কি দেব, বিস্কুট? কলা খাবে?

চা খাওয়ার ইচ্ছা মিটে গেলেও না করতে পারে না রাশেদ। ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকে কী কঠিন পরিস্থিতি রশিদ স্যারকে আজ বাজারের এ ছোট টং ঘরে নিয়ে এসেছে।লজ্জায় মাটিতে মিশে যায় সে, আজ স্যারের অনেক ছাত্রছাত্রী আছে যারা তার মতো কড়া রুটিনের শিক্ষকের বেত পিঠে সয়েই মানুষ হয়ে উঠেছে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবু আজ স্কুল কাঁপানো স্যারের এ অবস্থা! বড় অপরাধ বোধ জাগল তার মনে।
অনেকদিন পর পুরোনো ছাত্রকে কাছে পেয়ে মন উজাড় করে গল্প বলা শুরু করল মাস্টার। তা রাশেদ, তুমি কী চাকরি কর? একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে, স্যার। বদলির চাকরি, কাজের তাগিদে আজ ঢাকায় তো কাল চিটাগং, পরশু রাজশাহী। বিদেশেও যেতে হয় মাঝে মাঝে-জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা সবখানে। এজন্য বাড়িতে খুব একটা আসতে পারিনা। ভালো তো। চোখ দুটো জলে চকচক করে উঠল তার। চায়ের কেটলিটা সজোরে আঁকড়ে ধরল। চায়ে চুমুক দিতে মাষ্টার বললেন, কাজকর্ম যা করবে, ভালভাবে করবে, অনেস্টি বজায় রাখবে অলওয়েজ। রাশেদ মাথা নাড়ে। থেকে থেকে চমৎকার ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা বলা রশিদ মাষ্টারের পুরনো অভ্যাস।

স্যার রাজুর খবর কী, ও কী করে এখন। মুহূর্তে বিষণ্ণতায় ভরে গেল মাস্টারের মুখ। ও আর নেই, ও থাকলে হয়তো আজ আমাকে চা বেচতে হতোনা। স্কুল, কলেজে ভাল রেজাল্ট করল। ভাল ছাত্রের তকমা পেল। মনে হল আমার লাইনেই যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল বিষয় ভর্তি হলো, হলের সিট দখলের মারামারিতে একদিন ওর ডান হাতের কবজি কেটে নিল, চোখে এসিড মারল। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার কিছু দিনের মধ্যে আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেল। ওর মায়ের বুকভাঙা কান্না, আহাজারি পেছনে ফেলে লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে শুয়ে দিয়েছি, দাদির কবরের পাশে।

আগের দিন নেই। দিন পালটে গেছে। তোমরা যখন পড়তে, কোন শিক্ষক চায়ের দোকানে বসা থাকলে ছাত্ররা সেখানে ঢুকতে সাহস পেতনা। আজকাল শিক্ষকের পাশের টেবিলেই ছাত্ররা দলবেঁধে বসে চা খায়, রাজনীতির হাতিঘোড়া মারে, লুকিয়ে সিগারেট টানে, ঠোট চেপে মুচকি মুচকি হাসে। এসবও দেখতে হচ্ছে এ পোড়া চোখে, আগে যা কল্পনাও করতেও পারিনি। দুশ্চিন্তার কালোছায়ায় মাস্টারের মলিন মুখ ঢেকে যায়।


