অ্যালানের গল্প

ছবি: প্রতীকী ছবি
ছবি: প্রতীকী ছবি

বিলেতের বাড়িগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা গায়ে লাগানো। সব বাড়ি নয়। অধিকাংশ। বাড়ির সামনে ছোট বাগান বা গাড়ি রাখার জায়গা। দুটো বাড়ির বিভাজন ছোট্ট পরিসরে, প্রতিবেশীর মুখ দেখতে পারবেন। বাড়ির পেছনের বাগান একান্ত ব্যক্তিগত। উঁচু বেড়া। অধিকাংশই কাঠের। রংটা বাদামি বা গাড় বাদামি। লন্ডনে এ রকমই একটি সাধারণ ছোট বাড়ি আমাদের।

বাড়িটি কেনার আগে আমরা একদিন দেখতে এলাম। এ দেশে বাড়ি কেনার আগে এজেন্টের মাধ্যমে দেখতে আসতে হয়। দিনক্ষণ বেঁধে। বাড়িতে ঢোকার মুখেই পাশের বাসার এক প্রতিবেশী হ্যালো বলল প্রাণখোলা হাসি দিয়ে। বিলেতে বাস এখন এক যুগের বেশি। রাস্তাঘাটে, পাড়ায়, বাসে বা ট্রেনে শুধু হাসির অভিজ্ঞতাই বেশি। আমরাও হ্যালো বললাম হাসি দিয়ে। নামটা জানা হলো না।

সেই প্রতিবেশী নিজে থেকে যেচে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, এটা আমার আর আমার স্ত্রীর কাছে তখন দারুণ ভালো লাগার ব্যাপার। বাড়িটা আমরা কিনলাম। গৃহপ্রবেশ হচ্ছে। সকাল থেকে আমাদের জিনিসপত্র আগের বাড়ি থেকে ছোট ট্রাকে আসছে। জিনিসপত্র ঘরে ঢোকাতে রাত হয়ে যেতে পারে। বিলেতে রীতি অনুযায়ী প্রতিবেশীর অনুমতি এবং ক্ষমা প্রার্থনা ভদ্রতার অংশ। দরজায় কড়া নাড়তেই সত্তরের সেই হাস্যোজ্জ্বল বৃদ্ধ বেরিয়ে এল। কড়া নাড়ার কারণ বলতেই বললেন, একদম চিন্তা কোরো না। আমরা বিরক্ত হব না। তোমার নামটা কি? আমার নাম অ্যালান গর্ডন। ৬০ বছর ধরে এই বাড়িতে আছি।

বিলেতের অধিকাংশ বাড়ি অনেক পুরোনো। ১০০ বছর বা তারও বেশি। সেখান থেকেই শুরু। অ্যালান আমাদের জীবনের একটা প্রাত্যহিক অংশ হয়ে উঠলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় প্রতিদিন অ্যালানের সঙ্গে দেখা। অ্যালান তাঁর গাড়ি পরিষ্কার করছেন। রেডিও চলে গাড়ি থেকে। বিবিসির রেডিও ফোর।

অ্যালানের গাড়ি একটা জাদুঘর। মোবাইল চার্জ দেওয়ার যন্ত্র থেকে শুরু করে গাড়ির ভেতরে ক্যামেরা, ছোট্ট ফ্রিজ, কম্বল কি নেই সেখানে। গাড়ির ছোট বা বড় মেরামত করার সব জিনিস মজুত গাড়ির পেছনে। বিলেতের প্রচণ্ড ঠান্ডায় প্রতিদিন সকালে অ্যালান নিয়মিত তাঁর গাড়ির যত্ন নেন। তাঁর বাড়ির পেছনের বাগান ছবির মতো। অ্যালানের স্ত্রী ক্যারল বাগানের দেখাশোনা করেন। বাগানের পাশে ছোট্ট একটি ঘর। সেখানে অ্যালান প্রায়ই সন্ধ্যায় থাকতেন।

বিলেতে প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা হয় বাড়িতে ঢোকা বা বেরোনোর সময়। কেমন আছ? আজ প্রচণ্ড ঠান্ডা তাই না। এই ধরনের। অধিকাংশই একে অপরের নাম জানে না। একে অন্যের বাড়িতে ঢোকা সচরাচর দেখা যায় না।

অ্যালানের সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক মাস যেতেই অ্যালান বলল, আমার বাড়িতে এক কাপ চা খাবে? বার কয়েক এড়িয়ে গেছি। একদিন আর না বলতে পারলাম না। অ্যালান একা বাড়িতে। ভেতরটা দারুণ গোছাল। কোথাও এককণা ধুলো নেই। আমি যেন অবাক হলাম। তার ঘরজুড়ে অনেক বই, ম্যাগাজিন আর ছোট ছোট খেলনা ট্রেন। তার শখ ছোট ছোট খেলনা ট্রেন সংগ্রহ করা। বইগুলো অধিকাংশ ইতিহাস আর বিজ্ঞানের। অ্যালান অবসর নিয়েছে কি না বা কী করে বা করত, জানা হয়নি তখনো। নিজেই বলতে শুরু করলেন এবং জীবনে করেননি এমন কোনো কাজ নেই।

এখন অবসর নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা কাজ করেন। আমি একটু অবাক হলাম। অবসর নেওয়ার পরও সাত-আট ঘণ্টা কাজ। তাহলে আগে কয় ঘণ্টা কাজ করতেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেই হেসে বললেন, কাজ ছাড়া বাঁচব কীভাবে?

