কোভিডে কেন পুরুষের মৃত্যুহার বেশি

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

কোভিড-১৯ আক্রমণের ক্ষেত্রে অথবা আক্রমণের তীব্রতার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করে না এমন কথা প্রচলিত থাকলেও কথাটি মানা কষ্টকর। বয়স, শ্রেণি, বর্ণ, পূর্বস্বীকৃত স্বাস্থ্য পরিস্থিতি (উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে হাইপারটেনশন বা ডায়াবেটিসের মতো রোগ যাদের রয়েছে), ভৌগোলিক অবস্থান, স্থানীয় আবহাওয়ার অবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে কিছু কিছু মানুষকে কোভিড-১৯ অনেক বেশি দুর্বল করে তোলে, এ কথাটি অনেকাংশেই প্রমাণিত। এ ছাড়া ঘনবসতি পূর্ণ শহরে বসবাসকারী, যাদের পেশাগত কারণে খুব কাছাকাছি অবস্থান করে কাজ করতে হয় এমন লোকজনের সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি। আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন দেশ কতটা সফলতার সঙ্গে, সাবধানতার সঙ্গে এই ভয়াবহ মহামারি মোকাবিলা করছে, তার ওপরও অনেকটাই নির্ভর করছে।

সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটা ক্ষেত্রে কোভিড-১৯–এর আক্রমণ অথবা প্রাণ সংহারের ক্ষেত্রে অনেক বড় একটা ব্যবধান তৈরি করছে যা হলো লিঙ্গভেদে মৃত্যুহার। যদিও এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশেরই পরিষ্কার কোনো ডেমোগ্রাফিক সার্ভেলেন্স প্রকাশ করেনি (হয়তো অনেক কিছুই এখনো বিশ্লেষণাধীন) তবু এ কথা বলাই যায় যে পৃথিবীব্যাপী করোনাভাইরাসে পুরুষের মৃত্যুহার নারীদের তুলনায় অনেকখানি এগিয়ে।

এখন পর্যন্ত এই ফেনোমেননটি কোনো বৈজ্ঞানিক যৌক্তিক কারণ দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। অনেক ধরনের গবেষণাই এখন হয়তো চলছে এবং আমরা খুব সহজেই জানতে পারব এর অন্তর্নিহিত কারণ। তবে এখন পর্যন্ত এর বিশেষ কোনো কারণ অজানাই রয়ে গেছে। ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীদের একই রকমের আক্রান্তের ধরন রয়েছে। পৃথিবীজুড়ে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষেরা তুলনামূলক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এমনকি বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়েই নারীদের তুলনায় পুরুষদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।

উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে পুরুষ সমাজসেবা কর্মীদের কোভিড-১৯–এ মৃত্যুহার প্রতি ১ লাখে ২৩ দশমিক ৪ হলেও তাদের নারী সহকর্মীদের জন্য এই মৃত্যুহার মাত্র ৯ দশমিক ৬। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৫৫৯ জন (কয়েক দিন আগের হিসাব, ২ জুন পর্যন্ত ৭০৯) মৃত করোনা রোগীর কতজন পুরুষ এবং কতজন নারী, তা পরিষ্কারভাবে জানা না গেলেও দৈনন্দিন আপডেটে জানা যায় নারীদের তুলনায় পুরুষদের মৃত্যুহার অনেক বেশি। বাংলাদেশে আক্রান্ত এবং মৃত্যুহারে উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষের হার শতকরা ৬০-৭৫ ভাগের ওপরে।

পুরুষদের জন্য বৃহত্তর মৃত্যুর ঝুঁকি মহামারিটির প্রথম পর্যায়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন চীনে পুরুষেরা উচ্চ হারে মারা যাচ্ছিল। ২৯ এপ্রিলের ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় চীনের উহানে প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকে মারা যাওয়া কোভিড-১৯ রোগীর ডেটা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই দলে নারীদের তুলনায় পুরুষদের মারা যাওয়ার সংখ্যা ছিল ২ দশমিক ৪ গুণ বেশি। গবেষণায় বলা হয়েছে, যদিও পুরুষ ও নারীদের আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে একই সংবেদনশীলতা ছিল, তবে তুলনামূলক পুরুষেরা মারা যাওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এই প্যাটার্নটি মনে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখন নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে—যদিও কিছুটা আলাদা ধরনে এবং দেশে দেশে কিছুটা ভিন্ন সংখ্যায়। উদাহরণস্বরূপ, নিউইয়র্কে ৫ মে পর্যন্ত হিসাবে, ১৯ হাজার ৯৬০–এর ওপরে মৃত সংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি পুরুষ। যেহেতু ইতিমধ্যে আরও বেশি দেশ থেকে আরও ডেটা যোগ হচ্ছে, প্যাটার্নটি এখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯–এ সংক্রমণের ঝুঁকি লিঙ্গভেদে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গড়ে একই রকম হলেও তার ফলে মৃত্যুর হার অনেকটাই আলাদা।