মেম্বার এর ছেলে গত বছর দিনদুপুরে স্কুল মাঠে সকলের সামনে শিক্ষক পেটাল, পরীক্ষার হলে নকল ধরার অপরাধে। কোন শাস্তি পেলনা, সে ছেলে এখন এলাকায় বিরাট নেতা। এখন আর বিদ্যা নাই, অবিদ্যায় ভরে গেছে। বুঝলে রাশেদ, তোমরা বই পড়তে, আর আমি পড়তাম তোমাদের মন। সবাই পারেনা, আমি পেরেছিলাম। তোমাদের সমস্যা হল তোমরা শিক্ষকদের শেখানো বিদ্যা শিখতে দেরি করলেও তাঁদের আচরণ, শেখানোর স্টাইল সহজে আয়ত্ব করতে।
হ্যাঁ স্যার, আমাদের ভেতরে নিহিত মেধা, শক্তিগুলো যা আমরা নিজেরা দেখতে পেতামনা, সেটা আপনি আমাদের দেখিয়ে দিতেন।
স্যার পরীক্ষায় আমিওতো ধরা পড়েছিলাম আপনার হাতে, জীবন থেকে ঝরে পড়েছিল একটি বছর, রাশেদ তার স্মৃতি থেকে সময়ের আস্তরণ মুছে ফেলে অতীতকে উদ্বারের চেষ্টা করে। আমি ঠিকই করেছিলাম, সেদিন যদি তোমাকে মাফ করে পুনরায় পরীক্ষায় অংশ নিতে দিতাম, তা হলে তুমি নকল করে জেনেশুনে যে ভুল করেছিলে, তার চেয়েও অনেক বড় ভুল হতো আমার সেটা। তোমার ওই এক বছরের কষ্টটা তোমাকে যে শিক্ষা দিয়েছে তা আরও অনেক বড় কষ্ট, বড় ভুলের মাসুল দেয়া থেকে হয়তো বাঁচিয়ে দিয়েছে। ভুলটা শোধরাতে পেরেছিলে বলেই তোমার আজকের এই ভাল চাকুরি, ভাল অবস্থান, তা না হলে ভবিষ্যতে আরো অনেক বড় ক্ষতি হতো। জীবনের অর্থ সাইক্লোস্টাইল করা কাগজের মধ্যে না খুঁজে তাকে জীবনের খেরোখাতাতেই খুঁজে নিতে হয়। এগুলো নতুন কথা নয়, তোমাদের ক্লাশেও অনেকবার বলেছি। কিন্তু নীতিশিক্ষা তোমাদের ছুঁতে পারেনি। রাশেদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
স্যার, আপনার পায়ে কী হয়েছে, খুড়িয়ে হাঁটছেন কেন? তা আর বলোনা, স্কুল অধিভূক্তির দাবিতে মহাসমাবেশে যোগদানের জন্য সে বার ঢাকায় গেলাম। মিছিল করলাম। আচমকা কোমরে পুলিশের বাড়ি, মনে হল হিমালয় পাহাড় চেপে বসেছে কোমরে, লুটিয়ে পড়লাম বৈশাখের তপ্ত রোদের পিচ গলা রাজপথে, মাথা ঘুরে পড়েছিলাম অনেকক্ষণ।
স্কুলটা অধিভুক্ত হলে কষ্টটা লাঘব হতো, বলে পুরু চশমাটা চোখ থেকে খুলে দুই চোখ ডলে চায়ের কেটলির ওপরে উড়া ধুসর ধোয়ার ভেতর দিয়ে দূরে আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মাস্টার। ফাইল নিয়ে কত জায়গায় ঘুরেছি। চিন্তা কর-মিঠাপুকুরে রাতের কোচে উঠে পরদিন সকালে ঢাকার গাবতলি। একরাশ বিরক্তি, অসহায়ত্ব আর রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে কেরানি থেকে অফিসারের টেবিলে টেবিলে ঘুরে বেড়ানো। একটানা পাঁচ বছর। ওদের মন গলেনি। যাক তোমার অনেক সময় নষ্ট হল। সন্ধ্যে বাসায় এস। তোমাকে দেখলে তোমার চাচি খুব খুশি হবে।

আজকে হয়তো সম্ভব হবে না, স্যার, অন্য একদিন আসবো, বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রাশেদ দাঁড়িয়ে পড়ল। স্যার কে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে পকেট থেকে পাঁচশত টাকা নিয়ে তাঁকে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই বললেন, দিতে হবেনা। অনেক দিন পর দোকানে একটু চা খেলে তার জন্য আমি টাকা নিতে পারিনা। তুমি কাল সন্ধ্যেয় বাসায় এসো। আমি সকাল সকাল দোকান বন্ধ করবো। ঠিক আছে স্যার, আসব।

ক্লাশ সিক্স-এ অঙ্ক পড়াতেন রশিদ মাস্টার। ছোটখাটো চেহারা, টাক পড়তে আরম্ভ করেছে।মানুষটির চরিত্র কোমলে-কঠিনে। টেবিলে স্কেল ঠুকতে ঠুকতে অঙ্ক পড়াতেন। ডাস্টার না থাকলে হাত দিয়েই ব্ল্যাকবোর্ড মুছতেন। এত সোজা করে জটিল অঙ্ক বোঝাতেন যে সবচেয়ে গাধা ছাত্রটিও তা বুঝতো।গুরুস্পর্শে নিতান্ত গোবর মস্তিস্কেও প্রাণের অঙ্কুরোদ্গম হতো।বিজ্ঞানের ক্লাসে ম্যাজিক দেখিয়ে যখন রসায়ন পড়াতেন, চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে, কখনও কখনও আবার একেবারে না তাকিয়ে এর জটিল সুত্রগুলো বোঝাতেন, তখন সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রটিও সোজা হয়ে বসে। এলাকায় মহাপণ্ডিত বলে খ্যাত। বেত এবং প্রেমের এক আশ্চর্য যুগলবন্দি তৈরির জন্য এলাকার মানুষ তাঁকে একাধারে ভয়, ভক্তি করতেন এবং ভালবাসতেন। তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞানকে কেবল ছাত্ররা নয়, অভিভাবকেরাও ভয় করতেন। সমঝে চলতেন। সময়ের ব্যবধানে শুধুমাত্র পেটের ভাতের তাগিদে চা বেচার কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত হলেও তিনি যে একজন আদ্যপানত শিক্ষক, তা ঢাকা পড়েনি।