বাগানের পাশে অ্যালানের ঘরটির কথা বলেছিলাম। সেটি হলো তাঁর ওয়ার্কশপ। লেদ মেশিন থেকে শুরু করে ছোট–বড় মাঝারি মানের ইলেকট্রনিক করাতেন। লোহা থেকে কাঠ কাটার বা বাঁকা করার সবকিছু আছে। আস্তে আস্তে জানলাম বাড়ি তৈরি থেকে গাড়ি তৈরি—এমন কোনো কাজ নেই অ্যালান জানেন না। সারা দিন চেনাপরিচিত বন্ধু আর স্বজনদের সাহায্য করাই তাঁর সাত-আট ঘণ্টার প্রতিদিনের কাজ। অবশ্য সবটা বিনা মূল্যে নয়, মজুরি নিয়ে। ছুটির দিনগুলোতে অ্যালান বাগানে বসতেন। রেডিও চালিয়ে হাতে চা বা কফি নিয়ে। আমরা গেলে নিজ থেকে কথা বলতেন।

সারা বিশ্বের রাজনীতি থেকে সমসাময়িক বিজ্ঞান সবই তাঁর জানা। আমি শুরুতে অবাক হতাম তাঁর জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে। একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, স্কুলের পর তাঁর আর পড়া হয়নি। ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসী ইহুদি তাঁর পূর্বপুরুষ। বিদেশের মাটিতে টিকে থাকতে অন্যদের মতো কাজ করে টাকা আয় করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ইউরোপ আর আমেরিকায় ইহুদি অভিবাসীদের সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো কাজ। এক পুরুষ চোখ বুঝে কাজ করেছে সন্তানদের মানুষ করার জন্য বিরামহীন। পরের প্রজন্ম জ্ঞান-বিজ্ঞান বা ব্যবসার অন্য সব অভিবাসীকে ছাড়িয়ে গেছে।

বিলেতে সাধারণত পাড়াতে বাড়ির সামনে জটলা করে আড্ডা দেখা যায় না। আড্ডাপ্রবণ জাতি হিসেবে গ্রিকদের নাম আছে। লন্ডনে যে এলাকায় গ্রিকদের বাস, সেখানে গরমে বাড়ির বাইরে আড্ডা হয়। আমাদের পাড়াতে গরমকালে ছুটির দিনে অ্যালান সকাল থেকে বাইরে চেয়ার দিয়ে বসে পড়ে। আস্তে আস্তে অনেক প্রতিবেশী সেখানে যোগ দেয়। মধ্যমণি সেই অ্যালান। নিয়ম করে ক্যারলকে নিয়ে বছরে দুবার বিদেশে ঘুরতে যাওয়া তাঁর রুটিন। ভ্রমণ–পরবর্তী বর্ণনা নিয়মিতভাবে আমাদের শুনতে হতো। একবার জাপান গিয়ে তিনি জাপানিদের ব্যবহারে এত মুগ্ধ হয়েছিল যে তাদের ভাষা শিখতে শুরু করলেন ইউটিউব দেখে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও যে স্বশিক্ষিত হওয়া যায় তাঁকে দেখে আবারও বুঝলাম।

আমাদের বাড়িতে কোনো কিছু বিকল হলে অ্যালান জানলে প্রথমেই বলবেন, আমি ঠিক করে দেব। কোন চিন্তা কোরো না। অধিকাংশ মেরামতি বিমা কোম্পানি নিজ খরচে ঠিক করে। কিন্তু অ্যালান সে বাধা শোনেননি।

এক বছর ধরে তিনি অসুস্থ। হাসপাতাল যাচ্ছিলেন। ক্যানসার। চিকিৎসা নিয়ে আবার ফিরে আসেন তাঁর বাড়িতে। প্রিয় বাড়ি। আনাচকানাচে তাঁর যত্নের ছোঁয়া। আস্তে আস্তে তাঁর বাড়ির বাইরে আসা কমে গেল। রোববারের সকালে আদর মাখানো তাঁর ডাকগুলো অনিয়মিত হতে থাকে। মাঝেমধ্যে ভেসে আসে রেডিওর আওয়াজ। মাস কয়েক ধরে নিয়মিত অ্যাম্বুলেন্স আসতে শুরু করল। অ্যালানকে নিয়ে যায়। গত সপ্তাহে এ রকম একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল। আমার ছেলে আর তার মা মাঝে প্রতিদিনই জানার চেষ্টা করে অ্যালেন ফিরলেন কি না। গতকাল সন্ধ্যায় অ্যালানের ছেলে এসে বলে গেল খবরটা।

সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।