গ্লোবাল হেলথ ৫০/৫০–এর ১১ মের রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীর ১০টি দেশের (সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যু) নারী-পুরুষ মৃত্যুহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারী: নারী মৃত্যুর তুলনায় পুরুষ: নারী মৃত্যু সব দেশেই অনেক বেশি। বয়সভেদে এই অনুপাতের পার্থক্য থাকলেও বলতে গেলে সব বয়সেই পুরুষ: নারী মৃত্যুর অনুপাত অনেক বেশি। এটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলাই যায় যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।

এখন প্রশ্ন হলো কেন এই লিঙ্গভেদে পুরুষ-নারী মৃত্যুহারে বড় ধরনের ফাঁক? কেন মেয়েদের তুলনায় পুরুষেরা বেশি মারা যাচ্ছে? এর স্পষ্ট উত্তর এখনো নেই। মহামারির শুরুতে যখন চীনে প্রথম ধরা পড়ে যে পুরুষেরাই বেশি মারা যাচ্ছে তখন একটি প্রাথমিক তত্ত্ব দেওয়া হয়েছিল এমন যে পুরুষদের মধ্যে উচ্চ ধূমপানের হারই এর কারণ। পুরুষেরা সাধারণত নারীদের চেয়ে সিগারেট বেশি ধূমপান করেন এবং ধূমপান ধীরে ধীরে ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করে এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, ৫০ শতাংশেররও বেশি চীনা পুরুষ ধূমপান করেন, তবে ৩৫ শতাংশেররও কম চিনা নারী ধূমপান করেন বলে জানিয়েছে দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র।

আবার অন্যদিকে অন্যান্য দেশে পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে ধূমপানের হারের ক্ষেত্রে কোনো বড় পার্থক্য ছাড়াই একই রকম বা এমনকি আরও বড় ধরনের পুরুষ: মহিলা মৃত্যুহারে ব্যবধান লক্ষ করা গেছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত রোগীর ইতিহাস ঘেঁটে তাদের জীবদ্দশায় ধূমপানের কোনো ইতিহাস লক্ষ করা যায়নি। অন্যদিকে ফ্রান্সের গবেষকেরা কিছুদিন আগে এমন কিছু তত্ত্ব দিয়েছিল যে ধূমপায়ীরা করোনাভাইরাসের কম ঝুঁকিতে রয়েছে। পরে অবশ্য এর পক্ষে খুব একটা সমর্থন পাওয়া যায়নি।

গবেষকেরা কিছু পূর্ব-বিদ্যমান অবস্থার পাশাপাশি ইমিউনোলজিক এবং হরমোনজনিত কারণগুলোসহ বৃহত্তর পুরুষ সেক্সকেই দায়ী করে বিভিন্ন সম্ভাবনার প্রস্তাব করছেন। অনেকেই বলছেন জীববৈজ্ঞানিক কারণই একমাত্র করোনায় আক্রান্ত অধিক পুরুষ মৃত্যুর ব্যাখ্যা হতে পারে। এই প্রশ্নগুলোর প্রসঙ্গে একটি মূল ধারণা হলো পুরুষ ও মহিলারা যেভাবে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে সে ক্ষেত্রে লড়াইয়ের মেটাবলিক প্যাটার্নে বড় ধরনের জৈবিক পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নারী পুরুষের তুলনায় একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম। গবেষকেরা মনে করেন যেহেতু নারীদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকে এবং এক্স ক্রোমোজোম প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত বেশির ভাগ জিনকে ধারণ করে তাই তাদের রোগ প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়ার বিস্তৃত বৈচিত্র্য রয়েছে পুরুষের তুলনায়।

