একজন কৃষ্ণাঙ্গ বলছি

কয়েক দিন ধরেই আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টিভি চ্যানেল, মিটিং–মিছিল সব জায়গাতেই আমরা কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে কথা বলছি। আজ আমরা যতই কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে কথা বলি না কেন, সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রেই কিন্তু আমরা বিভাজন করে রেখেছি। এটা আমাদের রক্তে মিশে গেছে। আজকাল যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত হয় সাদা চামড়া দিয়ে।

কখনো কাউকে বলতে শুনেছেন যে বিয়ের জন্য কালো পাত্র বা পাত্রী চাই; বরং একজন যোগ্যতাসম্পন্ন কালো ছেলেকে দেখার পর পাত্রীপক্ষের সবাই বলাবলি করবে, ‘এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলে তো বেবিগুলোও কালো হবে।’ আবার পাত্রী দেখে এসে সবাই কানাঘুষা করে বলবে, ‘আরে, মেয়ের গায়ের রংটা তো ...!’

আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু কালো হওয়ার কারণে কৃষ্ণাঙ্গদের পিছিয়ে থাকতে হয়। ধরুন কোনো অফিসে রিসিপশনের জন্য মেয়ে নিয়োগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও দেখবেন গায়ের রংটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। কখনো কি এমনটা দেখেছেন যে রিসিপশনে কোনো কালো মেয়ে বসা? ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর হবে, না।

আচ্ছা, আমাদের বিনোদনজগতের অভিনেতা–অভিনেত্রী কতজন কালো বলেন তো? কালো হলেও আমরা মেকআপ দিয়ে তাঁদের সেই ফর্সারূপেই পর্দায় উপস্থাপন করি। এটা কেন করি জানেন? কারণ, আমাদের সবার মস্তিষ্কে এই বিষ খুব ভালো করেই ঢুকে গেছে যে সব সৌন্দর্যের মানেই হলো ওই ফর্সা চামড়া।

কাউকে কি কখনো ছোট্ট বাচ্চাটিকে আদর করে সাদা মানিক বলতে শুনেছেন? অথচ আমরা আমাদের কালো বাচ্চাটিকে সবাই আদর করেই হোক অথবা এমনিতেই হোক, কালো মানিক বলে ডাকি। একটিবার ভাবুন তো, ওই বাচ্চাকে আমরা কী শেখাচ্ছি? বাচ্চাটিকে ছোটবেলা থেকেই বর্ণবাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।

আমাদের সমাজে যদি সত্যিই গায়ের রং দিয়ে মানুষকে বিবেচনা না করা হতো, তাহলে এত্ত এত্ত রং ফর্সাকারী ক্রিম কোম্পানি কী করে যুগের পর যুগ টিকে রয়েছে!

আমার জীবনের একটা বাস্তব ঘটনা বলি—ফতুল্লা স্টেডিয়ামে তখন বাংলাদেশ আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ চলছিল। আমাদের গ্যালারির পাশে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস তখন ফিল্ডিং করছিলেন। তিনি এমনিতেই খুব হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। সেদিনও তিনি স্বভাবসুলভভাবেই দর্শকদের নেচে, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বিনোদন দিচ্ছিলেন। হঠাৎ কিছু দর্শক ‘মানকি’ বলে স্লোগান দেওয়া শুরু করল। মুহূর্তেই হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

এই গল্প বলার কারণ হলো আমাদের দেশেও কিন্তু ব্যাপক আকারে এই বর্ণবৈষম্য বিদ্যমান। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের একজন ক্রিকেটারকে যদি আমরা বর্ণবাদে জর্জরিত করতে পারি, তাহলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত কী পরিমাণ বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে! ভাবুন তো একবার?

আর আমরা যারা সাদা চামড়া, মানে কথিত শ্বেতাঙ্গদের দেশে প্রবাসী হিসেবে বাস করছি, তাঁদের প্রায় প্রতিটি জায়গায় এই বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়।

কালো মানেই অসুন্দর, তাই না? এটা কোথায় পেয়েছেন আপনারা! মানুষ সুন্দর হয় তার কর্মে, বর্ণে নয়। আর বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্যই হলো আসল সৌন্দর্য।

পরিশেষে এটাই কাম্য যে আমরা মানুষকে তার কর্ম, তথা তার কথাবার্তা, আচার–ব্যবহার আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে পরিমাপ করি, বর্ণ দিয়ে নয়। সাদা মানেই সুন্দর আর কালো মানেই কুৎসিত—এ ধারণা থেকে আমাদের সরে আসার এখনই সময়।