সকলের তরে সকলে আমরা

‘মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়া’ কথাটি আছে প্রবাদ-প্রবচনে। কিন্তু বায়বীয় আকাশ নয়। শত শত টন ওজনের ছাদ ভেঙে পড়েছিল তাঁদের মাথার ওপর। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সব থেকে বড় খাত বলে আত্মশ্লাঘায় স্ফীত, তৈরি পোশাকশিল্পের স্বল্প বেতনের শ্রমিক তাঁরা। চাকরি থেকে বরখাস্তের হুমকি দিয়ে হতভাগ্যদের বাধ্য করা হয়েছিল মারাত্মক ফাটল ধরা ভবনে ঢুকতে। পরের ঘটনা সারা বিশ্বের জানা। সাভারের নয়তলা রানা প্লাজা গত বুধবার তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ল হুড়মুড় করে। বৈশাখের রোদ-ঝলমলে দিনের আলো অগণিত মানুষের হূদয় আচ্ছন্ন করে ফেলা শোক-বেদনার অন্ধকার সরাতে ব্যর্থ হলো। লাশের পর লাশ এনে সারি করে রাখা হলো স্থানীয় অধর চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভরে গেল আহতদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যায়। আশপাশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও চিকিৎসা দেওয়া হলো বহুজনের। ভয়াবহতা দেখে অনেকেরই স্মৃতিতে এল একাত্তরের গণহত্যার কথা। ডেকে এনে হত্যাই তো করা হলো এই অসহায় লোকগুলোকে। তবে আর দুর্ঘটনা বলা কেন? চোখের সামনে এত বড় একটি ভবন ধসের বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই কারও অপেক্ষায় না থেকে মানুষ যে যেভাবে পেরেছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হতভাগ্য মানুষগুলোকে কংক্রিটের স্তূপ থেকে বের করে আনতে। নিজের জীবনেরও পরোয়া করেননি অনেকে। ওদিকে অতি দ্রুত ছড়িয়েছে এই ভয়াবহ ঘটনার কথা। দলে দলে মানুষ ছুটে এসে হাত লাগিয়েছেন উদ্ধারে। ওষুধপত্র, রক্ত, পানি—যা যা লাগে নিয়ে এসেছেন অকুস্থলে। এসেছে অ্যাম্বুলেন্স। নিজেরাই পথে দাঁড়িয়ে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। চিকিৎসক, শিক্ষার্থী ও তাঁদের সহযোগীরা নাওয়া-খাওয়া-বিশ্রাম ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চিকিৎসা দিয়েছেন শত শত আহত মানুষকে। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দমকল, রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউট-গার্লস গাইড, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা। ঘটনা যত বড়, যত বেদনাময়, যে উদ্ধার কাজ চলেছে তাও তত বিপুল, তেমনি মহৎ মানবিক মহিমায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত।তবে এই অনন্য মানবিক কর্মকাণ্ডে অনেকেই ছিলেন, যাঁরা নিজেদের ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। তেমন কয়েকজন জানিয়েছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা। ‘আমার চিকিৎসক জীবনে এক দিনে এত রোগীর চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। প্রথম দিনে সকাল নয়টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একটানা কাজ করেছি। দুপুরে ১০-১৫ মিনিটের জন্য বোধ হয় লাঞ্চ করতে গেছি। তার পর থেকে বসার সময় পর্যন্ত পাইনি।’ বলছিলেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমান। তিনি জানালেন, বন্যার পানির মতো রোগী আসছিল। দুই ঘণ্টার মধ্যেই ছাত্ররা নিজেরাই ১৫০ ব্যাগ রক্ত দিয়েছিলেন। হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এনামুর রহমান স্টোর খুলে দিয়ে যার যা প্রয়োজন সব ব্যবহার করতে বলেন। ফলে চিকিৎসা দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। প্রায় ২০০ চিকিৎসক, পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী, শতাধিক নার্স ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেদিন প্রায় ৪০টি জটিল এবং ৬০টির মতো মাঝারি ধরনের অস্ত্রোপচার করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে ওই দিন ৯০০ জনের মতো লোককে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। খলিলুর রহমান বললেন, পরে সপ্তাহ খানেক ধরে তাঁরা রোজ ১১-১৫ ঘণ্টা কাজ করেছেন। জীবিতদের পাশাপাশি ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃতদেহও বের হচ্ছিল একের পর এক। মৃতদেহগুলো বিশেষ ধরনের একটি ব্যাগে ভরে অ্যাম্বুলেন্সে করে আনা হচ্ছিল অধরচন্দ্র বিদ্যালয় মাঠে। ব্যাগ দিয়েছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। মৃতদেহ ব্যাগেও ভরিয়েছেন তাঁদের কর্মীরা। সোসাইটির যুব ব্রিগেডের বিভাগীয় উপপ্রধান মনির হাওলাদার বুধবার থেকে সোমবার পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থলের পাশের ক্যাম্পেই অবস্থান করেন। তিনি নিজ হাতে ১৩৫টি মৃতদেহ ব্যাগে ভরেছেন। মনির বলেন, মরদেহ ব্যাগে ভরার জন্য চারজনের একটি করে দল করা হয়েছিল। তবে এই কাজে তাঁর বিশেষ দক্ষতা থাকায় একটানা কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের পরেও তিনি প্রায় শতাধিক মরদেহ ব্যাগে ভরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলেছিলেন।উদ্ধারকাজে দমকল বাহিনীর কর্মীরা দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। বিশেষ করে ঘটনার পর তৃতীয় দিন থেকে পুরো কাজটিই করেছেন তাঁরা। ছাদের স্তরগুলোয় মেশিন দিয়ে গর্ত করে ভেতরে ঢুকে হতাহতদের তুলে এনেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সবচেয়ে ঝুঁকি নিয়েছেন কে? নির্দ্বিধায় দমকল বাহিনীর পরিচালক (অপারেশন) মেজর মাহবুব বললেন, ‘আমাদের ডুবুরি আবুল খায়ের’। ২৯ এপ্রিল সোমবার দুপুরে যখন তিনি উদ্ধার কাজের ফাঁকে দুপুরের খাবার খেতে এসেছিলেন অস্থায়ী ক্যাম্পে, কথা হলো তাঁর সঙ্গে। পঞ্চম দিন পর্যন্ত তিনি জীবিত উদ্ধার করেছেন ৮৩ জনকে। এর মধ্যে প্রথম দিন ৩৭ জন, দ্বিতীয় দিনে ২৪ জন, তৃতীয় দিন ১১ জন, চতুর্থ দিন ছয়জন এবং পঞ্চম দিন পাঁচজনকে তিনি উদ্ধার করেন। মৃত কত? সে হিসাব তিনি রাখেননি।চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে একটি মোটরগাড়ির মেরামতির গ্যারেজে ওয়্যারিং মিস্ত্রির কাজ করেন ইমরান হোসেন। টিভিতে খবর দেখে পরদিনই সাভারে এসে হাত লাগিয়েছেন উদ্ধারে। সাভার বাজারের পাশেই একটি হোটেলে থাকছেন। দমকলের কর্মীরা তাঁকে একটি বিশেষ মুখোশ দিয়েছেন। সেটি মুখে লাগিয়ে কাজ করছিলেন। ২৯ এপ্রিল সোমবার দুপুরে বিধ্বস্ত ভবনে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। এর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের ভেঙে পড়া গার্ডারে উদ্ধারকাজ করেছেন তিনি। তারও আগে শহরের টাইগারপাস ও খুলশীতে পাহাড়ধসের ঘটনায়ও উদ্ধারকাজ করেছেন তিনি। কিশোরগঞ্জের তাকিয়া সুলতানা মাত্র চার মাস আগে এনাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন প্রথম বর্ষে। চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠ ভালো করে শুরু না হতেই এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন তিনি। প্রথম দিন সহপাঠীদের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স থেকে আহতদের ট্রলিতে তুলে ঠেলে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছেন, স্যালাইন লাগিয়েছেন। মন তৃপ্ত হয়নি। দ্বিতীয় দিনে উদ্ধারেও হাত লাগিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে গিয়ে। রানা প্লাজার পাশের ধসে পড়া ভবনে ঢুকে আহত নারীকর্মীদের বের করে এনেছেন। এনাম মেডিকেলে তাকিয়া সুলতানা এবং সদ্য ইন্টার্নি শেষ করা নরসিংদীর অহিদুল ইসলাম জানালেন, ‘আমরা সবাই দুর্ঘটনার দিন থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৮-২০ ঘণ্টা করে কাজ করছি।’অনেককেই পাওয়া যাবে যাঁরা আত্মপর না ভেবে, কায়িক শ্রম, অর্থ, ত্রাণসামগ্রী দান—এমন নানাভাবে শরিক হয়েছেন এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের পর উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে। অঙ্গহানি হলো যাঁদের, তাঁরা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। যাঁরা প্রাণ হারালেন, তাঁদের তো আর ফিরে পাওয়ার কোনো উপায়ই নেই স্বজনহারাদের। এই বেদনা অপার। কিন্তু এমন ঘটনা তো দেশে ঘটেই চলেছে প্রতিকারহীন। কবীর সুমনের সেই গানটি মনে পড়ছে, ‘কত হাজার মরলে পরে মানবে তুমি শেষে/ বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে...।’