রাজুর মা দেখ কে এসেছে। রাশেদ এসেছে। বস বাবা বস।ঘামতে ঘামতে একটা পুরনো কাঠের চেয়ারে বসে রাশেদ। এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল বাবা। তুমি তো গ্রামের কথা ভুলেই গেছো। এদিকে একটু উঁকিও দেওনা। ভাঙা খাটের উপরে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী মাস্টারে স্ত্রীর কাছে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে। চাচি ছোট মেয়েটাকে বলল রাশেদকে খাবার দেয়ার জন্য।রাশেদ বাসার চারিদিকে তাকায়। জীর্ণ, শীর্ণ। বাসা না বলে এক ফালি জমি বললেই হয়।
বুঝলে রাশেদ, রাজুর মৃত্যু শোকের কষ্ট সইতে না পেরে তোমার চাচি স্ট্রোক করে, পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী। সীমিত সামর্থ্যে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি নিজের মতো করে, লাভ হচ্ছেনা। সবসময় রাজুর কথা চিন্তা করে, ভুলভাল কথা বলে। আগে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে কিছু আয় উপার্জন করত। কিন্তু ছেলেটা মারা যাওয়ার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

আমার ডায়াবেটিস বেড়ে গেছে, আরো কত রোগ যে শরীরে বাসা বাঁধবে! চোখেও দিন দিন কম দেখছি। চশমা খুলে চোখ মুছে ফের চশমা পরে স্যার বলেন এই চোখ আর ভালো হবে না। শুধু দোয়া করবে— চোখ দুটো পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার আগে মেয়েটাকে যেন বিয়ে দিয়ে যেতে পারি। জীবনের কাছে এ ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।

লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল রাশেদ। একদিন যে শিক্ষক তার ছাত্রদের জীবনের সমস্যাগুলো মন দিয়ে শুনে, দেখিয়ে দিত ভবিষ্যতের পথনির্দেশ, সেই শিক্ষকের আজ কোন ভবিষ্যৎ নেই, নেই বর্তমান। শুধু বাঁচার জন্য বেঁচে আছেন, বা আংশিকভাবে বেঁচে আছেন। আজ তার মতো স্যারের অনেক ছাত্রছাত্রী আছে যারা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, তবু আজ স্যারের এই অবস্থা!
স্যার এটা আপনি রাখুন স্যার, মনে করুন এটা আমার গুরুদক্ষিণা...কয়েকটা পাঁচ শ টাকার নোট সসঙ্কোচে স্যারের হাতে গুঁজে দেয় রাশেদ।

আমার এ টাকার দরকার নেই রাশেদ! রশীদ মাস্টারের শুকে যাওয়া গলার কণ্ঠে দৃঢ়তা ঝরে পড়ে। দারিদ্র, বঞ্চনা, জরা, ব্যাধি তার অনেক কিছু হরণ করলেও আত্মমর্যাদা বোধে ভরাট সুদৃঢ় ও সজল কন্ঠস্বর কে চুরি করতে পারেনি। তোমরা যে যেখানে আছো, সুস্থ থাকো,ভালো থাকো, মাথা উঁচু করে থাকো। তোমাদের উন্নতিই আমার গুরুদক্ষিণা। একজন শিক্ষকের বড় পাওনা হলো ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও সন্মান। সেটা আমি পেয়েছি। তোমাদের কাছে আমার ক্ষোভ নেই, কারও কাছে আমার কোন অভিমান নেই।ডানের চোখে ফোটা ফোটা অশ্রু, বাঁয়ের চোখে হেসে হেসে কথা বলছেন, কথার মধ্যে কোথাও যেন একটা শান্ত বিষন্নতার ছোঁয়া।

বাইরে দমকা হাওয়া, ঘনকাল মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ, বিদ্যুৎ চমকানি, বজ্রের শব্দ। রাশেদের বুকের মধ্যে উথালপাথাল। টাকাগুলো ফেরত দিয়ে ভাঙা জানালার জং পড়া শিক ধরে বাইরে ঘন কালো সঙ্কুচিত মেঘলা আকাশের দিকে শুন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রশিদ মাস্টার। রাশেদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যান, কাল আসিস,আবার চা খাওয়াব।

অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রাশেদ দেখতে থাকে বয়সের ভারে ন্যুইয়ে পড়া এক শরীরের ভেতরে থাকা লড়াকু মনের দৃঢ়তা!