এ ক্ষেত্রে রোগতত্ববিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা আরেকটি সূত্র দিয়েছেন। পুরুষের আচরণগত বৈশিষ্ট্য নারীদের তুলনায় পুরুষ মৃত্যুহারের জন্য দায়ী হতে পারে। সাধারণত পুরুষেরা নারীদের তুলনায় বহির্গামী, কম সাবধানী, বেশি সাহসী এবং বেশি আত্মপ্রত্যয়ী। এ কারণে তারা আক্রান্ত যেমন হচ্ছে বেশি তাদের আক্রান্তের তীব্রতাও বেশি।

করোনাভাইরাস
করোনাভাইরাস

‘সিএনএন’-এর একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ইতালি ও চীনে পুরুষদের উভয় দেশের নারীদের চেয়ে উচ্চ রক্তচাপের হার বেশি। চীনা পুরুষদের তুলনায় চীনা নারীদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। এই দুই কারণে দুই দেশে পুরুষ মৃত্যুহার নারীদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এখন অবশ্য সেটা পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখা যাচ্ছে।

ইউরোপীয় ‘হার্ট’ জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে পুরুষদের প্লাজমাতে উচ্চ পরিমাণে অ্যানজিওটেনসিন-রূপান্তরকারী এনজাইম ২ (এসিই ২) থাকে, সম্ভবত তারা কোভিড-১৯–এর ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণ। ACE2 হলো হেলথি কোষগুলোর পৃষ্ঠে উপস্থিত একটি রিসেপটর। কোভিড-১৯–এর কার্যকারক এজেন্ট SARS-CoV-2 কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার জন্য এই রিসেপটরটি ব্যবহার করে। ACE2 রিসেপ্টরগুলো ফুসফুস, হার্ট, কিডনিতে প্রচুর পরিমাণে উপস্থিত রয়েছে। এই সূত্রটিকে প্রমানের জন্য আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

 অন্য এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন টেস্টোস্টেরন তৈরিতে সহায়তা করে এমন নির্দিষ্ট রিসেপটেরের কারণে উচ্চ টেস্টোস্টেরন স্তরগুলো পুরুষদের মধ্যে গুরুতর কোভিড-১৯–এর অবদানকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বৃদ্ধ বয়সে কম টেস্টোস্টেরন শ্বাসকষ্টের পেশিগুলোকে দুর্বল করতে পারে এবং ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে, দীর্ঘস্থায়ী হার্টের ব্যর্থতার সঙ্গে বয়স্ক পুরুষেরা টেস্টোস্টেরন থেরাপি পাওয়ার ক্ষেত্রে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে সুফল পেয়েছেন। এই প্রসঙ্গে কম টেস্টোস্টেরনের মাত্রা শ্বাসকষ্টের পেশিগুলোর ক্রিয়াকলাপ এবং সামগ্রিক শক্তি এবং ব্যায়ামের ক্ষমতা হ্রাস করে দিতে পারে, যখন সাধারণ টেস্টোস্টেরনের সঞ্চালন শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক কার্যকলাপকে সচল রাখে। তাই করোনায় আক্রান্ত বয়স্ক পুরুষের (সাধারণত ৫০–এর ওপরে) মৃত্যুর সঙ্গে টেস্টোস্টেরোনের সম্পর্ক আছে বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেছেন, আচরণগত, জৈবিক এবং হরমোনজনিত সমন্বিত কারণগুলোই কেন মহিলাদের চেয়ে পুরুষেরা করোনাভাইরাস থেকে মারা যাচ্ছেন তা ব্যাখ্যা করতে পারে। তাই লিঙ্গ অথবা বয়স, বাস্তবতা যেটাই হোক, মারাত্মক এই ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য আপাতত সামাজিক দূরত্ব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্পই বিশেষজ্ঞরা দেখছেন না। 

যেখানে সমস্যা সেখানেই কোথাও না কোথাও তার সমাধান লুকিয়ে থাকে। তবে তাকে খুঁজে বের করতে হয়। কে জানে, এই যে নারীদের তুলনায় করোনা আক্রান্ত পুরুষের সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার বেশি, এই বাস্তবতা থেকেই হয়তো কোভিড-১৯–এর মতো জীবননাশী ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তির সহজ কোনো উপায় বিজ্ঞানীরা পেয়েও যেতে পারেন। পৃথিবী অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বিজ্ঞানীদের দিকে। একটি সফল ভ্যাকসিন এবং তার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের দ্রুত চিকিৎসারও কোনো একটি উপায় এখন খুবই প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র, ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধ