কোয়ারেন্টিনে স্বামীর পাগলামি

-মা, তোমার ছেলে কই? ওরে ফোন দিই ধরে না কেন?

-ওই হারামজাদার কথা আর বলিস না। হঠাৎ করে নতুন এক পাগলামি শুরু করছে। তা নিয়েই এখন সে ব্যস্ত।
-মানে কি!
-মানে কিছুই না। সকাল থেকে আমার শাড়ি-ব্লাউজ পরে ঘরের মধ্যে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটতেছে আর বলতেছে আমি ডানাকাটা পরি, আমি ডানাকাটা পরি।
-তুমি কি আমার সঙ্গে মজা করছ?
-অবশ্যই না। জানিস, সে এখন কী করছে? সে এখন রুমের দরজা বন্ধ করে নাচতেছে।
-নাচতেছে মানে!
-নাচতেছে মানে নাচতেছে। ফুল ভলিউমে গান বাজিয়ে নাচতেছে। আর চিৎকার করে বলতেছে, আমি ডানাকাটা পরি।
-মা শোনো, তোমাকে একটা সৎ পরামর্শ দিই। করোনার ভেজাল শেষ হলে তুমি তোমার ছেলেকে পাবনা পাঠানোর ব্যবস্থা কইরো। এই জিনিস আর ঘরে রাখা নিরাপদ না।
-কি যা তা বলছিস?
-না মা, আমি যা তা বলছি না। আমি একশত ভাগ শিওর ওর মাথায় কিঞ্চিত সমস্যা আছে।
-বাদ দে তো এসব। ওরে নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না।

-আচ্ছা ,তোমার ছেলেকে নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাব না। কিন্তু তোমার ছেলে যে দুই দিন পর পর আমার স্বামীরে উল্টা-পাল্টা বুদ্ধি দিয়ে মাথা আউলায়ে দেয়, তার কী হবে?
-কেন, ও আবার কী করছে?

-তোমার ছেলে এবার আমার স্বামীর মাথায় সেলিব্রেটি হওয়ার ভূত ঢুকায়ে দিসে। ওর কুবুদ্ধিতে তোমার জামাই এখন সারা দিন উল্টাপাল্টা সব ভিডিও বানাচ্ছে আর তা ইউটিউবে দিচ্ছে।
-তাই? কিসের ভিডিও বানাচ্ছে?
-আমি তোমারে লিংক পাঠাচ্ছি। তুমি নিজেই দেখ কি বানাচ্ছে। আর শোনো তোমার ছেলেকে এখন তাড়াতাড়ি আমার বাসায় পাঠাও। ওরে বলো, এসে ওর দুলাভাইরে সামাল দিতে। আমি আর এসব নিতে পারতেছি না।
-কিন্তু এখন এই করোনার সময় ও যাবে কীভাবে?

-সেটা আমি জানি না। ও যদি আগামীকালের মধ্যে আমার বাসায় না আসে, তবে আমি নিজেই বাসা ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ব।
-পাগলামি করিস না মা। তুই বরং ওর সঙ্গে কথা বল। দেখ যায় কি না।
-ঠিক আছে, তুমি ফোনটা ওরে দাও।


-সেটা সম্ভব নয়। ও দরজা বন্ধ করে নাচতেছে। আমাকে বলছে তিন ঘণ্টা নাচবে। এর মধ্যে তাকে বিরক্ত করা যাবে না। তুই বরং আবার ওর মোবাইলে ফোন দে।
সেতু আমার বড় বোন। খুবই রাগী। পরিবার নিয়ে উত্তরায় থাকেন। তার স্বামী একজন বিসিএস কর্মকর্তা। উনি খুবই সহজ-সরল বোকা টাইপের একজন মানুষ। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর আপার ফোন ধরলাম।

-ওই বদমাশ তুই ফোন ধরিছ না কেন?
-আপা জোরে বলো, শুনতে পাচ্ছি না।
-হারামজাদা তুই আগে গান বন্ধ কর। তাহলেই শুনতে পাবি।
তাড়াতাড়ি গান বন্ধ করলাম।

-ওকে এখন বলো। আচ্ছা একটু আগে তুমি আমাকে কি বলে ডাকলা? শাহাজাদা নাকি বাদশাজাদা?
-তোরে? তোরে আমি হারামজাদা বলে ডাকছি। কোনো সমস্যা?
- না, কোনো সমস্যা নাই। তুমি আমার বড় বোন। তোমার যা ইচ্ছা তাই তুমি আমারে ডাকতে পার। জন্মসূত্রে সেই অধিকার তুমি পেয়েছ। এই অধিকার তোমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও পারবে না।
-খবরদার আমার সঙ্গে মশকরা করবি না।
-আচ্ছা করব না।
-তুই এখন কী করছিস?
-কী আর করব। আমি এখন বাসায় বন্দী। মা মেইন দরজায় তালা লাগিয়ে রেখেছে। তাই বাইরে যেতে পারছি না। তা তুমি ফোন করেছ কেন?
-ফোন করেছি কারণ তোকে একটু আমার বাসায় আসতে হবে।
-সরি আপা, এখন আসতে পারব না। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। সেটা নিয়ে খুবই ব্যস্ত আছি।
-কিসের প্রজেক্ট?
-আমি নৃত্যচর্চা শুরু করেছি। বাংলা সিনেমার গানের সঙ্গে নৃত্যচর্চা। নাচের কোরিওগ্রাফার আমি নিজে। ঠিক করেছি নাচগুলো একটু আয়ত্তে এলেই ভিডিও করে ইউটিউবে দিয়ে দেব।
-মাই গড। ওই, তুই কি নাচ জানিস যে নাচের ভিডিও বানাবি?
-না, তা জানি না। তবে এটা কোনো সমস্যা না। কারণ বাংলা সিনেমার গানের সঙ্গে নাচার জন্য নাচ জানার কোনো দরকার নাই। শুধু গানের তালে তালে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ জোরে জোরে ঝাঁকাতে পারলেই হলো। আর মাঝেমধ্যে একটু দৌড়াতে হবে আর ছোট্ট করে একটা লাফ দিতে হবে। অর্থাৎ শরীর ঝাঁকাবা, একটু দৌড় দিবা এরপর ছোট্ট একটা লাফ দিবা। এরপর আবার শরীর ঝাঁকাবা। ব্যস হয়ে গেল।


-মাই গড! তাহলেই নাচ হয়ে গেল? ভেরি গুড। ইমু, তুই তো দেখি দিন দিন আরও মেধাবী হচ্ছিস।
-সবই আল্লাহর ইচ্ছা আপা। আমার জন্য দোয়া কইরো।


- এই, মা বলল, তুই নাকি মায়ের শাড়ি-ব্লাউজ পরে ঘুরছিস?

-ঠিকই শুনেছ। আসলে আজ আমি ‘আমি ডানাকাটা পরি আমি ডানাকাটা পরি' গানের সঙ্গে নাচ প্র্যাকটিস করছি। এখন তুমিই বলো, একটি পরি লুঙ্গি পরে নাচানাচি করছে, বিষয়টি দেখতে কি ভালো লাগবে? তাই মায়ের শাড়ি আর ব্লাউজ পরে নাচছি। নাচটা খুবই সুন্দর হচ্ছে। গত দুই ঘণ্টা ধরে রিহার্সেল করেছি। আরও এক ঘণ্টা করব। সবকিছু আন্ডার কন্ট্রোল। শুধু একটাই সমস্যা। কোমরটা একটু একটু ব্যথা করছে। আসলে কোমর ঝাঁকানোটা একটু বেশি হয়ে গেছে।

