সন্তান-শেষ পর্ব

ছোট, ছিমছাম টিনের বাড়িটি ঘুরে দেখছিল জিনাত। এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে সে। মিনহাজ হোসেন পুকুরঘাটে গেছেন পরিষ্কার হতে। গোসল করে চুল ছেড়ে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল জিনাত।

লাউয়ের মাচায় কচি লাউ ঝুলছে। আমগাছভর্তি মুকুল। বকুলগাছের নিচটা ফুল পড়ে গালিচা হয়ে রয়েছে যেন। চারপাশের বাতাসে বকুলের অপূর্ব সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ায় জিনাত। বাগানের এক পাশে ওটা কী? তাঁত না? হ্যাঁ, ছোট্ট একটা তাঁতই তো। সঙ্গে সুতাসহ বাকি সব সরঞ্জাম গোছানো আছে।

‘তয় এই তাঁতের শাড়িই কি স্যারে দিসিলেন আমাগে? কিডা বুনে?’ চিন্তাটা যে একটু জোরেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, তা আর খেয়াল নেই জিনাতের।
‘জে, উডা আমার, উডাতি আমি বুনি।’

কাছেপিঠেই মোটা, গম্ভীর কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল জিনাত। গাছের আড়াল থেকে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখ যে তাকে লক্ষ করছে, জিনাত সেটা খেয়াল করেনি। মাথা ভরা কোঁকড়া চুল, আর চিকন ফ্রেমের চশমার আড়ালে ঢাকা ওই চোখজোড়া দেখে নিজের ওড়নাটা আরেকটু টেনে নেয় জিনাত। দেখে হেসে ওঠে আগন্তুক:

‘হে হে, আপনে কি ডরাইলেন নিকি? আপনে জিনাত, আব্বার ছাত্রী, আব্বায় কইসেন আমারে। আমি মিজান, ভূত না! যে ডরাইসেন, মা গো মা!’

কথার ধরনে মজা পেলেও, লজ্জা পায় জিনাত। মুচকি হেসে ওখান থেকে পড়িমরি পালায় সে।

সে রাতে ভুনা খিচুড়ি রান্না করে জিনাত। সে থাকতে মিনহাজ হোসেন রান্নাঘরে যাবেন, ব্যাপারটা একটু কেমন দেখায় না? তিনজনে প্লাস্টিকের টেবিলে খেতে বসে তারা।

‘মিজানে খিচুড়ি খাতি ভালোবাসে রে, তুই কি জানতি নিকি?’

প্রশ্নে মিজানের দিকে আড়চোখে তাকায় জিনাত। সত্যিই সে বেশ চেটেপুটে খাচ্ছে:
‘না গো স্যার, পাকঘরে মালসামান সব হাতের কাসে পালাম তো, তাই রানসি।’

মিজান খেয়ে উঠে গেলে মিনহাজ হোসেন জিনাতকে অনেক গল্প শোনালেন। মিজানের মায়ের গল্প, ছোটবেলার দুষ্টুমির গল্প ইত্যাদি নানা কিছু। ঘুরে ঘুরে দেখালেন পারিবারিক লাইব্রেরি, শোপিস।

যে ঘরে জিনাতকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, সেখানে পৌঁছে একটু অবাক হলো সে। সবকিছু এমনভাবে সাজানো, যেন এক্ষুনি সেই ঘরের মালকিন এসে হাজির হবেন:
‘এইহানে থাহে কিডা, স্যার?’

জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মিনহাজ: ‘থাহে না গো মা, থাকত, মিনু, আমার মিনারা।’

‘উনি, উনি কহনে আসেন?’

মিনহাজ হোসেন এবারে জিনাতকে নিয়ে গেলেন ঘরের এক কোণে। বের করে দেখালেন ফ্রেমবন্দী স্টুডিওতে তোলা যুগল ছবি। ছবিটা দেখে আঁতকে উঠল জিনাত। ছবির বধূটির বয়স তার চেয়ে সামান্য একটু বেশি। মুখটায় মিজানের মুখটি হুবহু কেটে বসানো, তবে গায়ের রং আর গঠন মিজানের মতো নয়, বরং অনেকটা জিনাতের মতো। আর ওই বিয়ের বেনারসি জড়ানো মিষ্টি হাসির মেয়েটির পাশে, বর বেশে...
‘ও স্যার গো, এই ইবলিশের বাচ্চাডা...’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল জিনাত।

‘নাজমুলের লগে আমার মিনুর বিয়া দিসিলাম। আব্বাস আলীর মিডা কথায় আমিউ ভুলসিলাম গো মা। মিজানে এত্ত মানা করসিল, কিসসু শুনি নাই...’

‘তো, মিনারা আফায় কই আসে, স্যার?’

‘আব্বাস আলী তার পুতের জন্যি পাঁচ লাখ টাকা আর এটা মটরসাইকেল যৌতুক চাইসিল, আমি তহন দিবার পারি নাই গো মা, তাই বাপে-পুতে মিলা বাঁশের লাঠি দিয়া পিডাইয়া মিজানের আধা ঘণ্টার বড় বইনডারে...’ টলতে টলতে বসে পড়লেন মিনহাজ হোসেন।

অন্যদিকে ফাতেমা এখন ইচ্ছা করেই একটু বেশি সময় কাটায় জিনাতের বাড়িতে। আমেনা বেগমের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কাজ করে দেয় ফাতু। জিনাত প্রতি শুক্রবার, শনিবারে মিনহাজ হোসেনের লাইব্রেরি থেকে বই এনে দেয় ফাতেমাকে। ছুটির দিনগুলো আব্বা-আম্মার বুকেই থাকে জিনাত। শরিফা-জামালের গাছের আম, কাঁঠাল পাকলে পৌঁছে যায় মিনহাজ হোসেনের বাড়ি। আবদুল করিম ফাতেমার হাতের কাজ আর জিনাতের খাবার নিয়ে প্রতি সপ্তাহে হাটে বসে। পুতুল, কাঁথা ইত্যাদি থেকে সপ্তাহে অন্তত ৮০০ টাকা পায় দুই বান্ধবী। যে টাকা ওদের বই–খাতার খরচ জুগিয়ে কিছুটা সংসারের কাজেও লাগে। করিমের সঙ্গে আক্‌দ হয়ে আছে ফাতেমার, এইচএসসির পরে বউ ঘরে তুলবে করিম।

জিনাতের আচার, পাঁপড় এত সব মজার মজার খাবার ভোজনরসিক মিজানের পেট পার হয়ে অজান্তেই মন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, মনের সেই ডাকে জিনাতও সাড়া দিয়েছে। মিজান এখন জিনাতকে কলেজ পৌঁছে দিয়ে তবে কাজে যায়। মিনহাজ হোসেন স্কুলের হেডস্যারের কাজ শেষ করে বাকি অবসর সময়টুকু ইদানীং জিনাতকে পড়িয়ে, আর নয়তো ফাতেমার জন্য নোট তৈরি করে দিয়ে কাটান তিনি। রান্নার বাইরে এখন মিজানের কাছে তাঁতের কাজও শেখে জিনাত। মাঝেমধ্যে আমেনা-আনোয়ার, শরিফা-জামাল মেয়েদের নিয়ে কাছের হলে সিনেমা দেখতে যান। সঙ্গে মিনহাজ আর মিজানও থাকেন অবশ্যই।

জিনাত-ফাতেমার খাবার আর হাতের কাজ এখন গ্রাম ছেড়ে শহরেও পৌঁছে গেছে। দুই গ্রামের দুই প্রান্ত থেকে দুই স্বামী তাঁদের স্ত্রীদের কাজের প্রচার-প্রসার বাড়াচ্ছেন। তবে মিজানকে হাজার বলেও তার হাতের করা দৃষ্টিনন্দন তাঁতের শাড়ি বিক্রি করাতে পারেনি জিনাত। মিজান আগে শাড়ি বুনত কেবল মিনারার জন্য, এখন বোনে কেবল দুই পরিবারের জন্য। এই কাজ বাড়ির বাইরে যায় না।

দুই বছর পর
সদর হাসপাতালের বাইরে দুই পরিবার শুধু নয়, গোটা দুই গ্রামের প্রায় সব মানুষের ঢল। আর ভেতরে ডাক্তারের পরিচর্যায় জিনাত। বাবা হতে চলেছে মিজান, মিনহাজের চোখে–মুখেও কিছুটা আতঙ্ক আর উচ্ছ্বাস, দাদা হবেন তিনি। মায়েরা, বাবারা প্রার্থনায় রত। অস্ত্রোপচারকক্ষের লাল আলো জ্বলছে তো জ্বলছেই। করিম একটু আগে গিয়ে রক্ত দিয়ে এসেছে। আরও কিছুক্ষণ পর খুলে গেল দরজা। ডাক্তার আর নার্সের হাতে ছোট ছোট দুটো গোলাপি তোয়ালের পুঁটলি, যার ভেতর ছোট ছোট দুটো গোলাপি মুখ:

‘দেহ রে, মিজান বাজান, তুমার দুইডা পুতুল।’ ডাক্তারের মুখভরা হাসি।

সদ্যোজাত মেয়ে কোলে নেওযার আগে মিজানের প্রশ্ন: ‘আমার বউডা ঠিক আসে তো, না?’

‘চলো যাই, জিনাতে রে দেইখা আসি গা ।’

জিনাতের অজ্ঞান অবস্থা কাটার পরই দরজা খুলেছেন ডাক্তার, তাই একটু দেরি।

দুই যমজ কন্যার একটিকে জিনাতের পাশে শুইয়ে দিয়ে অপরজনকে মাথার ওপর তুলে নিল মিজান: ‘আর ইডা তো আমার না রে... ইডা ... ইডা ... এই ধর ফাতু।’

হইহই করে ওঠে ফাতেমা, ‘আরে, কী করেন মিজান ভাই?’

জিনাত দুর্বল কণ্ঠে বলে: ‘এটা আমার, এ টা তোর। উডা রে তুই মানুষ কর, তালি দুনিয়া তোরে আর বাঁজা কবার পারবি না। কিডা কইসে, মা হতি গেলি জন্ম দিতিই হবি?’

নবজাতক ততক্ষণে ফাতুর আঙুল নিজের মুঠোবন্দী করেছে। দেখে হাসে ফাতেমা, ‘হে, এইডা আমার বুজান, আমার মা, এইডা আমার খুকু।’

বহুদূর থেকে যেন ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় কচিকণ্ঠের ডাক, ‘বু!’

আব্বাস আলী আর নাজমুল আলীকে পাঠকের কাঠগড়ায় তুলে দিলাম। আপনারাই বিচার করুন এই দুজনের। সমাপ্ত
[email protected]

আরও পড়ুন:
সন্তান ৭