রেসিজম বা বর্ণবাদ

লন্ডনে দুটি দুধের বাচ্চা নিয়ে কানেক্টিং ফ্লাইটের অপেক্ষা করছি। একটা আমার বুকে। আরেকটা হাতে ধরা, অন্য হাতে এদের দরকারি জিনিসের লম্বা ব্যাগ। পাশে বসা ব্রিটিশকে জিজ্ঞেস করলাম, কয়টা বাজে। এমন ভাব নিল! সময়টা কিন্তু বলে নাই। আমি এমন বাস্তুহারার মতোই নিজে নিজে ঘুরে বেড়াই অনেক কাল!

কাজের দিনগুলোর বাইরে আমি অলমোস্ট হোমলেসের মতো ঘুরে বেড়াই। আমি চাই না কেউ আমাকে চিনুক, এক্সট্রা সহযোগিতা করুক।

বিপদে যে পড়ি না তা নয়। সেই ২০ বছর আগে, কানেক্টিং ফ্লাইট ধরব বলে টেক্সাসের হোটেলে গিয়ে দেখি হোটেল বুক করা নেই! হাতে মোবাইল নেই। ফোন দিতে পারছি না, সেদিনও একা, হাতের মোবাইল না চাইতেও এগিয়ে দিলেন যে নারী, সে আমেরিকান! এরপর যখন কোনো সাহায্য অযাচিতভাবে পেয়েছি, তারা আমেরিকানই ছিলেন। আমি বায়াসড হতেও পারি।

এখানে এত বছর ড্রাইভ করি, পুলিশ টিকিট পাইনি। থামিয়েছে, সাহায্য করে ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশদের ট্রিটমেন্টও দিয়েছি। লাস্ট টাইম যে থামাল, ভাবলাম কী করেছি? বলে তোমার লাইট অন নেই। অন করো—সন্ধ্যা হয়েছে বলে। খারাপ ব্যবহার পাইনি বলে লিখতে পারছি না।

কিন্তু কাজের সময় এরা কতটা ফিয়ার্স তাও জেনেছি। আমারই পাশের বাসায় এক নারী একা থাকতেন। তার বাসায় লেগে থাকা পার্টিতে আমি ভয়ানক বিরক্ত থাকতাম। ওর বাসা রেইড দিল দিনের বেলা। আমি আমার বাসার পেছনে লোক দেখে অবাক হয়ে পোর্চের দরজা খুলতেই চিল্লিয়ে ঘরে যেতে বলল আমাকে। লোকটির অভব্যতায় ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলাম সেদিন। পরে জেনেছিলাম, পাশের বাসার সেই নারীকে ধরতে এসেছিল। হয়তো গোলাগুলির ভয়ে আমাকে ভেতরে যেতে বলেছিল। এদের সবার হাতে গান থাকা অসম্ভব নয়।

কালোদের সঙ্গে কাজ করি। অসম্ভব অ্যাপ্রিশেয়েট করি, যারা ভালো কাজ করে তাদের। এরাও জানে ধানাইপানাই করে আমার সঙ্গে কাজ করা যাবে না। সাদা–কালো সবার মধ্যেই অলস কিছু থাকে, আমাদের মধ্যে, সাউথ আমেরিকানদের মধ্যেও আছে। সবখানেই আছে।

কালোদের সাইডে দোকানপাট খোলে না। খোলে না মানে, নাই। শহরের গরিব পাড়ায় থাকে বেশির ভাগ। দোকানপাটে লুটপাটের ভয়। ওয়ালমার্টও নেই। কালোপাড়ার ছোট ছোট ছেলেগুলো প্রতিদিন মার খেয়ে আসত ক্লিনিকে—নিজেরাই মারামারি করে। যে নেইবারহুডে কালোরা আসা শুরু করে, সেখান থেকে সাদারা যারা পারে চলে যায় অন্য কোথাও।

আমেরিকায় মাস ট্রান্সপোর্ট নেই, কারণ কালোরা যেন পশ নেইবারহুডে না যায় এবং সেখানে গিয়ে লুটপাট না করে।

ব্রাউনরা বেশির ভাগই শিক্ষিত। তাদেরও গায়ে যখন কারির গন্ধ থাকে, সবাই নাক কুঁচকায়। ব্রাউনদের নিজ যোগ্যতায় আমেরিকায় অবস্থান তৈরি করতে হয়। সেটা অনেকের চক্ষুশূল।

চায়নিজও তাই। এরা সব কম্পিটিশনে ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে এগিয়ে থাকে। মেক্সিকানরা হোটেল–মোটেল, ঘরবাড়ি ক্লিনিংয়ে একচেটিয়া—হাম্বল লোকজন।

কালো ভিন্ন সমস্যা। অপ্রেশন আছে কিন্তু সমস্যার গভীরতা আরও ভেতরে। বেশির ভাগই সিঙ্গল মাদার। কোনো মেল আইডেন্টিটি ফলো করার মতো বাবা আদর্শ এদের নেই, অথরিটি/কন্ট্রোল নেই। ভালোবাসা নেই। পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। যাদের আছে, তারা লেগে থাকে ভালো করে, নিজের এবং তার পরিবারের জীবনে পরিবর্তন আনে। এদের অনেকের যেমন বাবা নেই, তেমনি অনেকে জীবনে মাকেও দেখে না। জন্ম দিয়ে দাদি বা নানির হাতে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ সমস্যা গরিব সাদাদেরও। সেখানে থেকে যারা ভালো হয়ে আসে, সেটা তাদের যোগ্যতায়।

আমাদের দেশে যেটা বস্তিতে হয়। আশপাশের মানুষ খেতে দিলে খায়, নয়তো নয়। এদের তো আশপাশের লোক খেতে দেয় না। সরকারি সাহায্য আর স্কুলের ব্রেকফাস্ট আর দুপুরের খাবার ছাড়া বেশির ভাগ বাচ্চা না খেয়ে থাকে। অনেকে আবার সেই ভাতার লোভে কাজ বাদ দিয়ে বছরের পর বছর বাচ্চা নেয়, হয়তো প্রত্যেকটা বাচ্চার বাপ আলাদা—যাদের কোনো সেন্স অব রেসপনসিবিলিটি নেই! কারণ এরা তা দেখে বড় হয় না। এরা শুধু ইন্দ্রিয়সুখটাই চেনে। না যদি মেলে, হাত মুছে নতুন সম্পর্ক। কাজ করে, খায়, উড়ায়, একদিন মরে যায়। বাবা–মার ১৮ বছরের পর কোনো দায়িত্ব নেই। ১৪-১৫–তে বেশির ভাগই নিজের হাত খরচ জোগাড় করে, নিজকেন্দ্রিক জীবন। আমাদের দেশে ১৩-১৪ বছরে পরিবার বিয়ে দেয় বয়স্ক লোকের সঙ্গে, মেয়েগুলোর বাচ্চা হয়, এরাও বাচ্চা নেয় সেই বয়সে, তবে বিবাহছাড়াই আর সমবয়সীদের সঙ্গে! বাচ্চা হলেই মেয়ে বা মেয়ের ফ্যামিলিটাই সাফার করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটি। ছেলে কোনো দায়িত্ব নেয় না, পারলে মাঝেমধ্যে চাইল্ড সাপোর্ট দেয়। নয়তো নয়। ছেলের ফ্যামিলির কোনো দায়িত্ব নেই। মেয়ের লাইফ সেখানেই আটকে যায়, না পড়াশোনা, না বড় চাকরি—বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ ঠনঠনে।

আমার কালো পেশেন্ট ভালো বলেছে, ‘এখন যত কালো বিলিয়নিয়ার আছে, কয় বছর আগে এত কালো মিলিয়নিয়ারও ছিল না, কিন্তু পয়সা ওই কয়জনের হাতেই আটকানো—এরা কমিউনিটির জন্য কিছু করে না।’

একদিকে ভাবলে এদের স্বভাব আমাদের কিছু বিলিয়নিয়ারের মতোই—নিজের ছাড়া কমিউনিটির জন্য কিছু অবদান নেই।

আমি কারও পক্ষে–বিপক্ষে কিছু বলব না। আমার সে রাইট নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য ভালো কিছু না করে আরও অন্যায় করার সাপোর্টও করছি না। কিন্তু এরা ভালো কিছু পাওয়ার এমন সুযোগ এভাবে নষ্ট করল বলে দুঃখ!

পয়সা তো ইনস্যুরেন্স কোম্পানির যাবে, তারাও হয়তো দেওলিয়া হয়ে যাবে!

এরা এটা ভুলে গেছে লাইসেন্স প্লেটের নম্বর দেখে এক স্টেটের গাড়ি অন্য স্টেটে ট্রাফিক নিয়ম না মানলে ও প্রপার জায়গায় ফাইন চলে যায়, আর আজ এত সিসি টিভি, ফেসবুকের যুগে এসব লোকদের খুঁজে বের করা ১-২ মিনিটের ব্যাপার।

রেসিজম একটা মানসিক সমস্যা। প্রপার অথরিটি বা লিডারশিপ না থাকলে বা অথরিটি উসকানি দিলে কী হয়, তা আমরা আমেরিকায় দেখি, ইন্ডিয়াতে দেখি, মিডিলিস্টে দেখি, মিয়ানমারে দেখি, চায়নায় দেখি, প্যালেস্টাইনে দেখি, আফ্রিকায় দেখি, নিজের ঘরেও দেখি— সব জায়গায় দেখি। মানুষের মনে যা ছিল, এদের সাহস পেয়ে তা মুখে চলে আসে, কাজে প্রকাশ পায়। হিন্দু মরে, মুসলমান মরে, টার্ক মরে, কুর্দিস মরে, খ্রিষ্টান মরে, বৌদ্ধ মরে, হুতু মরে—ইহুদিদের রাগ তো এখনো পড়ে না! এর মধ্যেও ভালো কিছু মানুষ থাকে, যারা সাম্যবাদী; চেষ্টা করে ব্যালান্স করতে! না হলে কেয়ামত তো দুনিয়ার বুকেই।