করোনার শিকল-২

মধ্যরাতে সেলফোনের নীলাভ আলো জ্বলে ওঠে, ঢাকা থেকে ফোন। প্রতিমুহূর্তে প্রস্তুত রাখছি নিজেকে, নিজের মনকে। আব্বার যেকোনো খবর যেকোনো মুহূর্তে আসবে। একটাই প্রার্থনা কম কষ্ট পাক আব্বা। বয়স হয়েছে। একটা গোটা জীবন পা করেছেন আব্বা। ৮৪ বছর বয়স একটা সম্পূর্ণ জীবন পার করেছেন, আর কি চাওয়ার আছে? তবু যতক্ষণ বেঁচে আছেন ততক্ষণ হয়তো একটাই কথা বেঁচে তো আছেন।

আসলে একটা কথা আছে বাংলায়, ‘যার যায় সে জানে’। আমার এক বন্ধুর বাবা ১৮ বছর নার্সিং হোমে বেঁচে ছিলেন। শুধু মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারতেন। আমেরিকায় ছিলেন। আমাদের ভীষণ পারিবারিক বন্ধু ওরা, এক ছেলে, এক মেয়ে—সবাই আমেরিকায় থাকেন। ১৮ বছর ওদের বাবাকে নার্সিং হোমে নিয়ে ওরা বেঁচে ছিলেন। আমরা দূর থেকে বলতাম, কেন বেঁচে আছেন আঙ্কেল? কেন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখছেন তাঁকে? কিন্তু এই মুহূর্তে ভাবছি, যাদের বাবা, তাদের কাছে তো আঙ্কেল পৃথিবীর সেরা সম্পদ তাই না? ওরা ভাবত প্রতিমুহূর্ত, আমাদের বাবা বেঁচে আছেন আমাদের সঙ্গে। এইভাবেই হয়তো ওদের কাছে ওই ১৮ বছর এখন মাত্র ১৮ মিনিট মনে হয়, তাই না?
বাবাকে গত রাতে (৬ জুন) হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এই করোনাকালে বাবা হাসপাতাল পেয়েছেন, মাত্র ১ দিনের মাথায় থাকার জন্য কেবিন পেয়েছেন। প্রতি ঘণ্টায় ডাক্তার নিবিড় দেখাশোনা করছেন, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে মামা দেখাশোনা করছেন। মিলন মামা, ছোটবেলা যে মামার সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়েছি আমরা চার বোন। মামা সেই বিরল সৌভাগ্য আর ঝুঁকি নিয়ে বাবার দেখাশোনা করছেন। একটা কথা না বললে নয়, এই মামা ছিলেন আমাদের ছায়া। আমরা রংপুর থেকে ঢাকায় এলাম মামা আমাদের সঙ্গে এলেন। বাবার সরকারি চাকরি, তাই যেখানেই বাসা বদল হতো মামা আমাদের সঙ্গে আছেন অবধারিত। একবার ১৯৮০–৮১ সাল হবে, আমরা কলাবাগানে থাকি, আম্মা মিলন মামাকে বাসা থেকে বের করে দিল, সেকি রাগ আম্মার। তুই আমার বাসায় আর ঢুকবি না মিলন। মামা গিয়ে সিঁড়ি গোড়ায় বসে থাকেন, আমি গিয়ে কলা আর পানি পৌঁছে দিই। মিলন মামা অপেক্ষা করে আছেন আব্বা অফিস থেকে ফিরবে এই সিঁড়ি দিয়ে, তাই হয় শেষ পর্যন্ত আব্বা ফিরলে মিলন মামা কেঁদে পড়ে আব্বার কাছে, ‘দুলাভাই, বুবু বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না।’ আব্বা বলেন, ‘আয় আমার সঙ্গে আয়, ব্যস মীমাংসা হয়ে গেল। মাত্র ৩ মাস আগে এই মামা এখন বাসা নিয়েছে আমাদের পাশের গলিতে। আব্বার এই চরম সময়ে অন্তিম সময়ে মিলন মামা এখন একমাত্র মানুষ। এই মামা এসেছেন এখন আমাদের জীবনে দেবদূতের মতো। কিন্তু মামার নিজেরপরিবার আছে, নিজের জীবন আছে, যেকোনো মুহূর্তে কোভিডে আক্রান্ত হতে পারেন মামা? কেন ঝুঁকি নিচ্ছেন মামা? কেন মামা সেবা করছেন বাবাকে, বাবার মতো বড় দুলাভাইকে কেন আগলে রাখছেন এই মামা? জীবনের কি কোন গোছানো উত্তর আছে কোথাও?

