অস্ট্রেলিয়ার করোনা জয়ের গল্প

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

মনে পড়ে, এই তো কয়েক মাস আগে চীনের উহানে যখন প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ল, মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল। ইতালিতে, ইরানেও পাওয়া গেছে বলে খবর আসা শুরু হলো। আমরা অফিসে বসে আতঙ্কিত হয়ে আলোচনা করছিলাম যে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস অস্ট্রেলিয়ায় আসা এবং দেশটাকে ধরাশায়ী সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কারণ, অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর অন্যতম মাল্টিকালচারাল ভূমিগুলোর একটি। যেহেতু এর জন্মলগ্ন থেকেই ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ এই মহাদেশটিতে আবাস গড়েছে এবং প্রতিনিয়ত গড়ছে, বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়াবাসীর আত্মীয়তার বন্ধন বহির্বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে এবং এ কারণে এখানকার বিমানবন্দরগুলোতে মানুষের আসা–যাওয়াও সর্বক্ষণ। এখানে চায়নিজসহ এশিয়ান কমিউনিটিও বেশ বড় এবং ইউরোপ, আমেরিকা ও মিডল ইস্টের বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাস। 

স্বাভাবিকভাবেই অস্ট্রেলিয়া এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রবেশের জন্য খুবই উপযোগী একটি দেশ। আর হলোও তা–ই! কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিপুলসংখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকে গেল। আর এরপরই আমরা দেখতে থাকলাম একটি দেশ কীভাবে নিজের জনগণকে রক্ষা করে:


১.
সরকারি দল, বিরোধী দল, সব স্টেট প্রধান, চিফ মেডিকেল অফিসার একসঙ্গে আলোচনায় বসলেন এবং সবাই এক হয়ে করোনা–যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনায় নেমে পড়লেন। কোনো ভেদাভেদ, মতভেদ থাকল না। সামনে তখন একটাই লক্ষ্য, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে।


২.
খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক বর্ডার বন্ধ করে দেওয়া হলো। অস্ট্রেলিয়ান ও স্থায়ী অস্ট্রেলিয়াবাসী যারা বিভিন্ন দেশে ছিল, তাদের দেশে ফেরার পর সরকারি তত্ত্বাবধানে ও সরকারি খরচে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলো দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য। কোয়ারেন্টিনে থাকা কয়েকজনের কাছ থেকে জেনেছি, হোটেলে তাঁদের রুম, ব্যবস্থাপনা এবং খাবারদাবার বেশ ভালো ছিল এবং পুরোটাই সরকারি খরচে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

৩.
প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই টেলিভিশনে লাইভে এসে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেন। তাদের এই সময় ঘরে থাকার গুরুত্ব, সোশ্যাল ডিসটেন্সের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে থাকলেন।


৪.
করোনাভাইরাসের কারণে যেসব কোম্পানি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, তাদের কর্মচারীদের সরকার থেকে বেতন দেওয়া শুরু হলো। যাঁরা চাকরি হারাবেন, তাঁদেরও সরকার থেকে টাকা দেওয়া শুরু হলো। মূলত মানুষ যেন এই কঠিন সময়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, সেটা নিশ্চিত করা হলো।


৫.
চিকিৎসক আর নার্সদের নিরাপত্তা এতটাই নিশ্চিত ছিল যে এখানে কোনো চিকিৎসক বা নার্সের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর এখন পর্যন্ত শুনিনি।


৬.
ইকোনমি রক্ষার্থে সম্পূর্ণ লকডাউন অস্ট্রেলিয়ায় কখনোই ছিল না। কিন্তু খুব কঠোর নিয়ম ছিল যে মানুষ শুধু কর্মস্থলে এবং নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বের হতে পারবে। রেস্টুরেন্ট, জিম, বার, ক্লাবসহ যেকোনো ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলো। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রী বাইরে শরীরচর্চা করার অনুমতি দিলেন কিন্তু সেটা হতে হবে সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনে। নিয়ম যখন যেটাই ছিল, সেটা পালনের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি ছিল আর মানুষও নিয়মগুলো পালনে বাধ্য হচ্ছিল।


৭.
আজ যখন আমি এই লেখাটা লিখছি, তখন অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ প্রদেশে নতুন কেস জিরো। সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ নিউ সাউথ ওয়েলসেও নতুন আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। দেশটির সুসংগঠিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা অধিকাংশ করোনা রোগীকেই সুস্থ করে তুলেছে। যদিও এখনো সবাই সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত নয় এবং সরকার থেকে এখনো কঠিন নিয়মকানুন চালু রেখেছে, তবু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই ভালো।
শুধু একটু সাবধানতা আর সরকার থেকে নেওয়া কিছু পদক্ষেপ একটি দেশকে বাঁচাতে পারে এই মহামারি থেকে। একটি জীবনের মূল্য অনেক বেশি আর সুচিকিৎসা প্রত্যেক নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার।