করোনা এবং প্রবাসের ঈদ

ঈদের গান ‘ঘুরে ফিরে বারে বারে ঈদ আসে ঈদ চলে যায়, ঈদ হাসতে শিখিয়ে, ভালোবাসতে শিখিয়ে ত্যাগের মহিমা শেখায়।’ সত্যিই তাই ঈদ মানে আনন্দ, খুশির দিন। ছোট থেকে বড়, ধনী থেকে গরিব সবার জন্য উৎসবের দিন। ৩০ দিনের রোজার পরে ঈদ আসে আনন্দ নিয়ে।

তবে এবারের ঈদ একটু আলাদা। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে এবারের ঈদ। মহামারির মধ্যে ঈদ উদ্‌যাপন খুবই অস্বাভাবিক। বিশ্ব থেমে গেছে। এরই মধ্যে আমরা রোজা করলাম। ঈদও করলাম। বন্দী দশার মধ্যে ঈদ! অনেক কিছু অনুধাবন করা গেল। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি–কান্না, জীবনবোধ সবই বোঝা গেল। এই উপলব্ধি আমার মতো আরও অনেকেরই হয়েছে। সময় যে একরকম থাকে না। জীবন যে এক সরলরেখায় চলে না। অনেকটা Mathematics–এ সাইন বা কোসাইন থিটার মতন। তিন বছরের প্রবাসজীবনে ঈদ করলাম দুটি।

দেশের ঈদ আর প্রবাসের ঈদ অনেক আলাদা—এটা স্বীকার করতে হবে। ঈদ মানে পরিবার, মা–বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার সঙ্গে উদ্‌যাপন করা।

জীবনের প্রতিটি ধাপে ঈদের আনন্দ একেক রকম। ছোটবেলার ঈদ ছিল জামা-কাপড়, জুতা বা ঈদ সেলামি, ঈদকার্ড, নানাবিধ সৃজনশীল কাজের মধ্যে সীমিত। প্রধান আকর্ষণ ছিল বারবার নতুন জামা আর জুতো পরে আয়নার সামনে ক্যাটওয়াক এবং ঈদ হোম ডেকোরেশন করা নিয়ে আমরা নিমজ্জিত থাকতাম। বান্ধবীরা যখন জিজ্ঞাসা করত, ঈদে জামা-জুতো কিনেছি কি না? বলতাম, কিনেছি কিন্তু দেখাতে চাইতাম না। কারণ, তখন এটাই ধারণা ছিল দেখালে ঈদ পুরোনো হয়ে যাবে। কিংবা আমার মতন একই জামা কিনে ফেলবে, আর আমার জামা কেউ পছন্দ করবে না। তখন ঈদ ছিল সবার বাসায় বাসায় যাওয়া, সালাম করলে ঈদ সেলামি পাওয়া। সে একরকম মজার ঈদ ছিল। সব বান্ধবী ঈদের জামা পরে একসঙ্গে হওয়া, পটকা ফোটানো, রিকশায় করে ঘোরাঘুরি করা। একেকজনের বাসায় একেকটা খাবার খাওয়া, হাসি মজা ইত্যাদি করাই ছিল বড় আনন্দের। এখন সবই মিস করি। আম্মির কথা মনে পড়ে, কত কিছুই না তিনি রাঁধতে জানেন। আমি অনেক রান্না শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। আমাদের বাসায় ঈদের দিন সেমাই, ফিরনি, চটপটি, পাকন পিঠা, পুডিং, নুডলস, মুরগির রোস্ট, গরুর ঝাল ভুনা, পোলাও, খিচুড়ি সবই রান্না হতো। আশপাশের প্রতিবেশীরাও ঈদে আমাদের বাসা আসত। আমার আম্মির রান্নার সুনাম ছিল। এখনো আম্মি ঈদে নিজ হাতে রান্না করে থাকেন।

এবার আসি শ্বশুরবাড়ির ঈদের কথায়। চট্টগ্রামের ঈদ মানে এক বিশাল আয়োজন। ঈদের দিন শাশুড়ি মা ফিরনি, পায়েস, জর্দা, গরুর ঝাল, গরুর কালা ভুনা, চিংড়ি রোস্ট, মুরগির নানা প্রকার মুখরোচক রান্না করে থাকেন। আমি অনেক রান্না তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। আমার রান্না সবাই খুবই পছন্দ করে। মনে পড়ছে রোজা এলে নানান কাজের ফাঁকে নতুন নতুন রান্নার রেসিপি দেখতাম। এখনো দেখি। রান্না যে একটা বড় সৃজনশীল কাজ, সেটা ছোট থেকে বড় সবাই জানেন। ঈদে সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য নানা রকম পদ রান্না করে হাত পাকিয়ে ফেলেছি। শ্বশুরবাড়ির সবার কাছ থেকে অনেক প্রশংসা পেয়েছি। আমার শ্বশুর মশাই সব সময়ে আমাকে একশয়ে এক শ এক নম্বর দিতেন। আমি সব সময়ে জিজ্ঞেস করতাম, ‘এক শ এক কেন বাবা?’ বাবা বলতেন, এক শ হলো ভালো হয়েছে, আর এক হলো তোমার জন্য দোয়া। এই হলো একরকম ঈদ।

এবার আসি নিজের ঈদ যাপনের কথায়। ঠিক মনে পড়েছে কোনো এক ঈদে বাসের টিকিট না পাওয়ায় ঢাকায় ঈদ করতে হয়েছিল। সে ঈদে মন খারাপ হয়ে গেছিল। কিন্তু আমার মন ভালো করার মতো দুজন বান্ধবীর কথা না বললেই নয়। একজন আমার কফি বান্ধবী শাহরিন আর আরেকজন সাদিয়া। ওরা না থাকলে ওই ঈদ ভালো হতো না। আমার এই দুজন বান্ধবী ঈদের দিন সপরিবার এসে আমাদের সত্যি অনেক আনন্দ দিয়েছিল। প্রবাসে এসেও ওদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ঈদে কী কী রান্না করেছিলাম, তা নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণা করা হয়।

প্রবাসে ঈদ মানে যাঁরা প্রবাসে থাকেন তাঁরাই ভালো জানেন। কতটা নিরুপায় হয়েই আমরা ঈদ করি। এখানে কোনো ছুটি নেই । ঈদের নামাজ নিজেদের মতো পড়েন সবাই। হয়তো অনেকেই মসজিদে যায় ঈদের নামাজ পড়তে। কোনো একটা ছুটির দিনে সবাই মিলে ঈদ পুনর্মিলন আয়োজন করে আনন্দ ভাগাভাগি করেন প্রবাসীরা।

আমাদের প্রবাসজীবনে প্রায় তিনটি বছর চলছে, এখন অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে, কত পরিকল্পনা ছিল এবারের ঈদ নিয়ে, নতুন বন্ধুদের বাসায় যাব এবং তাদের আমন্ত্রণ জানাব। কিন্তু মহামারি যেন সব পণ্ড করে দিল। তারপরও ঘরে থেকে নিজেদের মতো ঈদ করলাম। নানা রকম রান্না করলাম, যদিও তেমন কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না।

এবারের ঈদ অনেক সাদামাটা হয়েছে, কিন্তু আমরা অনেক আনন্দের সঙ্গে করেছি, যা হয়তো কখনোই ভাবতে পারিনি। করোনা মহামারির মধ্যেও যে সবাই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে, এটা আসলেই বড় প্রশংসনীয়। হয়তো কোনো একদিন মহামারি চলে যাবে, কিন্তু যাওয়ার সময় সবার হৃদয়ে ভালোবাসা ভরিয়ে দিয়ে যাবে।