আসুন, পাল্টাই দৃষ্টিভঙ্গি

বিদেশে আসার আগে আমি জানতাম না যে ‘নিগ্রো’ শব্দটা একটা গালি, বা খারাপ শব্দ। আমাদের ব্রিটিশ উপনিবেশ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়, সামাজিক গঠনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে বর্ণবাদ। শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, এটা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্যা। আসলে তো সমগ্র বিশ্বেরই সমস্যা। কে কবে কোথায় কীভাবে আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়েছে কালো মানুষ খারাপ, অশিক্ষিত, বর্বর, ভয়ংকর, সেটা জানি না।

কিন্তু প্রায় এ ধরনের একটা ধারণা আমরা সবাই গোপনে মনে মনে কমবেশি ধারণ করি। হাস্যকর হলো, আমাদের নিজেদের মধ্যেও আমরা ফরসা মানুষকে আজও সুন্দর ভাবি আর কালোদের অসুন্দর। অথচ বাইরে এসে বুঝতে পেরেছি, সাদাদের চোখে আমরা সবাই ‘ব্রাউন’ এবং মুখে প্রকাশ না করলেও সাদারাও অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে আমাদের মতো ব্রাউনদের চেয়ে উন্নত মানুষ মনে করে।

১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে আমার মা–বাবা বেশ কিছুদিনের জন্য ইংল্যান্ডে ছিলেন। তাঁদের মুখে শুনেছি, সে সময় বন্ধুসুলভ ব্রিটিশ থাকলেও, বাসে বা ট্রেনে অনেক ব্রিটিশই তাঁদের পাশে বসতে চাইত না। কেন যেন এই ঘটনাগুলো গভীরভাবে কখনো তলিয়ে দেখিনি, ওই যে আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষা বা মানসিকতা, মনে হতো এটাই স্বাভাবিক।

প্রবাসে এসে এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ব্যাপারেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। আজ থেকে ২০ বছর আগে একজন কালো মানুষের সঙ্গে একা একা লিফটে উঠতেও হয়তো মনে মনে কিছুটা ভয় লাগত, এখন সেটা কাটিয়ে উঠেছি। হয়তো আমার মতো অনেকেই। কিন্তু তারপরেও কোথায় যেন একটা কিন্তু আছে। আমেরিকাতে বা ইউরোপে কালো লোক–অধ্যুষিত এলাকাগুলো সাধারণত গরিব। সেখানে অপরাধ বেশি, চুরি–ছিনতাই বেশি হয়। এমনকি রাত–বিরাতে মানুষ খুনও হতে পারে। ড্রাগে আসক্ত লোকজন রাস্তায়, গৃহহীন লোকজনের ছড়াছড়ি। এ ধরনের একটা চিত্র আমাদের সবার মনেই কমবেশি গেঁথে আছে। তাই পারতে সেসব এলাকায় আমরা যাই না। ওই সব এলাকার স্কুল–কলেজে বাচ্চা পড়লে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার, তাই আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি ওসব এলাকায় বসবাস না করতে। এটা প্রবাসে আমরা যাঁরা আছি, সবার জন্যই কমবেশি সত্য। এ জন্য কি আমাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যায়? তা–ও যায় না। সবাই জীবন, সম্পত্তি এগুলোর নিরাপত্তা চায়।