-শোন, তোর এসব ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই। তোকে আমার ভীষণ দরকার। তুই তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আয়।
পরদিন দুপুর বেলায় আপার বাসায় পৌঁছালাম। ময়না দরজা খুলে দিল। ও আপার বাসায় কাজ করে।
-কী ময়না, কেমন আছ?
-ভাইজান আমি ভালা আছি। কিন্তু আমাগো স্যারে ভালা নাই। আপা কইছে স্যারের মাথায় নাকি আবার সমস্যা হইছে।
-তাই নাকি? তা আপা কোথায়?
-বাথ রুমে। মাথায় পানি ঢালতাছে। স্যারের কামকাইজ দেইখ্যা আপার মাথা গরম হইয়া গেছে। তাই এট্টু পর পর আপা বাথরুমে যায় আর পানি ঢালে। আচ্ছা ভাইজান, কন তো মাথায় পানি ঢাললে কি আর স্বামী ভালা হইব? হইব না। শোনেন ভাইজান, আমার বিয়ার পর যদি আমার স্বামী এমন পাগলামি করে, তাইলে আমি কি করমু জানেন? লাঠি দিয়া তার মাথায় একটা বাড়ি দিমু।
ময়নার কথা শেষ হতে না হতেই আপা বাথরুম থেকে বের হলেন। আপার মাথার চুল ভেজা। এখনও দুই-এক ফোঁটা পানি মাথা থেকে গাল বেয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে। আমি আপাকে দেখেই বললাম,
-আপা কেমন আছ? তোমাকে না দেখতে নায়িকা অঞ্জু ঘোষের মতো লাগছে।


অঞ্জু ঘোষ আপার প্রিয় নায়িকা। ভেবেছিলাম আমার মন্তব্য শুনে আপা খুশি হবেন। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে রাগী রাগী চোখে আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন। তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে বুঝলাম, মাথা এখনো ঠান্ডা হয়নি। আরও পানি ঢালতে হবে। একটা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বললাম,
-আপা তুমি আবার বাথরুমে যাও। আমার ধারণা তোমার মাথায় আরও কিছুক্ষণ পানি ঢালতে হবে। তুমি বরং এক কাজ করো। বাথটাবটা পানি দিয়ে পূর্ণ করে তার মধ্যে ডুব দিয়ে থাকো।

তিনি এবারও কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি ধীর পদক্ষেপে এসে আমার পাশের সোফায় বসলেন। তারপর শান্তভাবে বললেন,

-ভাই তোর আল্লাহর দোহাই লাগে। তুই সত্যি করে বলত, আমি তোর কি ক্ষতি করেছি? তুই কিছুদিন পর পর কেন আমার স্বামীরে পাগল বানাছ?
-আমি আবার কী করলাম?
-কী করলাম মানে? তুই তোর দুলাভাইরে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে দিতে বলিসনি?


-বলেছি। আসলে উনি বললেন করোনায় বাসায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। আমার কাছে বুদ্ধি চাইলেন। আমি বললাম বেকার বসে না থেকে ভিডিও বানান আর ইউটিউবে দেন। সবাই তাই করছে। এতে সময়ও কাটবে আর আপনি ফেমাসও হতে পারবেন।
-ভাই, এ ছাড়া আর কোনো ভালো বুদ্ধি তোর কাছে ছিল না?


-এই বুদ্ধির সমস্যা কী? ইউটিউবের জন্য ভিডিও বানানো তো খারাপ না। এটা একটা ক্রিয়েটিভ কাজ।
-কিন্তু ওই ব্যাটা তো ক্রিয়েটিভ মানুষ না।


-আপা সব সময় মানুষকে আন্ডারইস্টিমেট করবে না। শোনো, কোন মানুষের মধ্যে কোন প্রতিভা লুকানো আছে তা কিন্তু বলা মুশকিল।
-না, ওর টা বলা মুশকিল না। কারণ ওর মধ্যে কোনো প্রতিভা লুকানো নাই। সে এখন যেসব ভিডিও বানাচ্ছে, তা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব না। আমার কথা হলো মানুষরে ফালতু বুদ্ধি না দিলে তোর হয় না? তুই এই বদ গুণ কই পাইলি?
-ওকে ধরে নিলাম আমার সব পরামর্শ ফালতু। কিন্তু প্রশ্ন হলো দুলাভাই কেন আমার ফালতু পরামর্শ গ্রহণ করে। সে তো একজন জ্ঞানী মানুষ, বিসিএস ক্যাডার।

-বিসিএস ক্যাডার? আরে ওর মেট্রিক পাস নিয়েই তো আমার সন্দেহ আছে। বাংলাদেশ সরকার যে কীভাবে এই বলদরে নিয়োগ দিল তাই তো আমার মাথায় ঢোকে না।
-আপা দুলাভাই কি নিয়ে ভিডিও করেছে?
-নিজেই দেখ সে কী নিয়ে ভিডিও করেছে। একটা ভিডিও যে কতটুকু পেইনফুল হতে পারে তা এই ভিডিও না দেখলে কেউ বুঝবে না।
আপা ভিডিও ছাড়লেন।
প্রথম দৃশ্য—দুলাভাই লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বিছানার ওপর বসে আছেন। উনি ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে সিনেমার নায়িকাদের মতো মুখ-চোখ-ভুরু নাচিয়ে মেয়েলি সুরে বললেন,
‘হ্যালো ফ্রেন্ড ওয়েলকাম টু মাই চ্যানেল। আমি এখন ঘুমাবো, খাটের উপর ঘুমাব। ঘুম অনেক ট্যাশ।’
এরপর উনি বিছানার উপর শুয়ে পড়লেন। কয়েক সেকেন্ড বিছানার উপর নাগিন ড্যান্সের মতো করে শরীরটাকে মোচড়াইলেন। তারপর আবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বললেন,
“এটা বালিশ, এটা কোলবালিশ, আর এটা বিছানার চাদর। এই সবই আমি নিজে কিনে এনেছি। এসব নিয়েই আজ আমি ঘুমাব। ঘুম অনেক ট্যাশ।’

এ কথা বলেই তিনি চোখ বন্ধ করলেন এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। একটু পরই উনি নাক ডাকা শুরু করলেন। অনেক ভয়ঙ্কর সে নাসিকা গর্জন।

সম্ভবত অনেকেরই মনে আছে, বেশ কিছুদিন আগে ইউটিউবে একটা ভিডিও খুবই ভাইরাল হয়েছিল। একটি মেয়ে তার ভাত খাওয়ার দৃশ্য ভিডিও করে ইউটিউবে দিয়েছিল। সে বিভিন্ন তরকারি দিয়ে ভাত খেত। আর বলত খুব ট্যাশ। দুলাভাই সম্ভবত সেই ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এই ভিডিও বানিয়েছেন। আপা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বল এটা কোনো কথা? বুইড়া এক দামড়া লুঙ্গি পরে নাক ডেকে ঘুমাবে আর মানুষকে সেটাই দেখতে হবে?
-আপা, বিষয়টি এত খারাপ হলে তো মানুষ দেখত না। ভিডিওটা ভাইরাল হতো না।


-শোন, এ দেশে যে কোন জিনিস ভাইরাল হবে তা বলা মুশকিল। কেন যে মানুষ এসব ফালতু জিনিস দেখে আমার মাথায় ঢোকে না।
-আপা তুমি যাই বলো না কেন, দুলাভাই কিন্তু ফেমাস হয়ে গেছেন।
-ফেমাস? তোর ফেমাসের মুখে ঝাটা মারি। তুই শুধু নিচের কমেন্টগুলো পড়। তাইলে বুঝবি মানুষ কীভাবে তাকে গালাগালি করছে।
আপা নিজেই আমাকে কমেন্টগুলো পড়ে শোনাতে লাগলেন।
‘বাংলাদেশে এক নতুন গাধার আমদানি হয়েছে।’
‘আরে এটা তো চিড়িয়াখানার মাল। এই মাল বাইরে কেন, সরকারের কাছে জবাব চাই।’
‘একে পাবনা পাঠানো হোক। বাসের টিকিট আমি দেব।’
‘হারামজাদা বোকা...(প্রকাশ অযোগ্য )...ভিডিও বানাইছে।’
‘এই শালারে ইউটিউবে ঢোকার ভিসা দিসে কে?’
‘প্রিয় দেশবাসী, এই বলদরে রাস্তায় যেখানে দেখবেন সেখানেই গণধোলাই দেবেন। খরচ আমার।’
‘পুরান পাগ...