দেশে প্রতিটা মানুষের মনে ভয়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে ভীষণভাবে। সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক, আমার মা দেশে একা, মায়ের বয়স হয়েছে। যেকোন সময় আক্রান্ত হতে পারে আম্মা। কী করব তখন আমরা? কী অসহায় আমরা ছোট একটা জীবাণুর কাছে। সবচেয়ে ছোট বোন যে গত ১৬ বছর আব্বা-আম্মার সব সব দায়িত্ব নিয়েছে হাসিমুখে। আমরা বাকি ৩ বোন বারবার জানতাম শাহিন আছে বলেই আমরা এতটা ভরসা করে বিদেশে আছি। সেই বোন শাহিন গত ৬ মাস টরন্টোতে আটকে গেছে কোভিডের কারণে। কত ইতিহাস রচনা করল কোভিড-১৯? যার যার গেছে একমাত্র তারাই বুঝি বলতে পারবে আজকে এইটুকু তো ভীষণ সত্য। একমাত্র কোভিড আটকে দিল আমাদের সবাইকে। মাঝরাতে ছোট বোন শাহিন জানায়, কারও মুখে কথা নেই, শাহিন বলে, মেজপা টরন্টো থেকে কবে নেক্সট ফ্লাইট বাংলাদেশে যাবে কেউ জানে না। এখন বাংলাদেশে যেতে গেলে অটোয়া বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে আলাদা করে লন্ডনের ভিসা নিতে হবে কারণ প্লেন লন্ডন হয়ে যাবে এদিকে ভোররাতে আব্বাকে খাবারে জন্য টিঊব পরানো হয়েছে। সবাই বলছেন, তোমার বাবা যে এই করোনাকালে হসপিটাল পাচ্ছেন, সেবা পাচ্ছেন, ডাক্তার পাচ্ছেন, মানুষ হাতের কাছে পাচ্ছেন এই জন্য এখনই নামাজ পড়তে বসা উচিত তোমাদের। নিশ্চয় তাই, আজকে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জীবন অনিরাপদ। কেউ বলতে পারবে না সে করোনার শিকার কি না, কেউ বলতে পারবে না আগামীকাল সে কোভিড আক্রান্ত হবে কি না—এমন অবস্থায় বাবাকে যে বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে হচ্ছে না, এই তো হাজার হাজার শোকর।
কিন্তু কি জানেন, এই যে লিখছি, এই যে টাইপ করছি, এই যে ব্যথা বহনের ভার লাঘব করছি নিজেকে প্রকাশ করে এইটাই এখন পথ। সরদার ফজলুল করিম স্যার বলতেন, ‘বাবা–মায়েরা একটা জীবন দেয় সন্তানদের, আর কী দেবেন তাঁরা?’
মাঝরাতে খালাতো বোন ডাক্তার প্রীতি ফোন করেছিল বাংলাদেশ থেকে। বলে আপু, এই যে জীবনের এত আয়োজন, কী হবে আপু, এত অল্প সময় বাঁচি আমরা, এত অল্প সময় কেন বাঁচি? এর জন্য কি এত আয়োজন আপু? যেকোনো মানুষ যদি ৫০০ বছর বাঁচতে পারত তাহলে এই জীবনের ব্যাপক আয়োজন সফল হতো—জানেন আপু, গত ৩ মাস নিজের মেয়েকে দেখি না, বাবা-মাকে দেখি না, হোটেলে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এই কোভিডের কারাবাস কবে শেষ হবে কেউ জানি না আমরা।
প্রীতির কথা মাঝরাতে আবার টনক নাড়িয়ে দেয়। এই এক জীবাণু অসহায় করে দিল গোটা দুনিয়া। বিশ্বাস করেন পাঠক, এত দিন বুঝতে পারিনি, বাবা-মা ভালো ছিলেন, আমরা চার বোন বিদেশে আছি, নিরাপদে আছি এখনো। কিন্তু মাত্র দুই দিনে যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। পথে না বের হলে তো পথ চেনা যায় না তাই না? আব্বা হসপিটালে, আব্বাকে মাঝরাতে খাবারের জন্য নল লাগানো হয়েছে। সবকিছু ডাক্তারদের সাজেশনেই চলছে। কিন্তু এই যে যেতে পারছি না, বাবার কাছে গিয়ে বসতে পারছি না, বিদায়ের আগে বাবার মাথায় হাত দিতে পারছি না, মায়ের কাছে গিয়ে বসতে পারছি না চার বোন এই ভোগান্তির একমাত্র কারণ করোনা। অন্তত আমার চোখে তো আর কোনো বাধা নেই দেশে যাওয়ার, তাহলে কোনো অদৃশ্য শিকলে বাঁধা পড়ল এই জীবন?

কেন বেঁচে আছি—একদিন হয়তো করোনার ভ্যাকসিন বের হব । হয়তো শিগগিরই বের হবে। কিন্তু আমার বাবা ৮৪ বছরের বাবার কি আয়ু আরও ১৮ বছর বা আঠারো মাস, বা আর মাত্র ৬ মাস? কব জীবন থেকে এই করোনা শেষ হবে? আর কত হারানোর পরে জয় হবে মানুষের? মাথা কাজ করে না, অনুভূতি কাজ করে না, বোধ কাজ করে না, একবার বলি বাবা কম কষ্ট পাক, একবার বলি, আহহা যদি রওনা দিতে পারতাম, দেখতে পারতাম আব্বাকে। এক চামচ পানি বা একবার আব্বার মুখটা দেখতে পারতাম। এই যে আব্বা আব্বা করে ১৭ হাজার মাইল দূর থেকে ডাকছি, কার কাছে যাব এখন?

আরও পড়ুন: