আয়নায় নিজের মুখ

মেজ আম্মু, মেজ আম্মু বলে বলে ঘরময় যে ছেলে গত দুই মাস আমার জীবনকে ভরিয়ে রাখল সেই ৯ বছরের ভীষণ দ্বিধাহীন ছেলে রাজকুমার চলে গেছে বাংলাদেশে মাত্র দুদিন আগে। সঙ্গে ছোট বোন শাহিনও চলে গেল। এখন আবার আমার সেই শূন্য ঘর। সকালের শান্ত ছুটির দিন। আমি ও আমার ছেলে নাইয়া। বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। মাত্র দুই মাসে বদলে গিয়েছিল অনেক অনেক রুটিন। সাদা হোন্ডা গাড়ি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়তাম যেকোনো সময়, যা আমি করি না কখনোই।

নিজের ঘরের সেটআপও বদলে দিয়েছিল শাহিন। আমাদের চার বোনের সবার ছোট শাহিন, কিন্তু আমরা বাকি তিন বোন জানি ও আমাদের সবার বড় বোন। ও যা বলবে সেটাই করতে হবে সবাইকে, কোনো নড়চড় নেই। ও যদি বলেছে মেজপা এটা করো, সেটাই করতে হবে আমাকে। সেটা একদিন আগে বা পরে, সেটা দেশে হোক বা বিদেশে হোক, আমরা সবাই শাহিনের ডিসিশনের কাছে দুর্বল।

কী অদ্ভুত এই সমীকরণ? সেই কবেকার টুকরো টুকরো কথা মনে পড়ছে। এই টরন্টো শহরে বোন দুই মাস বেড়িয়ে গেল সেই গল্প লিখে কী করব? এখন এক কলস চোখের পানি ফেলেই–বা কী করব? ইতিহাস এমনই সুদূরই অতীতে ফিরিয়ে নেয়। বারবার আয়নায় নিজেকে দেখতে বলে। কিন্তু আমরা মানুষেরা বোকার মতো বিশ্বাস করতে চাই সব নতুন করে শুরু করব। আসলে কিছুই নতুন না, মানুষ অসহায় তার নিজের কাছে। তার চেয়েও বেশি অসহায় তার নিজের স্বভাব আর নিজের কর্মফলের কাছে। তাই পুরোনোকেই ফিরে ফিরে বরণ করতে হয় সবাইকে।

১৯৯২-৯৩ সালের কোনো এক সকাল হবে, আমি জাহাঙ্গীরনগরে পড়ি। এক অনুষ্ঠানে শাড়ি পরতে হবে। ঢাকা থেকে ভোর সাড়ে ৬টার বাসে করে ছোট বোন শাহিনকে নিয়ে আসি। শাহিন তখন চারুকলার ছাত্রী, ভীষণ ব্যস্ত। জাহাঙ্গীরনগরের না হলেও বোন আমাকে শাড়ি পরিয়ে তৈরি করে ফিরে যায় সাড়ে সাতটার বাসে ঢাকায়। আমি রেডি হয়ে বসে থাকি ৩ ঘণ্টা, কারণ আমি জানি ও বিশ্বাস করি শাহিন আমাকে যেভাবে রেডি করে দেবে সেটা পৃথিবীর আর কেউ পারবে না। তেমনি ২৮ বছর পরেও আমার নির্ভরশীল স্বভাব আমাকে ফিরিয়ে নেয় অতীতে। অফিস থেকে ফিরেই হয়তো কোনো দাওয়াতে যাব, শাহিন বিছানার ওপরে আমার কাপড় রেডি করে রাখে।

এমন জড়াজড়ি করে বোনেরা বড় হওয়ার পরও, সময়ের ও জীবনের প্রয়োজনে আলাদা হয়ে যেতে হয়েছে বারবার আমাদের চার বোনকে। চার বোনের বাস তিন দেশে—বাংলাদেশ, আমেরিকার ডালাস, ফ্লোরিডা ও কানাডার টরন্টো। কিন্তু যোগাযোগ কমে না, ভালোবাসা কমে না, আমরা বিশ্বাস করি বোনেদের চেয়ে আপন আর কেউ হবে না কোনো দিন।

আমার সেই সবচেয়ে ছোট বোন শাহিন এসেছিল টরন্টোতে আমার বাসায়। চার বোনের সবার ছোট সন্তান রাজকুমার শাহিনের ছেলেও এসেছিল। সারা দিন হিংসা করছে আমার ছেলে নাইয়ার সঙ্গে, বারবার বলে শাহিনকে বলে মা তুমি কি নাইয়াকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসো? বলো মা, তাহলে কেন তুমি ওকে সব প্রশ্ন করো। ৯ বছরের ছেলে তবু ভালোবাসার পুরো হিসাব কড়ায়–গন্ডায় বুঝে নিতে চায়।

রাজকুমার আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে—মেজ আম্মু নাইয়া কিন্তু হোপলেস, নাইয়া কিন্তু একটুও ভালো না। তুমি ওকে বকা দাও, ওকে তুমি বাসা থেকে বের করে দাও। আমি বলি, শোন রাজকুমার আর মাত্র ৩ বছর আমি নাইয়াকে বাসা থেকে বের করে দেব, আর তোমাকে বাসায় নিয়ে আসব, ফাইন বাবু? তুমি রাজি? এভাবে কেটে যায় দুই মাস। রাতভোরে উঠে অফিসে চলে যাই আমি সেই দূরের শহরে। শাহিনের সঙ্গে সারা দিনে ১৫-২০ বার কথা হয় ছোট সেলফোনে, নাম ভেসে আসে লিটল সিস।