-আপা থাক আর পড়তে হবে না। তা দুলাভাই এখন কোথায়?
- ছাদে। আজ নাকি সে ছাদের ওপর প্রখর সূর্যের নিচে ঘুমাবে। আর সেটা ভিডিও করবে। বল এই গরমে মানুষ যেখানে ঘরেই টিকতে পারছে না। সেখানে সে রোদের মধ্যে ঘুমাবে। এইটা কোনো কথা? ভাই প্লিজ, তুই একটু ছাদে যা। ওরে বুঝায়ে নিচে নিয়ে আয়।
-আপা ডোন্ট অরি। আমারে শুধু দুই মিনিট দাও। আমি এখনই দুলাভাইরে নিচে নিয়ে আসতেছি।
ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে গেলাম। ছাদে গিয়ে দেখি, দুলাভাই রোদের মধ্যে চাদর বিছিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আর আমার ১০ বছরের ভাগনি সে দৃশ্য ভিডিও করছে। ক্যামেরা বন্ধ করে দুলাভাইকে ডেকে উঠালাম। তিনি আমাকে দেখেই লাফিয়ে উঠলেন।
-ইমু আসছ? তোমারে ধন্যবাদ। জানো তোমার বুদ্ধিতে ভিডিও বানিয়ে আমি ফেমাস হয়ে গেছি। আর জানো এই ভিডিও বানানোতে কোনো কষ্ট নাই। জাস্ট ক্যামেরাটা অন করি আর ঘুমিয়ে পড়ি।
-দুলাভাই আপনি আসলেই একজন ট্যালেন্ট মানুষ।
-আফসোস, তোমার বোন সেটা বুঝল না। ইমু শোনো আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। এখন তুমি আর আমি একসঙ্গে ঘুমাব।
ময়না নিচে গিয়ে লুঙ্গি আর বালিশ নিয়ে এল। আমি লুঙ্গি পরে দুলাভাইয়ের পাশে বসলাম। দুলাভাই আমাকে প্রাকটিস করালেন কী বলতে হবে এবং কীভাবে বলতে হবে। দুবার রিহার্সেলের পর রেকর্ডিং শুরু হলো। প্রথমেই দুলাভাই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চোখ-ভুরু নাচিয়ে বললেন,
‘হ্যালো ফ্রেন্ড ওয়েলকাম টু মাই চ্যানেল। আমরা এখন শালা-দুলাভাই একসঙ্গে ছাদের ওপর ঘুমাব। অনেক ট্যাশ।’
এরপর উনি আমাকে ইশারা দিলেন বলার জন্য। আমিও চোখ-ভুরু নাচিয়ে বললাম,
এই যে চাদর, এই যে বালিশ, আর উপরে সূর্য। এসব নিয়েই আমরা এখন ঘুমাব। অনেক ট্যাশ।
এরপর দুজনে বিছানায় শুয়ে নাগিন ড্যান্সের মতো কিছুক্ষণ মোচড়া-মুচড়ি করলাম। তারপর দুজন চোখ বন্ধ করলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পেলাম দুলাভাই নাক ডাকছেন। আজব এক মানুষ। একটু পর অনুভব করলাম আমারও ঘুম পাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
জানি না কতক্ষণ ঘুমিয়েছি। হঠাৎ করে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। কারণ আমাদের শরীরে বিপুল পরিমাণ পানি ছুড়ে মারা হয়েছে। চোখ খুলে দেখলাম আপা ও ময়না দুজনে দুটি খালি বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম কর্মটি এরাই করেছেন।

