কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে সম্ভাবনা বাংলাদেশের, ধরতে পারবে কি

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সারা পৃথিবীকে বিরাটভাবে নাড়া দিয়েছে।

জনসাধারণের মধ্যে সংক্রমণ কমানোর জন্য কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত সব দেশের সরকারই কমবেশি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো দেশ—ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে মোটামুটি সফল হয়েছে বলা যেতে পারে। দেশগুলো কোভিড-১৯–এর সংক্রমণের গতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও লকডাউন বহুল আলোচিত এবং কার্যকরী। আর এসব পদক্ষেপ নিতে গিয়ে অফিস–আদালত, কলকারখানা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, পর্যটন থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যাতায়াতও বন্ধ করতে হয়েছে। এর ফলে আক্রান্ত দেশগুলোতে স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক খাতেও বিরাট বিপর্যয় নেমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশেই লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিকসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এপ্রিলে সেখানে দুই কোটির ওপরে মানুষ বেকার হয়েছে। আর অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব স্ট্যাটিকস অনুযায়ী, পাঁচ লাখের ওপরে মানুষ বেকার হয়েছে এপ্রিল মাসে।

সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বাংলাদেশেও যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ বেকার হয়েছে কোভিড-১৯ এর–কারণে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এসব দেশে বেকার মানুষদের সাহায্যার্থে সরকার তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী বিভিন্ন রকম প্রণোদনার ব্যবস্থা নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রণোদনার পরিমাণ ট্রিলিয়ন ডলার আর অস্ট্রেলিয়াতে ২৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াতে এই প্রণোদনা আবার দুইভাবে দেওয়া হচ্ছে, চাকরি সন্ধান বা বেকার ভাতা এবং চাকরি রক্ষা ভাতা হিসেবে। চাকরি রক্ষা ভাতা দেওয়া হচ্ছে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানকে, পাক্ষিক ১ হাজার ৫০০ ডলার প্রতি কর্মচারীর জন্য, যা দেওয়া হবে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। এতে দেশগুলোতে বড় রকমের বাজেট ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা ঠিক হতে কয়েক বছর, এমনকি দশকও লেগে যেতে পারে। অর্থাৎ, কোভিড-১৯–এর কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগামী বছরগুলোতে চরম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাবে।

কোভিড-১৯–এর কারণে সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোকে আরেকটি বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে, তা হলো বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা। অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর ধনী দেশগুলো বিভিন্ন পণ্যের জন্য চীনের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। এসব দেশে আলুর খোসা ছাড়ানোর যন্ত্র থেকে শুরু করে আইফোন পর্যন্ত সবই চীন থেকে আমদানি করা হয়। চীন ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা বাংলাদেশের ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের ৪০ দশমিক ৩ গুণ এবং রপ্তানিকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, কম্পিউটারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি, আসবাব, প্লাস্টিকসহ প্লাস্টিক দ্রব্য, গাড়ি, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, লোহা ও ইস্পাত দ্রব্য, গার্মেন্টস ও আনুষঙ্গিক উপকরণ, খেলনা এবং কম্পিউটার গেমস (worldstopexports.com, ৩১ মার্চ)। গত বছর শুধু অস্ট্রেলিয়া এবং চীনের মধ্যেই আমদানি–রপ্তানি হয়েছে ২৩৫ বিলিয়ন ডলারের (Sydney Morning Herald, ২৩ মে), যা বাংলাদেশের বাজেটের প্রায় ৪ গুণ।

কোভিড-১৯–এর কারণে জানুয়ারি মাসে চীন যখন লকডাউন ঘোষণা দিল, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশই সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এর প্রতিফলন অবশ্য পরবর্তী সময়ে সাধারণ জনগণের মধ্যেও দেখা গিয়েছে। কোভিড-১৯–এর জন্য যখন এসব দেশেও লকডাউন করা হয় সুপার মার্কেটগুলোত, জিনিসপত্র নিয়ে মানুষ কাড়াকাড়ি থেকে মারামারিও করেছে। এটা যে শুধু মার্কেট দীর্ঘকালীন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তা নয়, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে জিনিসপত্রের স্বল্পতার আশঙ্কায়ও এমনটি হয়েছে। তখন অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন যে অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য ধনী দেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য একটি মাত্র দেশের (চীন) ওপর খুব বেশি নির্ভরতা যেন অনেকটা ‘এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার’ মতো। তাঁরা এর থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের পরামর্শের অন্যতম দিক হলো সরবরাহ উৎসের বৈচিত্র্যকরণ (supply chain diversification); অর্থাৎ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য চীন ছাড়া অন্যান্য দেশে বিনিয়োগ করা। তাঁদের কেউ কেউ বাংলাদেশসহ ভারত, ভিয়েতনামের কথা বলেছেন। তাঁরা অবশ্য ভারত ও ভিয়েতনামকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

কোভিড-১৯–পরবর্তী বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হবে, এটা এক রকম নিশ্চিত। সরবরাহ উৎসের বৈচিত্র্যকরণ বিষয় ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, তথা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করবে। পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য চাইবে নিজেরাই উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্ত সে ক্ষেত্রে তাদের প্রধান অন্তরায় হবে উচ্চ শ্রমিক মূল্য। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা রোবটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। তবে সব ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ, অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন জিনিস উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের মতো দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।

তবে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ হবেই, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ জন্য বাংলাদেশকে সঠিক এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। ভূরাজনীতির কারণে পশ্চিমা বিশ্ব চীনকে কাউন্টার করার জন্য ভারতের সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্যে আগের চেয়ে আরও বেশি জড়িত হবে। ইতিমধ্যে এর কিছু নমুনা দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯–এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে তা ভারতে উৎপাদনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে। আর ভিয়েতনাম কোভিড-১৯ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় সে দেশের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের আস্থা কিছুটা বেড়েছে, যা ভবিষ্যতে বিনিয়োগ আকৃষ্টে সহায়তা করবে। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনামের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমি অনেক বছর অস্ট্রেলিয়াতে তুলা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তখন এ দেশের কিছু তুলাচাষি/ ব্যবসায়ীর সংস্পর্শে আসি, যাঁরা বাংলাদেশে তুলা রপ্তানি করেছেন। তাঁরা আমাকে তাঁদের বাজে অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, যা খুবই দুঃখজনক। আমার ধারণা, অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশের দূতাবাসও এ ব্যাপারে অবগত আছে।

প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ২-৩ সদস্যের বিনিয়োগ বোর্ড বা কমিশন
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি এবং দুর্নীতির কারণে যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে দীর্ঘসূত্রতা দেশের ভাবমূর্তি খারাপের অন্যতম কারণ। সুতরাং কোভিড-১৯–পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে একটু অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। আমার মনে হয় এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ২-৩ সদস্যের একটি বিনিয়োগ বোর্ড বা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। যাঁরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করবেন এবং তাঁর অনুমোদন ক্রমে বিনিয়োগ–সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

এটা হবে অনেকটা ওয়ান স্টপ শপের মতো, যারা নীতিনির্ধারণ, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা থেকে প্রয়োগ সবই করবে। আর এটাও নিশ্চিত করতে হবে বাণিজ্য বা শিল্প মন্ত্রণালয় এই বোর্ড/ কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা করবে, কোনোভাবেই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে না। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংস্থার মেয়াদ হতে পারে ২–৩ বছর এবং এর সদস্যরা সবাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাবেন। এই সংস্থার সদস্য নিয়োগেও বিশেষ নজর দিতে হবে, কোনোভাবেই যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় না হয়। তাঁরা হতে পারেন অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্বনামধন্য শিক্ষক অথবা ব্যবসা বা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক, যাঁদের অর্থনীতি/ বাণিজ্য/ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা আছে এবং যাঁরা হবেন সৎ ও নিষ্ঠাবান। এ ক্ষেত্রে অবশ্য headhunting ও করা যেতে পারে, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের নির্বাহী স্তরের কোনো অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের কথাও বিবেচনায় আনা যেতে পারে। আর এই সংস্থার দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজ করার জন্য প্রেষণে বাণিজ্য/ শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

এ রকম বোর্ড/ কমিশনের সুফল প্রধানত দুটি—এর ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পাশ কাটিয়ে তাঁরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং আগ্রহী দেশগুলোতে অবহিত করা যে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত। অবশ্য এই সংস্থাকে একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যা প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে বিনিয়োগবান্ধব এবং উৎকৃষ্ট হবে।

*লেখক: অস্ট্রেলিয়ান সরকারের নির্বাহী স্তরের কৃষিবিজ্ঞানী।