থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-১১

বন্ধুর সঙ্গে রোদেলা। ছবি: সংগৃহীত
বন্ধুর সঙ্গে রোদেলা। ছবি: সংগৃহীত

সকাল থেকেই মাথাটা ফাঁকা লাগছে। বিশাল এক শূন্যতায় ডুবে আছি। রোদেলা সাসকাতুনের পথে যাত্রা শুরু করেছে সেই ভোর পাঁচটায়। এখন বাজে সকাল দশটা। একবারও ফোন করেনি। আমি একবার ফোন দিয়েছিলাম, সে মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘ড্রাইভিং মা।’ এরপর থেকে আমি কোকরা মুরগির মতো ঝিম মেরে বসে আছি। কিছুই করতে ভালো লাগছে না। ভীষণ ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন টুঁটি চেপে ধরছে।

দুই বছর আগের কথা। এজাজ আর আমি বাসায় ফিরছিলাম। দুজনে একটা বই নিয়ে আলোচনা করছিলাম, হাসছিলাম। হঠাৎ মহাসড়কে ওঠার আগে কিছু বুঝতে না বুঝতেই একটা টয়োটা এসে আমাদের জিপ গাড়িকে সজোরে আঘাত করল। গাড়ির ডান পাশটা তখন দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল। দোমড়ানো গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান হাত ভেঙে গেল। এক বছর ভুগে আমি সুস্থ হয়েছিলাম। আজ কেন জানি বারবার সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়ছিল। যতই মন থেকে এই ভয়ংকর সময়কে মুছতে চাইছিলাম, ততই সেই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে চেপে ধরছিল শক্ত আঠার মতো।

রোদেলা প্লেনে এলে দু–দুটো আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট পড়বে। এই মুহূর্তে লোকজন বাড়ি ফিরছে পাগলের মতো। কে সঙ্গে করোনা আনছে সে নিজেও জানে না। এসব কথা ভেবেই সে সড়কপথে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিচ্ছে। আমার প্রতিটা মুহূর্ত এখন কাটছে ভয়ে, অনিশ্চয়তায়, আর সন্তানের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে।

হোটেল। ছবি: সংগৃহীত
হোটেল। ছবি: সংগৃহীত

বাসায় একা বসেছিলাম, রকিং চেয়ারটায়। সূর্যটা কিছুক্ষণ আগেই বাঁধটার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। বাইরের আলো নিবু নিবু। চারদিকে সবকিছুই ভীষণ নিস্তব্ধ। আমার ঘরেও যেন কবরের নিস্তব্ধতা। এ বাড়িতে টিভি নেই। নিচ তলায় ফ্যামিলি রুমে একটা টিভি আছে কিন্তু সেটায় কোনো চ্যানেল নেই। এ বাড়ির ঘরগুলো বেশ বড় বড়, আর আলাদা। বিশেষ করে শোবার ঘরটা বেশ দূরে লিভিং রুম আর রান্নাঘর থেকে। নিচ তলায় মাঝারি একটা রুম আছে, যেখানে রোদেলা এসে থাকে। এসব দেশে অনেক বাড়ির মতো আমার লিভিং রুমেও কোনো বাতি নেই। বসার ঘরে একটা টেবিল ল্যাম্পে খুবই কম আলো দেওয়া বাতি। সিঁড়ি ঘরে একটা ঝাড়বাতি, সেটাই মূলত পুরো বাড়িটাকে আলোকময় রাখে। কদিন হোল সবগুলো বাতিই নিভে গেছে। অন্ধকারময় পৃথিবীর আলোহীন ঝরে পড়া নক্ষত্রের পতনের মতোই যেন আলোহীন ঝাড়বাতি নিঃস্ব হাহাকার। এখন ওই টেবিল ল্যাম্পের আলো–আঁধারিই যেন ভরসা। ঠিক যেন ৫০ বছর আগের ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিটমিটে কুপির শেষ দীর্ঘশ্বাস ছড়ানো মৃত প্রায় ফ্যাকাশে আলো। বেডরুমের প্যাসেজ ধরে এগোলেই বাকি দুটি বেডরুম পড়ে। সেগুলোর দরজা বন্ধ। সাদা দরজাগুলো এই আলো–আঁধারিতে সাদা কফিনের রং ধরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। একাকী বাসায় ভীষণ ভুতুড়ে পরিবেশে গণকবর থেকে উঠে আসা অশীরী আত্মাগুলো রান্নাঘর পর্যন্ত আমার পিছু পিছু এল। রান্নাঘর যেতে কেমন যেন একটু ভয় ভয় লাগছিল। তারপরও উঠে গেলাম। একটু লেবু চা খেতে চেয়েছি। সাদা কাপে সিংক থেকে এক কাপ পানি নিয়ে মাইক্রোওভেন ৩০ সেকেন্ড গরম করলাম। লেবু কাটাই ছিল। সেটিই চিপে, নিংড়ে কাপে ঠাললাম। একটা গ্রিন–টির ব্যাগও কাপে রেখে দিলাম। চা–টা মুখে দিতেই ভীষণ টক মনে হলো, দাঁত শিরশির করে উঠল। তারপরও এক চুমুকে অর্ধেকটাই শেষ করে ফেললাম। গরম লেবু নাকি ঠান্ডার যম।