আপা আমার দিকে ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর দাঁত কটমট করে বললেন,
-হারামজাদা তুই এখানে ঘুমাচ্ছিস? তোরে কি আমি এ জন্য ছাদে পাঠাইছিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোরা দুইটা নিচে নামবি, না হলে কিন্তু খবর আছে।

এ কথা বলেই আপা হনহন করে ময়নাকে নিয়ে নিচে চলে গেলেন। আপা চলে যেতেই দুলাভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ইমু তোমার বোন কি পানি মেরে আমাদের অপমান করল?
-দুলাভাই আপনি একজন শিল্পী মানুষ। আপনার তো মান-অপমান নিয়ে ভাবলে চলবে না। শিল্পচর্চা করতে গেলে অনেক বাধা আসবে। এটা কোনো ব্যাপার না।
-তুমি ঠিকই বলেছ। চল, তাহলে আমরা আবার ঘুমাই।
-না দুলাভাই, এখন আর ঘুমাব না। এখন আমরা একটা নাচের ভিডিও বানাব। এই ভিডিওতে নায়িকা আর নায়িকার বান্ধবী নাচবে। আমি হলাম নায়িকা পরীমনি আর আপনি হলেন পরীমনির বান্ধবী।
-ছি ইমু, এটা একটা কথা বললা। আমি তোমার বয়সে বড় এবং তোমার দুলাভাই। এ ছাড়া একজন সরকারি কর্মকর্তা।

সোসাইটিতে আমার একটা সম্মন আছে। আর তুমি আমাকে বলছ পরীমনির বান্ধবী হতে? শোনো, আমি না, তুমি হবা পরীমনির বান্ধবী। আর আমি হব পরীমনি।
-আপনি পরীমনি হবেন? আপনি কি নায়িকাদের মতো শরীর বেকিয়ে রংঢং করে নাচতে পারবেন?
-অবশ্যই পারব। ওটা কোনো সমস্যা না। তবে শাড়ি পরতে পারলে ভালো হতো। এতে নারী নারী একটা ফিলিংস হতো।
-তা হতো। তা এখন শাড়ি কোথায় পাব?
এ সময় হঠাৎ চোখে পড়ল ছাদের একপাশে তারের মধ্যে কিছু কাপড় ঝুলছে। ওখানে বিভিন্ন কাপড়ের সঙ্গে দুটি বিশাল ম্যাক্সিও ঝুলছে। ম্যাক্সি দুটি দুজনে পরে ফেললাম। ওপরে বিশাল ঢোলা ম্যাক্সি আর নিচে ভেজা লুঙ্গি। এই সাজে চরম লাগছিল আমাদেরকে। দুলাভাইকে নাচের মুদ্রা শিখিয়ে দিলাম। কয়েকবার রিহার্সেল করার পর ভাগনিকে বললাম ক্যামেরা অন করতে। ক্যামেরা অন হতেই আমরা দুজনে উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে নাচতে লাগলাম।
আমি ডানাকাটা পরি, আমি ডানাকাটা পরি...

শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ভেজা লুঙ্গি আর ম্যাক্সি পরে দুটি পূর্ণ বয়স্ক মানুষ কোমর দুলিয়ে, বুক ঝাঁকিয়ে নাচছে, আর একটু পরপর দৌড় দিচ্ছে আর লাফ দিচ্ছে। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুলাভাইয়ের নাচ। তিনি বিশ্রীভাবে তার শরীর বাঁকাচ্ছেন আর ঝাঁকাচ্ছেন। মানুষ যে এত অশ্লীলভাবে নাচতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না। আমরা নাচে এতই মশগুল ছিলাম যে আপা ও ময়না কখন আবার ছাদে ফিরে এসেছেন বুঝতে পারিনি। ওদের দেখেই নাচ থামিয়ে দিলাম। দেখলাম শুধু আপা আর ময়না না, ওদের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন মোটা এক মহিলা। বুঝতে পারলাম এই মহিলার ম্যাক্সি পরেই আমরা নাচছি। সম্ভবত মহিলা কাপড় নেওয়ার জন্য ছাদে এসেছেন। খেয়াল করে দেখলাম, তিনজনই মুখ হা করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কিছুক্ষণ পর মহিলা আপার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ভাবি, এই দুইটার সমস্যা কী? এই দুইটা এমন লাফালাফি করছে কেন?
আপা শান্ত স্বরে বললেন,
-ভাবি ওরা লাফালাফি করছে না, ওরা নাচ করছে।
-এটাকে নাচ বলে! জানতাম না তো। তা ভাবি ওরা মেয়েদের পোশাক পরেছে কেন? ওদের কি হরমোনে সমস্যা আছে?
-কি যা তা বলছেন, হরমোনে সমস্যা থাকবে কেন? আসলে নাচে ফিল আনার জন্য ওরা মেয়ে সেজেছে।
এতক্ষণ মহিলা বুঝতে পারেননি যে আমরা তার ম্যাক্সি পরে আছি। এবার হঠাৎ করেই উনি বিষয়টি বুঝতে পারলেন।

বুঝতে পেরেই বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলেন,

-নাউজুবিল্লাহ, ভাবি এই দুই বান্দর তো আমার ম্যাক্সি পরে আছে।
আপা এবার আর ওই মহিলার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি এতক্ষণ অনেক কষ্টে মেজাজ কন্ট্রোল করে রেখেছিলেন। কিন্তু আর পারলেন না। আপা চিৎকার করে ময়নাকে বললেন,
-ময়না, যা দৌড় দিয়ে স্যাভলনের শিশি, কিছু তুলা আর আমার বঁটিটা নিয়ে আয়।


আপার কথা শেষ হতেই ময়না দ্রুত নিচে চলে গেল। দুলাভাই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আপাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-সেতু তুমি ওগুলো দিয়ে কী করবে?


-তোদের দুইটার তো মেয়ে হওয়ার খুব শখ। তাই ঠিক করেছি আজ তোদের দুইটাকে স্থায়ীভাবে মেয়ে বানিয়ে দেব।
এ কথা শুনেই দুলাভাই বুকে একদলা থুথু দিয়ে উচ্চ স্বরে পড়তে লাগলেন,


লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন। লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন।


এরপর তিনি আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
-ইমু এই মহিলার মাথায় সমস্যা আছে। এর হুমকি হাল্কাভাবে নিলে বিপদে পড়বা। কোনো কথা হবে না। যাস্ট চোখ বন্ধ করে আমার সঙ্গে দৌড় দাও।


কথাগুলো বলেই দুলাভাই দৌড় দিলেন। আমিও দুলাভাইয়ের পেছন পেছন দৌড় দিলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় খেয়াল করে দেখলাম ওই মোটা মহিলাও আমাদের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। তিনি দৌড়াচ্ছেন আর চিৎকার করে বলছেন,
-ওই বান্দর আমার ম্যাক্সি দিয়ে যা। ওই বজ্জাত ব্যাটা, আমার ম্যাক্সি দিয়ে যা।

বি. দ্র: কাউকে ছোট করার জন্য না। শুধু মজা করার জন্য এটি লেখা। আসলে করোনা নিয়ে আমরা সবাই খুব টেনশনে আছি। তাই একটু মনটাকে অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা।

বি.দ্রষ্টব্যের বি. দ্রষ্টব্য:
আমরা অনেকে ভাইরাল হওয়ার জন্য, লাইক-কমেন্টের জন্য কত কিছুই না করছি। তবে একটা জিনিস সবারই লক্ষ রাখা উচিত। আমরা যাই করি না কেন, তা যেন সত্য, শালীন এবং ক্রিয়েটিভ কিছু হয়। অযথা ভিডিও বানিয়ে মানুষকে বিরক্ত করাটা ঠিক নয়।