কিন্তু সমস্যা হলো, কালো লোক মানেই খারাপ বা ভয়ংকর—এই ধারণা মানুষের মনের ভেতর গেঁথে দেওয়া হয়েছে। তাই অচেনা ট্রেন বা বাসস্টেশনে একজন সাদাকে দেখলে বা ব্রাউনকে দেখলে মানুষ ভয় না পেলেও, একজন কালো মানুষকে দেখলে ঠিকই বাড়তি সাবধান হয়ে যায়। মানুষ হিসেবে ওই কালো মানুষের জন্য এটা বেশ কষ্টের। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, পুলিশ বা আইনজীবী, তাঁরাও এমন একটি ধারণা পোষণ করেন, এরা তো আর সমাজের বাইরের মানুষ নয়। আরও ঘৃণ্য ব্যাপার হলো, এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক পুলিশ খুব সামান্য অপরাধে কালো লোকদের নির্মমভাবে আঘাত করে, গ্রেপ্তার করার সময় নানাবিধ অত্যাচার করে। অনেক সময় বিনা অপরাধেও গ্রেপ্তার করে। অনেক আইনজীবী তাদেরকে বিনা অপরাধে শাস্তি দেন। বছরের পর বছর বিনা বিচারে, বিনা অপরাধে এরা জেলে পচতে থাকে। নারী, শিশু কেউই এই নির্মমতা থেকে রেহাই পায় না। ১৪ বছরের একটি কিশোরের দুর্বল শরীরকে গাঁজা সেবনের সন্দেহে বিশালদেহী সাদা পুলিশ যেভাবে দুমড়েমুচড়ে ফেলেছে, দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে। সাইকেলে হেডলাইট না থাকার অপরাধে এক যুবককে গ্রেপ্তারের আগে হাত–পা ভেঙে ফেলার জোগাড়। আর ২০ টাকার জাল নোট ব্যবহারের অপরাধে প্রাণ দিতে হলো জর্জ ফ্লয়েডকে। ১৪ বছরের এক কালো কিশোরকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল মিথ্যা খুনের অভিযোগে। কালো বাবা–মায়েরা তাঁদের সন্তানদের শিশুকাল থেকেই শিক্ষা দেন, পুলিশ যদি তাদেরকে ধরে, এমনকি সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে, তবু কীভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে তাদের সঙ্গে নরম সুরে কথা বলতে হবে। একটি শিশু–কিশোরের মনে এ এক বিরাট চাপ, আতঙ্ক। জন্মের পর থেকেই এক হীনমন্যতার বোঝা বুকে নিয়ে বড় হয় এই মানুষগুলো, সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে। মানুষ হিসেবে এটা আমাদের কত বড় ব্যর্থতা।

এখন প্রশ্ন হলো, কালোদের মধ্যে কি আসলেই অপরাধের হার বেশি? যদি বেশি হয়, সেটা কেন? আসলে, অপরাধ সব জাতের, বর্ণের মধ্যেই আছে, কালোদের অপরাধটা খুব বেশি করে ফোকাস করা হয়, জানান দেওয়া হয়। সাদা মানুষেরা জানে, একই অপরাধে একজন কালো মানুষকে গ্রেপ্তার করা হবে, তাকে করা হবে না। একই অপরাধে একজন কালো মানুষ একজন সাদা মানুষের চেয়ে বেশি শাস্তি পাবে। না, এগুলো কোনো লিখিত আইন নয়, কিন্তু বাস্তবে তা–ই ঘটে, সাদারা এটা জানে এবং তার সুযোগ নেয়। কালো মানুষদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার একটা বড় কারণ হলো মাত্র ৬০–৬৫ বছর আগেও তারা ছিল ক্রীতদাস। তাদেরকে প্রায় শূন্য থেকে উঠে আসতে হচ্ছে। উপরন্তু বিচার এবং আইনি ব্যবস্থার এই ব্যর্থতার কারণে পরিবারের উপার্জনকারী মানুষটি থাকছে কারাগারে। শৈশব বা কৈশোরেই হয়তো হাল ধরতে হয়েছে সংসারের বাচ্চাটির। পড়ালেখার সুযোগ সেখানেই শেষ। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের সেখানেই সমাপ্তি। শিক্ষার অভাবে একজন মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হয় না। তা ছাড়া শিক্ষা ছাড়া জীবিকা নির্বাহের সৎ, সুন্দর উপায় পাওয়াও কঠিন। বাধ্য হয়ে এরা অপরাধ জগতে চলে আসে। চক্রাকারে আবার ছোটখাটো অপরাধে জেলে যায়, বিচারের অভাবে বছরের পর বছর কাটে। আমরা বাইরে থেকে এদের অশিক্ষিত, উগ্র রূপটা দেখে একটা মনগড়া ধারণা করে নিই, অথচ খতিয়ে দেখি না পেছনের ইতিহাসটা যে কী কারণে আজ এদের এই পরিণতি।

আজ যে আমেরিকায় বর্ণবাদের এই নির্মম–বর্বর রূপ বেরিয়ে পড়েছে, এই যে বিক্ষোভ–উত্তাল জনতা, এই সব কিছুর সমাধান করার জন্য সমগ্র বিশ্বের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন প্রয়োজন। যেদিন আমরা সবাই মন থেকে বিশ্বাস করতে পারব ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবারই সমান রাঙা’, সেদিন এই পৃথিবী থেকে এই নিষ্ঠুর বর্ণবাদ লোপ পাবে, শুধু আইন করে এই পরিবর্তন আনা যাবে না।