ফোনটা বাজছিল। গা ছম ছম ভয় এখনো করছে। তারপরও আমি দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেড়ে তুলে নিলাম ফোন। রোদেলার ফোন।

আম্মু আমরা সাডবেরিতে হোটেলে উঠেছি। রাস্তায় সাবওয়ে খেয়েছি। এখন ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে যাব।

সারা দিন পর মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছিল যেন দূর থেকে ভেসে আসা কোনো সেতারের সুরেলা আলাপ। আমি কান পেতে শুনতে থাকলাম, সেই মধুর সুরালাপ। বুকের ভেতর স্নিগ্ধ ভালো লাগারা সারা শরীরে ঝিলিক দিয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য। কিন্তু পরক্ষণেই তাল কেটে গেল।

সে ফিসফিস করে বলল, ‘আম্মু জানো রাস্তায় আফসানার বাবা ঘুমিয়ে পড়ছিল।’

মেয়ে আরও ফিসফিস করে বলল, তিনি সাসকাতুন থেকে গাড়ি চালিয়ে এসেছেন, মনট্রিল, তারপর অটোয়া হয়ে আবার ফিরে যাচ্ছি সাসকাতুন। ওনার জন্য তো অনেক জার্নি হয়েছে মা। উনি ভালো গাড়ি চালান, কিন্তু টায়ার্ড। বলেছেন আজ রাতে ঘুমাবেন ভালো করে তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।

বন্ধুর সঙ্গে রোদেলা। ছবি: সংগৃহীত
বন্ধুর সঙ্গে রোদেলা। ছবি: সংগৃহীত

আমি একটু ভয়ে সোজা হয়ে বসলাম, ‘কী বলো? খুলে বলো।’
তিনি ড্রাইভ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, ক্লান্ত ছিলেন তো।
তোমরা কী করছিলে।
আমরাও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সারা দিন গাড়িতে বসে আছি।
আমি ভীত কণ্ঠে বললাম, তারপর?
পুলিশের গাড়ির হর্নে ঘুম ভেঙেছে সবার।
কী বলো এসব? বিশাল অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত, আমি প্রায় পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলাম।
সে আরও ফিসফিস করে উঠল, আম্মু তুমি থামো। এ জন্যই তোমাকে কিছু বলতে ভালো লাগে না।
আমি আস্তে করে বললাম, ভয় লাগছে তো মামণি।
না কাল সবাই মিলে ড্রাইভিং করব। তুমি চিন্তা করবে না।
সাবধানে থেকো মা। হতবিহ্বল আমি এটুকুই বললাম।

মেয়ের তাড়া আছে। হয়তো ক্লান্ত শরীর। শোনো মা, এবার তাহলে রাখি। কাল আবার ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে। সকালে ফোন দেব কেমন?
ফোন কেটে দিল।

অনেকের কাছে এই বিশাল দূরত্ব জয় করে আসার গল্প শুনেছি। কেউ দিয়েছেন অভয়, কেউ বলেছেন ভয়াবহতার কথা। ভয়াবহতাটাই মাথায় চেপে বসল এখন। বনের ভেতর দিয়ে গাড়ি ছুটে চলে, তখন থাকে না নেটওয়ার্ক।

টহল পুলিশই তখন একমাত্র ভরসা। সারা দিন গাড়ি চালানোর ক্লান্তিতে অনেক সময় ড্রাইভারের ঘুম চলে আসে। তখন অ্যাকসিডেন্টের আশঙ্কা বেড়ে যায় প্রচুর। এ ছাড়া শীতকালে পিচ্ছিল রাস্তা, কোথাও ভাঙা এসব বিপদ তো আছেই।

কানাডার হাইওয়ে। ছবি: সংগৃহীত
কানাডার হাইওয়ে। ছবি: সংগৃহীত

রোদেলা, আর তার বন্ধু দুজনেই তেমন অভিজ্ঞ ড্রাইভার নয়। সুস্থ অবস্থায় মেয়েকে কাছে পাওয়ার আকুলতা মাথাকে এলোমেলো করে দেয়। এ মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। এর চেয়ে ভীষণ অসহায়ত্ব আর কখনো অনুভব হয়নি।

আমি একা একা বাসায় বসে রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে বিষণ্নতায় তলিয়ে যেতে থাকলাম। দুশ্চিন্তার ভাগ দিতে পারলে ভালো লাগে, আমার তো সে সুযোগও নেই, কারণ, এজাজ তার কাজ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক রাতে এসে আলাদা রুমে ঘুমিয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করলেই দেখি একটা গাড়ি হাইওয়েতে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। একসময় মনে হতে থাকল আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কিছুতেই আর দম নিতে পারছি না। আমি বিছানার এক কোনায় পাতলা একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করে মড়ার মতো শুয়ে থাকলাম। প্রচণ্ড শ্বাসরুদ্ধ করা ব্যথা আমার বুক হয়ে, পেটের ভেতর থেকে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সেই ব্যথা ভীষণ অসহনীয়, একদম নতুন। আগে কখনো অনুভব করিনি। সেই প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে স্রষ্টার হাতে তুলে দিলাম। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবকিছুকে মূল্যহীন মনে হলো। পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটির সুস্থ শরীরে ঘরে ফেরার প্রার্থনা করছি।

সময় যখন থমকে দাঁড়ায় তখন আর অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরত্ব শেষ হওয়ার। চলবে...