যুক্তরাজ্যে করোনা ক্রান্তিকালে মানবিকতা

করোনায় সবচেয়ে জীবন দিয়ে বেশি কাজ করছেন চিকিৎসকেরা। সেই ছবি এঁকেছে ফাইয়াজ। ছবি: সংগৃহীত
করোনায় সবচেয়ে জীবন দিয়ে বেশি কাজ করছেন চিকিৎসকেরা। সেই ছবি এঁকেছে ফাইয়াজ। ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারিতে অনেকটাই বদলে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন। থমকে গেছে চিরচেনা পৃথিবী। থেমে গেছে নাগরিক কোলাহল, কমে গেছে দূষণের মাত্রা। প্রাণ খুলে হাসতে ভুলে গেছে পৃথিবীর মানুষ। প্লে-গ্রাউন্ডে গিয়ে খেলতে ভুলে গেছে শিশুরা। 

সমাজবিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, কোভিড-১৯–এর ফলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে মানুষের মনোজগতে। আতঙ্ক গ্রাস করে নেবে মানুষের বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মনুষ্যত্বকে। মানুষ আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও অমানবিক হয়ে পড়বে। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মাত্রা যাবে বেড়ে। সুদূর অতীতের মহামারিগুলোর ইতিহাস কিন্তু তা–ই বলে।

২০২০ সালের করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে মানবিকতার উদাহরণও কিন্তু কম নয়। মানবসভ্যতার এই দুঃসময়ে অনেক বেশি মানবিক আচরণ করছে পৃথিবীর মানুষ। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কাজটি করে যাচ্ছে সম্মিলিতভাবে। উন্নত দেশগুলো করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের সঠিক পথ খুঁজছে অবিরাম।

সামাজিক নিরাপত্তা আর মানবিক দেশ যুক্তরাজ্য। তাই এ দেশে মহানুভবতা ও মানবিকতা চর্চার শিক্ষা শুরু হয় খুব অল্প বয়স থেকে। শিশুদের স্কুলের পাঠ্যসূচিতেই রয়েছে মানবিকতার পাঠ। কোভিড-১৯ যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই বিভিন্নভাবে মানুষের এই মানবিক গুণাবলি প্রকাশ পেয়েছে।

জীবাণুর সঙ্গে মানুষের এই যুদ্ধের প্রধান যোদ্ধা ডাক্তার, নার্সসহ এনএইচএসের স্টাফরা। এখন পর্যন্ত প্রতিরোধ করার কোনো অস্ত্র আবিষ্কার না হওয়ায়, যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন জেনেও তাঁদের মানবিক দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি। মাসের পর মাস পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও বিন্দুমাত্র কর্তব্যে অবহেলা করেননি। যুক্তরাজ্যে ডাক্তার, নার্সসহ এ পর্যন্ত প্রায় ১৮৮ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তারপরও যখন করোনা মোকাবিলার জন্য এনএইচএস থেকে ভলান্টিয়ার আহ্বান করা হলো, অবসর থেকে পুনরায় কাজে এসে যোগ দেন ডাক্তার, নার্সসহ হাজারো কর্মী। চিকিৎসা পেশায় ফেরেন পার্লামেন্ট সদস্য। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করেন ৫ লাখের বেশি ১৮–ঊর্ধ্ব সুস্থ ব্রিটিশ নাগরিক।

পুলিশ, সিকিউরিটি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে ট্রেন ও বাসচালকেরাও তাঁদের কর্তব্য থেকে সরে যাননি। একে একে ২৯ জন সহকর্মীকে হারিয়েও থেমে থাকেননি বাসচালকেরা। কোভিড-১৯ মোকাবিলার ফ্রন্টলাইন ফাইটার এবং কি-ওয়ার্কারদের কর্মক্ষেত্রে চলাচলকে নিশ্চিত করতে দিবারাত্রি কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। 

লন্ডনের শিশু চিত্রশিল্পী ৭ বছরের আরওয়া রশিদ। অ্যাক্রিলিকে আঁকা তার এই চিত্রকর্ম ফেসবুক নিলামে দাম উঠেছে ৫০ পাউন্ড। ছবি বিক্রির অর্থ খরচ করা হবে বাংলাদেশের দুস্থ মানুষের সহায়তায়। ছবি: সংগৃহীত
লন্ডনের শিশু চিত্রশিল্পী ৭ বছরের আরওয়া রশিদ। অ্যাক্রিলিকে আঁকা তার এই চিত্রকর্ম ফেসবুক নিলামে দাম উঠেছে ৫০ পাউন্ড। ছবি বিক্রির অর্থ খরচ করা হবে বাংলাদেশের দুস্থ মানুষের সহায়তায়। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যের করোনার এপিসেন্টার হিসেবে লন্ডনে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে প্রথমেই বয়োবৃদ্ধদের সেলফ কোয়ারেন্টিনের সরকারি ঘোষণা আসে। এ সময় একধরনের অনিশ্চয়তা, দ্বিধা, অস্থিরতায় মানুষ প্যানিক বায়িং শুরু করে। শেলফগুলো খালি হতে থাকে নিমেষেই। ফলে সুপারমার্কেটগুলোতে দেখা দেয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ সংকট। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বয়োজ্যেষ্ঠরা ফিরে আসেন শূন্য হাতে। তোলপাড় শুরু হয় সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়। তখন প্রধান সুপারমার্কেটগুলো সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য ‘প্রায়োরিটি আওয়ার’ ঘোষণা করে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে শপিংয়ের জন্য বয়োবৃদ্ধরা প্রাধান্য পান। তাঁরা সহজেই প্রয়োজনীয় জিনিসটি কিনে বাড়ি ফেরেন। ঘরে থেকেও বেতন-ভাতা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও শুধু মানুষকে সাহায্যের মানসিকতা নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সুপারমার্কেট, কর্নার শপ, টেকআওয়ে রেস্টুরেন্টের কর্মীরা। যুক্তরাজ্যের ফুড সাপ্লাই নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।