অফিস থেকে ফেরার পথেই শাহিনকে বলি বাচ্চাদের নিচে পাঠাও ব্যাগ আর বাজার নিতে হবে, বাড়িতে বাড়ি ফিরে টেবিলে খাবার রেডি পেতাম, এই বিলাসিতা বিদেশে কত বড়, যারা বাইরে থাকেন শুধু তাঁরাই জানেন। গত দুই মাসে শাহিন আমার সব দায়িত্ব নিয়েছিল, কোনো ফাঁকে ক্রেডিট কার্ডের ছবি নিয়ে ডলার অব্দি জমা দিয়েছিল সেটাও বলেনি আমাকে। নিজের খরচ হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে বলে জমানো ডলার নিয়ে বিল পে করতে গিয়ে দেখি, সেখানেও ম্যানেজ করে রেখেছে শাহিন। এই একটা জায়গায় আমাদের চার বোনের একটা অলিখিত চ্যালেঞ্জ আছে।

আমরা চার বোনই কাজ করি। কমবেশি হলেও নিজেরা উপার্জন করে জীবন চালাই। তাই জানি মানুষ সবচেয়ে বেশি অসৎ হয় অর্থের কাছে, মানুষকে সবচেয়ে বেশি চেনা যায় অর্থ দিয়ে, সেখানে ঠিক থাকা বড় কঠিন পথ। কিন্তু এই কঠিন ব্রত পালন করি আমরা সবাই। তাই হয়তো আমাদের বন্ধনে চিড় ধরে না। সবার নিজেদের আলাদা আলাদা জীবনকে সম্মান করার চেষ্টা করি আমরা। মাত্র দুদিনে টরন্টো এসে শাহিন আমার রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। একটা খাবার শেষ না করে আমাকে আরেকটা খাবার কিনতে দেয় না, একটা বাড়তি খরচ করার আগে ১০০ বার কথা শোনায়। আমি যা ১২ বছরে বুঝি না শাহিন সেটা ১২ দিনে ধরার চেষ্টা করে। টরন্টো শহরে আমার বন্ধুরা ডেকে বলে কী বলিস লুনা, তোর বোন এত ভালো। এত বড় সেলিব্রিটি, কতবার টিভিতে দেখেছি তাকে, কী ভালো গান গায়, কবিতা পড়ে। এত বড় ফ্যাশন ডিজাইনার কিন্তু কী ভীষণ ভালো, সবার সঙ্গে হৃদয় দিয়ে মিশছে। আমি মনে মনে আমার বাবা-মাকে স্মরণ করি নিজের মাকে দেখেছি সারা জনম একজন ফুল সেক্রেটারির সঙ্গে আম্মা যেভাবে কথা বলেছেন, একজন পিয়নের সঙ্গেও আম্মা সেভাবেই কথা বলেছেন। আমার মা উঁচু–নিচু বুঝতে পারতেন না, সে নিয়ে অনেক বিপদও হতো কিন্তু সেই বিপদ আমার মায়ের জন্য না, যাঁরা হীনম্মন্যতা ভুগতেন তাঁদের জন্য।

রাজকুমারের জন্য একদিন একটা বল কিনে ফিরছিলাম, শাহিন গাড়িতে বসে রাজকুমারকে বুঝিয়ে বলে ঢাকায় শাহিনের গাড়িচালক এই বল কেনার ডলার দিয়ে কত বেলা ভাত খেতে পারত। আমি যখন বিল পে করি শাহিন পেছন থেকে এসে ফিসফিস করে বলে কি মেজপা— কামাই করতে লাগে সারা মাস আর খরচ করতে ৩ মিনিট, তাই না?

একদিন বাড়ি ফিরে বলি, শাহিন আমার লেখার পাঠকেরা জানতে চাইছে আমি লিখছি না কেন? বড়পা, কনা, শাহিন মিলে আমার আড়ালে হাসাহাসি করে। আহা রে মেজপার লেখার প্রতিভা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাই না? সারা দিন আমি বাসায় থাকি না, কিন্তু শাহিন থাকত বাসায়, আমার এই ছোট সংসার উথাল-পাতাল করে গোছায় ও। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, ঘর নতুন করে গোছানো। একদিন এসে দেখি আমার ঘরে আরও একটা টেবিল। বলে মেজপা, লিখতে বসো। লেখা বাদ দেওয়ার দরকার নেই। আমি আয়নায় নিজের মুখ দেখি। জানি, নিজের যন্ত্রণার সঙ্গে বসতে না পারলে লিখতে পারব না। কোনো এক কবি বলেছিলেন, বেদনা ঘিরে না থাকলে কি সৃষ্টি করা যায়?

শাহিন চলে গেছে গত ২ দিন। আবার আমার শূন্য ঘর, আবার সেই পুরোনো দিন। বারবার আয়নায় সেই নিজেকেই দেখি, সেই পুরোনো আমি, যতবার নিজেকে বদলে ফেলতে চাই— ততবার সেই নিজের সঙ্গেই বোঝাপড়া।

* উন্নয়নকর্মী