করোনা এবং লিবারেল বিশ্বব্যবস্থা, একটি পর্যালোচনা

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম প্রকাশ পেয়ে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) দ্রুত বিস্তারের ফলে ডব্লিউএইচও একে বিশ্ব মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্বের প্রতি সতর্কতা জারি করে। বর্তমান লিবারেল বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্ব প্রশাসনের ভূমিকা পালনকারী জাতিসংঘ এ মহামারিতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব পদক্ষেপ নিতে উদ্যত হয়েছে। এটি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিশ্বসমস্যা সমাধানের জন্য গড়ে ওঠা ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ (ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি) ধারণাটিকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে মহামারিটি মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘকে দ্রুত আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোকে প্রস্তুত করে এ রোগের চিকিৎসার জন্য ভ্যাকসিন এবং ওষুধ আবিষ্কারের জন্য গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডব্লিউএইচও মানব সুরক্ষায় ক্রমবর্ধমান বিপদের কথা উল্লেখ করে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সতর্ক করলেও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।

জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস করোনাভাইরাস–সংক্রান্ত এজেন্ডা নিয়ে জরুরি বৈঠকে এ সংগঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদকে ডাকেনি। বরং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণে করেই সন্তুষ্ট থাকে। ডব্লিউএইচওর সবচেয়ে প্রভাবশালী দুটি সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তেজনা ও বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ডব্লিউএইচওর বিরুদ্ধে চীনের অনুকূলে কাজ করার অভিযোগ এবং এই সংস্থার জন্য আর্থিক সহায়তা বন্ধের ঘোষণা বিদ্যমান সংকটকালীন পরিবেশে ডব্লিউএইচওর রাজনৈতিক ভিত্তি পুরোপুরি দুর্বল করে দিয়েছে। আসলে ডব্লিউএইচওর এই সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলমান বৈশ্বিক শাসন–সংকেটের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

তবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা ও সামর্থ্য নিয়ে বিতর্ক শুধু জাতিসংঘকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ নয়। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অনেক সহযোগিতা সংস্থার ব্যর্থতা এবং অকার্যকারিতা নিয়েও সমালোচনা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সুপ্রে ন্যাশনাল সংগঠন হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও বর্তমান মহামারি সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমন্বিত সহযোগিতা পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেনি; বরং দ্বিপক্ষীয় অর্থাৎ আন্তরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একে অন্যকে সহযোগিতা করছে। দক্ষিণ-ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো (ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স) ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর তাদের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ শুরু করে এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভিসামুক্ত যাতায়াতের জন্য বিদ্যমান শেনজেন চুক্তিটি কার্যত অচল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ৯ এপ্রিল জার্মানি-ইতালি কর্তৃক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোকে তাদের মধ্যকার পুরোনো বিভাজনকে ভুলে গিয়ে ‘ইউরোপীয় সংহতি’র ভিত্তিতে কাজ করার আহ্বান তাদের নিজেদের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যাকে সামনে এনেছে। সংকটকালীন ব্রাসেলসভিত্তিক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা এসব প্রতিষ্ঠানকে অর্থহীন করে তুলেছে। চীন ও তুরস্কের মতো রাষ্ট্রের ইতালি ও স্পেনের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে চিকিৎসা সাহায্য পাঠানোর ফলে এসব দেশের জনগণের সামনে সে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থার চিত্র ভালোভাবে ফুটে উঠেছে, যা ইউরোপের অনেক দেশে বিচ্ছিন্নতাকামী (উগ্র জাতীয়তাবাদী) আন্দোলনকে নতুন করে উসকে দিচ্ছে।

একইভাবে, ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পরে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা জি-২০ ও আজ কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর মার্চের শেষ সপ্তাহে টেলিকনফারেন্সে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্ব অর্থনীতির আসন্ন ধস ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সংহতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও চোখে পড়ার মতো কোনো কার্যকরী সিদ্ধান্তে পোঁছাতে পারেনি তারা।

সামরিক জোট ন্যাটোর পক্ষে করোনা মহামারি মোকাবিলায় কোনো ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। একটি ক্লাসিক প্রতিরক্ষা জোট হিসেবে ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে ন্যাটো তাদের কৌশলপত্রে সন্ত্রাসবাদকেই বিশ্ব নিরাপত্তার প্রধান হুমকি উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে। ২০১৪ সালে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা উল্লেখ করলেও ছিল না মহামারি রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের কী ভূমিকা হতে পারে, তার কোনো নির্দেশনা।

জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনের মতো দেশগুলোতে করোনার তীব্র আক্রমণের কারণে ‘ইউরোপীয় ডিফেন্স ২০২০’ নামে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ন্যাটোর ২৫ বছরের বৃহত্তম সামরিক মহড়া পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে গেছে। বরং ন্যাটোর ইউরো-আটলান্টিক জরুরি সহায়তা সমন্বয় কেন্দ্র মিত্রদের মধ্যে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্ভবত, করোনা–পরবর্তী ন্যাটোর প্রথম শীর্ষ বৈঠকে মহামারি রোগের বিরুদ্ধে লড়াই জোটের কৌশলগত এজেন্ডাতে অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে, যে সংস্থাটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং যার অবিশ্বাস্য সামরিক অবকাঠামো রয়েছে—এই সংকটকালে তা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কারণ, এতে হাজারো মানুষ মারা গেছে, যার মধ্যে একটি বড় সংখ্যায় রয়েছে ন্যাটোভুক্ত দেশের নাগরিক। ফলে এসব দেশের সাধারণ জনগণ এ সংস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে।

আজ রাজনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম বারবার বলছে যে করোনা–পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটবে এবং বিশ্বব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সংগঠনগুলো পুনর্গঠিত হবে। আসলে কতটা পরিবর্তন আসবে? গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ‘লিবারেল ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার’ কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি এবং তৎপরবর্তী অস্থিরতা, ৯/১১ ঘটনা এবং বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের মতো বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলেও বিগত ৭০ বছর যাবৎ জাতিসংঘের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূল কাঠামো এবং কার্যক্রমের বড় অংশ ধরে রাখতে সম্ভব হয়েছে। যাই হোক, বিশ্বের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া প্রতিটি তিক্ত মুহূর্ত বিশ্বব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সৃষ্টি করে কিছু পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে সমালোচনার পথ দেখিয়ে গেছে।

এক দশক ধরে বিশ্বব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে যে ক্রমবর্ধমান সমালোচনা হচ্ছে, তা জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দিকে তির ছুড়েছে। কারণ এটি বিশ্বব্যবস্থায় নতুন শক্তির সম্পর্ক (পাওয়ার রিলেশন) নিয়ে ধারণা দিতে পারছে না। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি পক্ষপাতদুষ্ট এবং বৈশ্বিক সংকট সমাধানে অকার্যকর বলে সমালোচনা চলছিল। তবে ন্যায্য প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতিসংঘের পুনর্গঠনের জন্য দাবিগুলো দুর্ভাগ্যক্রমে মোড়ল রাষ্ট্রগুলো তাদের অবস্থান ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে অগ্রাহ্য করে গিয়েছে। স্থায়ী পরিষদের পাঁচটি সদস্য রাষ্ট্রের বর্তমান মনোভাবের দিকে তাকালে এ কথা অন্তত বোঝা যায়, করোনা মহামারি বিদ্যমান লিবারেল বিশ্বব্যবস্থায় আমূল কোনো পরিবর্তন আনবে না।

যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতার পক্ষে থাকবে। যেহেতু এ রাষ্ট্রগুলো লিবারেল বিশ্বব্যবস্থায় আন্তনির্ভরতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের শক্তি ও অবস্থানকে সংহত করে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। বিশেষত রাশিয়া ও চীন স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, স্নায়ুযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে তারা লিবারেল বিশ্বব্যবস্থা থেকে সেটা পুষিয়ে নিয়ে দারুণ লাভবান হয়েছে। জি-২০–তে পাঁচ স্থায়ী সদস্যও রয়েছে এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ জি-২০ দেশগুলোর দখলে রয়েছে।

তবে এটা ঠিক যে জাতিসংঘের ব্যবস্থায় কোনো আমূল পরিবর্তন না হলেও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর ব্যাপারে রাষ্ট্রসগলোর দৃষ্টিভঙ্গির আংশিক পরিবর্তন অনিবার্য হবে। কারণ, করোনাভাইরাসটির প্রথম প্রাদুর্ভাব এবং পরবর্তী সময় মহামারি আকার ধারণ করে বৈশ্বিক হুমকিতে পরিণত হওয়া—এই পুরো সময়ে জাতিসংঘের কার্যত কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ সংস্থা ডব্লিউএইচও পরিস্থিতি বোঝার, ব্যাখ্যা করার, মোকাবিলা করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে একত্র করে সমন্বিত কোনো পদক্ষেপ নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। ফলে রাষ্ট্রসমূহ নিজেরাই নিজেদের মতো প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যত হয়েছে। রাষ্ট্রসমূহ এখন ‘সেলফ হেলফ’ (স্ব-সহায়তা) তত্ত্বের দিকে ঝুঁকছে এবং তাদের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু করেছে। ফলে সহযোগিতার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের ধারণার উপর যে ‘আন্তর্জাতিক সমাজ’ বিদ্যমান আছে, তার প্রতি রাষ্ট্রসমূহের দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে, তা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে কার দৃষ্টিভঙ্গি কতটা বদলাবে, তা নির্ভর করছে তার ভেতরকার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা ও বিদেশ নির্ভরতার মাত্রার ওপর।

*পিএইচডি গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, আঙ্কারা ইলদিরিম বেয়াজিত বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক। [email protected]