২৩ মার্চ থেকে লকডাউনের অফিশিয়াল ঘোষণা এলে গৃহবন্দী মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। স্বেচ্ছাসেবীরা বাজার করে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটুকু করেন। দুই মাসের বেশি সময় ধরে গৃহবন্দী বয়োজ্যেষ্ঠরা যেন মানসিকভাবে ভেঙে না পড়েন, এ জন্য বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য পাঠানো হচ্ছে বেলুন এবং শুভেচ্ছা কার্ড।

ব্রিটেনের গ্রেট হিরো ক্যাপ্টেন টমাস মুর। ২০ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া শতবর্ষী এই ক্যাপ্টেন মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। করোনা মোকাবিলায় এনএইচএসকে দান করার জন্য ৯৯ বছরের ক্যাপ্টেন টম এক হাজার পাউন্ড ফান্ড রাইজিংয়ের টার্গেট নিয়ে তাঁর বাগানে ১০০ ল্যাপ হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন। মিডিয়ার কল্যাণে তাঁর এই উদ্যোগ বিশ্বের মানুষকে আলোড়িত করে। হু হু করে বাড়তে থাকে ডোনেশনের অঙ্ক। তাঁর শততম জন্মদিনে ক্যাপ্টেন টম ১০০তম ল্যাপ শেষ করার মাধ্যমে তাঁর ফান্ডে জমা হয় প্রায় ৩৩ মিলিয়ন পাউন্ড। ইয়র্কশায়ারের ফার্স্ট রেজিমেন্টের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ এই সুপার হিরোকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন টমের ফান্ডে বিশ্ব থেকে অর্থ জমা অব্যাহত থাকায় তিনি হাঁটা অব্যাহত রাখবেন।

শতবর্ষীয়ান বাংলাদেশি দবিরুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
শতবর্ষীয়ান বাংলাদেশি দবিরুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত


একইভাবে আরেক শতবর্ষীয়ান বাংলাদেশি দবিরুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের বাগানে ১০০ ল্যাপ হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন। দুই মাসের বেশি সময় ধরে আইসোলেশনে থাকা দবিরুল ইসলাম, রমজান মাসে রোজা রেখেই হাঁটার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। একটি চ্যারিটির জন্য ১ হাজার পাউন্ড ফান্ড রাইজিংয়ের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরুর ২৬ দিনে প্রায় ২০০ হাজার পাউন্ড জমা হয় তাঁর ‘জাস্ট গিভিং ডট কম’ ফান্ডে। ব্রিটেন ছাড়াও এই অর্থ বাংলাদেশসহ আর ৫০টি দেশের করোনায় আক্রান্তদের জন্য ব্যয় করবেন তিনি।


এদিকে, মানবিকতার আরেক নজির স্থাপন করতে চলেছেন লন্ডনের শিশু চিত্রশিল্পী ৭ বছরের আরওয়া রশিদ। অ্যাক্রিলিকে আঁকা তাঁর একটি চিত্রকর্ম ফেসবুকে নিলামে তোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ছবিটির দাম উঠেছে ৫০ পাউন্ড। আরওয়ার বাবা মামুনুর রশিদ ছবিটির দাম আরও বাড়বে বলে আশা করছেন। মমতা মাখানো কচি হাতে আঁকা এই ছবি বিক্রির অর্থ খরচ করা হবে বাংলাদেশের অসহায় দুস্থ মানুষের সহায়তায়।

আমরা যারা বিদেশে থাকি, তাদের স্বজন বলতে বন্ধুবান্ধব আর প্রতিবেশীরাই। সবাই নিকটতম প্রতিবেশীর খবর রাখতে চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন প্রয়োজনীয় সামগ্রী বা ওষুধ পৌঁছে দিতে। চারদিকে যখন অনেক পরিচিত জনের আক্রান্তের সংবাদ পাচ্ছিলাম, তখন পারিবারিক বন্ধুরা নিয়মিত টেলিফোনে বা ভিডিও কলে কথা বলেছেন, বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছেন ।


লাখো মানুষের প্রাণঘাতী এই অণুজীব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে মানুষ কতটা অসহায়। ভালোবাসা, সহমর্মিতা, মানবিকতা ছাড়া এই পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকা কতটা কঠিন। হানাহানির পৃথিবীতে কঠিন সময় না এলে মানুষের এই সুন্দরতম দিকটি দেখা হতো না। প্রত্যাশা করছি অতি দ্রুত এই আঁধার কেটে যাবে আর অটুট থাকবে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা।