আ ফেক স্টোরিটেলার

‘আমার গল্পটা শুনবেন প্লিজ?’

মেসেঞ্জারে আবার ভেসে ওঠে মেসেজটি। বিরক্ত বোধ করি কিছুটা। মেসেঞ্জারে বেশ কিছু মেসেজ আসে প্রায়।
অচেনা বা ফেক আইডি মনে হলে রিপ্লাই দিই না। নাম দেখেই বোঝা যায় এটাও ফেক আইডি। বেশ কিছুদিন ধরে জ্বালাচ্ছে।
‘আপনি কে, আমাকে মেসেজ দিচ্ছেন কেন? আর আপনার গল্পই–বা আমি শুনব কেন, আমি তো আপনাকে চিনি না।’
‘গল্পটা খুব খুব অচেনা কারও জন্য।’
‘আপনার পরিচয় না জানালে আর মেসেজ দেবেন না প্লিজ!’, বিরক্ত হয়ে বললাম।
‘তবে তো চেনা হয়ে গেলাম, গল্পের প্রয়োজনেই এটা খুব দরকার প্লিজ।’
এভাবেই শুরু গল্পের। ভেঙ্গে ভেঙ্গে, অনেক সময় নিয়ে, অনেক দিন ধরে।

হাসিখুশি মানুষ সালাম সাহেব। অনেক দিন পর আজ অফিসে এসেছেন। প্রাইভেট একটা এজেন্সিতে ছোটখাটো একটা চাকরি তার। অনেক দিন পর অফিস আসতে পেরে বেশ ভালোই লাগছে। ঘরে শুয়ে–বসে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলেন।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করা সালাম সাহেবের এই শুয়ে–বসে থাকাটা বেশ অস্বস্তিকর। তার ওপরে সাংসারিক অশান্তি তো আছেই। কাজ না থাকায় দুই মাসের বেতন পাননি তিনি। কোম্পানির বড় কিছু কাজ বাতিল হয়ে যাওয়াতে বেতন হয়নি। অবশ্য এটা নিয়ে আফসোস নেই তার, কোম্পানির আয় না থাকলে দেবে কেমনে। এই করোনার দুর্যোগে অন্তত তার চাকরিটা তো আছে। এর মধ্যে শুনেছেন মালিকের শালা মারা গেছেন করোনায়। শালার বউ নাকি ছিলেন বড় ডাক্তার, তবু অনেক দেনদরবার করেও হাসপাতালে একটা বেড পাননি। সারা রাত অ্যাম্বুলেন্সে এ হাসপাতাল ওই হাসপাতাল ঘুরে শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন। তারাও যে বেশ শান্তিতে আছেন, তা নিশ্চয় নয়। তাই বেতন না পেলেও বিমর্ষ নন তিনি।

বাড়িভাড়া নিয়েও সমস্যা হয়নি। সাড়ে চার বছর ধরে তিনি আছেন চৈতন্য গলির সরদারপাড়ায় ছোটখাটো দুই কামরার ঘরটিতে, স্ত্রী আর দুই মেয়ে নিয়ে। বাড়ির মালিক শিকদার ভাই লোক ভালো। স্ত্রী সালমার কানের দুল দুটো বন্দক রেখেছেন, কাজে ফিরলে আস্তে আস্তে ভাড়ার টাকাটা পুষিয়ে দেবেন, এই শর্তে। পরিবারের বড় একটা সম্বল ছিল দুল দুটো, বেচতে হয়নি ভাগ্যিস। বাজার করা নিয়ে যা একটু বিড়ম্বনা ছিল। তবু দুবেলা দুটো চাল ফুটিয়ে সালমা বেশ চালিয়ে নিয়েছে। বেলায় বেলায় চা খাওয়ার বাজে অভ্যাসটাও বন্ধ হয়েছে। সমস্যা কিছুটা ছোট মেয়েটাকে নিয়ে। মাছ-তরকারি ছাড়া ডাল–ভাত তার গলা দিয়ে নামতে চায় না। মা ভাত মেখে দিলে দৌড়ে আসে বাবার কাছে। হাসিখুশি সালাম সাহেব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যান, রাজ্যের বেদনা নিয়ে ব্যস্ততার ভাণ করে এড়িয়ে যান।
বড় মেয়ে নিতু মাশা আল্লাহ লক্ষ্মী। কোনো কিছুতেই তার কোনো অনুযোগ নেই। যা দেয় তা–ই নীরবে খেয়ে নেয়। কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই। পড়ালেখায়ও ভালো। ক্লাস এইটে বেশ ভালো করেছে। কদিন একটু বায়না করেছিল প্রাইভেট পড়ার। বান্ধবীরা নাকি সবাই পড়ে। পরে মায়ের ঝাড়ি খেয়ে আর রা করেনি। তবে সালাম সাহেব মনে মনে প্ল্যান করেছেন, অবস্থা একটু ভালো হলে মেয়েটার পড়ালেখায় একটু মনোযোগ দেবেন, এসএসসিতে অন্তত যেন ভালো কিছু করতে পারে। নিজে তো কিছু পারেননি জীবনে। মেয়ে দুটোই যে তাদের আশার আলো।
সালাম সাহেব জানেন, এ অন্ধকার ঘুচে যাবে। এই তো আর কটা দিন। তার ইনক্রিমেন্টটা গত বছর থেকে ঝুলে আছে। মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে, এ বছর ভালো একটা ইনক্রিমেন্ট হবে তার। কোম্পানির নতুন একটা পোস্টে তার চাকরি হওয়ারও চান্স আছে। ওই পদের জন্য বেশ কাঠখড়ও পুড়িয়েছেন। যদিও সার্কুলার হয়নি, জবের খুঁটিনাটি জেনেছেন। প্রতিদিন চাকরি শেষে গুলিস্তানে বন্ধু মঈনুলের কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে কোর্স করছেন, নিজেকে যতটুকু আপডেট রাখা যায়।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সামনে একটু শান্তির দিন দেখছেন। আশা আছে একটা বড় বাসা দেখবেন। বড় মেয়েটা রাতে পড়তে পারে না গাদাগাদির কারণে। একটা ছুটি ম্যানেজ করে কোথাও ঘুরতে যাবেন সবাইকে নিয়ে। সালমার কোনো সাধ-আহ্লাদ পূরণ হয়নি বিয়ের পর। এবার দূরে কোথাও যাবেন। সহকর্মীদের অনেকেই ইন্ডিয়া যায়, বেশ সস্তা নাকি। দুই সপ্তাহে মোটামুটি বেশ অনেক জায়গায় ঘোরা যায়, এমন একটা প্ল্যান আছে মনে মনে। কাউকে বলেননি। এটা হবে একটা সারপ্রাইজ, বউ–মেয়েরা খুশি হবে খুব।
আজকের সকালের অফিস প্রস্তুতিটা তাই বেশ ফুর্তিময় ছিল। সালমা তার প্রিয় ভাঁজ করা নীল শার্টটা নামিয়ে দিয়েছে আলমারি থেকে। আজ একটু আগেই বেরিয়ে পড়েছেন বাসা থেকে। হেঁটে যাওয়ার প্ল্যান। তিন মাইল রাস্তা এমন কি দূর! শুনেছেন বাসভাড়া বেড়ে গেছে, কম যাত্রী নিয়ে চলবে তা–ই। কী দরকার বেশি ভাড়া দিয়ে বাসে যাওয়ার। আর কদিন শুয়ে–বসে থেকে একটু হাঁটাহাঁটিও করা দরকার। অফিস বিল্ডিংটার নিচে এসে লাগোয়া ছোট্ট ফাঁকা কাঠের বেঞ্চিটাতে জিরিয়ে নেন। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে ওপরে যাওয়া ঠিক হবে না।
ঝিরঝিরে বাতাসে প্রাণটা তার জুড়িয়ে যায়। রোদের তেজ নেই তেমন। আহা, কত দিন তিনি সকাল–রাত কাজ করে গেছেন এই বিল্ডিংয়ে। সবার আগে আসেন, ফেরেন সবার পরে। কাজের মানুষ কম থাকায় সবার টুকটাক কাজগুলোও তাকে সারতে হতো। তাইতো এইবার নতুন পোস্টে লোক নেওয়া হচ্ছে। ছুটিছাটাও নেননি তেমন। ছুটি নিয়ে করবেনটা কী। এই তো ভালো, সবার সঙ্গে হাসিখুশিতে কাজ করে যাওয়া। সবার কাজে সাহায্য করে নিজে বেশ গর্বিতও তিনি। নাহ, যত যা–ই হোক, কাজটা তার শান্তিরই। বুকের ভেতর সেই প্রশান্তির রেশ নিয়েই এবার অফিসের দিকে পা বাড়ান।

অফিসে ঢুকতেই ডাক পড়ে স্যারের রুমে। কুশল বিনিময়ের পর স্যার জানান, সালাম সাহেবের চাকরিটা আর নেই। নতুন পোস্টে লোক নেওয়া হয়ে গেছে। ভালো ক্যান্ডিডেট, ইয়াং, এনার্জেটিক। অফিসের কাজেও বেশ পরিবর্তন আনা হচ্ছে, সব কম্পিউটারাইজড। সালাম সাহেবের তাই তেমন কাজ নেই। হাসিমুখে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসেন তিনি।

বিল্ডিং বেয়ে নিচে নামতে আবার হাঁপিয়ে যান সালাম সাহেব। নিচে এসে লাগোয়া ছোট্ট কাঠের বেঞ্চিটাতে বসেন আবার। রোদের তেজটা কেমন বেড়ে গেছে হঠাৎ। একটু জিরিয়ে এবার রাস্তায় নেমে পড়েন। এ রাস্তার শেষ কোথায়, জানা নেই তার।
গল্পের শেষে আর কোনো মেসেজ পাইনি। মেসেজের কোনো উত্তরও পাইনি।

সালাম সাহেবের মতোই মাঝ রাস্তায় হারিয়ে গেছে ফেক আইডিটা। মাঝেমধ্যে ভাবি, কে ছিল সে।
একদিন অন্ধকার ঘুচে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর সালাম সাহেব? নাকি সব না পাওয়াকে নিভৃতে মেনে নেওয়া নিতু?
নাকি স্রেফ কোনো গল্পকথক গল্প শুনিয়ে গেল হেলাফেলায়। কে জানে!
ইট-পাথরের এই ব্যস্ত শহরে কার সময় আছে একটা ফেক আইডির মানুষ খোঁজার।