করোনার শিকল ৩

টরন্টো টাইমে এখন বিকেল চারটা। আসুন, পাঠক অন্য কথা বলি, দেখি পারি নাকি? 

আমি ১২ বছর বাংলাদেশে গরিব মানুষের সঙ্গে কাজ করে বিদেশে এসেছি, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কাজ করেছি মূলত। বাবা সরকারি চাকরি করেছেন ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত। আমরা পালিত হয়েছি বাংলাদেশ সরকারের ছায়ায়, সবচেয়ে সুবিধাভোগী মানুষের ভেতরে আমরা বড় হয়েছি। আমার বাবা সেই বলয়ে লালন-পালন করেছেন আমাদের। আজকে এই মুহূর্তে আমার বাবাকে দিয়ে যদি সারা দেশের অনাচার-অব্যবস্থা আর দেশের বিপন্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বারবার বলি, সেটা মনে হয় কিছুটা দেশের প্রতি অমানবিক হয়, নাকি হয় না?
আব্বার করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসার পরে অবস্থা শতভাগ উল্টে গেছে। এখন আবার সব নতুন করে আয়োজিত হচ্ছে। কারণ, যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ তো আশা আছে, নাকি সেটাও ছেড়ে দেব? মাথা কাজ করছে না, তাহলে লেখা গুছিয়ে আসে কী করে? কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে ব্যস্ত রাখার একটাই উপায় জানা আছে, তা–ই করছি আমি। একান্ত মনের সঙ্গে কথা বলছি। আব্বা একা হসপিটালে নিথর হয়ে পড়ে আছেন, এই মুহূর্তে তিনি নিশ্বাস নিতে পারছেন কি না, আমি জানি না। আরও কী অসহায় দিন অপেক্ষা করে আছে আমাদের পরিবারের জন্য, আমাদের চার বোনের জন্য বা একান্ত আমার জন্য জানি না। এই একটা জীবনে বাবাকে নিয়ে এমন লেখা কোনো দিন লিখব, কোনো দিন এমন অনুভূতি হবে, কোনো দিন এমন অসহায় লাগবে—চার–পাঁচ ঘণ্টা আগেও ভাবিনি। কোভিডের এই পুরো সময়টা জুড়ে যত অমানবিক খবর পড়েছি, জেনেছি বা চিন্তা করেছি, আমার এই মুহূর্তের মনের অবস্থা সব খবর ছাড়িয়ে গেছে। দেশে হেন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে যোগাযোগ করা হয়নি, হেন কোনো মানুষ নেই যাদেরকে অনুরোধ করা হচ্ছে না। হয়তো একটা ব্যবস্থা হবে, হয়তো কিছু হবে না কিংবা হয়তো এমন কিছু হবে, যা কোনো দিন চিন্তা করিনি, যা কোনো দিন স্বপ্নেও আনিনি।
একটা দেশে যখন সবাই ঝুঁকির মধ্যে থাকে তখন কি শুধু একজনের কথা ভাবা উচিত? বিশ্বাস করেন পাঠক, মাত্র তিন দিনে মনে হয় নিজের সব অনুভূতি বদলে গেল। এত দিন বারবার শুনতাম করোনার রোগী নিয়ে নানান কথা, কিন্তু আজকে তো সেটা আমার বাবা? এখন পথ কোথায়? এই লেখার একজন পাঠক যদি আমাদের পরিবারকে চিনে থাকেন তাঁরা জানেন, ঢাকা শহরের ক্ষমতাবলয়ের সব জায়গায় যোগাযোগ করা হয়েছে, শেষনিশ্বাস অব্দি বাবাকে নিয়ে সব চেষ্টা করা হবে। কিন্তু ওই যে আমার ‘করোনার শিকল ২’ লেখায় বাংলাদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি প্রশ্ন করেছেন, বাংলাদেশের যেসব পরিবার তাদের স্বামী-বাবা-মা-সন্তান আর ভাইবোনদের করোনার চিকিৎসার জন্য হসপিটাল তো দূরে থাক, কোনো ডাক্তারের দেখাও পায়নি।

মাত্র দুই মাস হয়নি এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করা ডাক্তার জিয়া হায়দারের মা চলে গেছেন করোনাকালে। অনেক দিন অব্দি আমি ফেসবুকে দেখেছি, জিয়া ভাই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে হাজারো আপডেট দিচ্ছেন, হাজার রকমের প্রশ্ন তুলছেন। মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম, ভেবেছি নিজের মা মারা গেছেন বলে কি জিয়া ভাই দেশ উল্টে ফেলবেন নাকি? আজকে এই মুহূর্তে, আমার বাবা পড়ে আছেন হসপিটালে নিথর হয়ে। আমি তাঁর সন্তান, বাবাকে সেবা করার জন্য একটা পরিচিত মানুষ যাবে না, যেতে পারবে না। এ মুহূর্তে আমাদের কাছে সব অনিশ্চিত, জিয়া ভাই কি এমন অনুভূতি থেকেই ফেটে পড়েছিলেন?

নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই মূলত এই লেখা লিখছি। ভাবার চেষ্টা করছি একদিন যে বাবা গর্ব করে মানুষকে বলতেন, তাঁর মেয়েরা দেশের বাইরে আছে, নিরাপদে আছে, ১৬ বছর ধরে নিজেদের প্রস্তুত রেখেছি এমন দিন আসবে যেদিন আমাদের দেশে যাবার পথ থাকবে না, আজকে কি সত্যিই সেই মুহূর্ত? এই করোনা কি আমার মতো হাজারো মানুষের অনুভূতি এক করে দেয়নি?

জিয়া ভাই কি নিজেকে মানাতে পেরেছিলেন যে তাঁর পরিবারে পাঁচজন বিখ্যাত ডাক্তার, কিন্তু তাঁর মা পর্যাপ্ত চিকিৎসা না নিয়ে মারা যাবেন? যে মা পাঁচজন সন্তানকে ডাক্তার বানাতে পারেন, সেই মা কি এই পরিণতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখেন?
একদম গ্রাম থেকে উঠে আসা বাবা সরকারি চাকরি শেষ করেছেন সরকারের একজন যুগ্ম সচিব হয়ে। আজন্ম দেখেছি বাবাকে বাংলাদেশ ‘স্যার’ ডাকছেন একজন শিক্ষক হিসেবে, একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে, একজন স্বশিক্ষিত মানুষ হয়ে। শূন্য থেকে যিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন, তাঁর মেয়ে হয়ে কোনো দিন জানতে পারিনি বিপদ কী করে আসে?

আমাদের সেই বাবা, যিনি চার কন্যাসন্তানকে জন্ম দিয়ে হয়তো অনেক রক্তচক্ষু দেখেছেন। তারপর একদিন যখন সেই বাবা-মা এই চার মেয়ের জন্য সবার কাছে সম্মানের হয়েছেন, সেই বাবার শেষ যাত্রা কি এমন হবার কথা ছিল? আমরা কি ভেবেছি, এমন দিন আসবে আমাদের সামনে? কোনো বোধ কাজ করছে না, মাথা শূন্য লাগছে, হালকা লাগছে।
এই লেখার সময় কাল মোট চার ঘণ্টার মতো হবে। মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে জেনেছি আব্বা কথা বলেছেন, ভালো আছেন একটু। বাংলাদেশ সময়ে সকাল অব্দি অপেক্ষার পালা শুরু হলো। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে গ্রামের বাড়িতে কাকাদের কাছে শেষ অনুরোধ করেছি। আমার বাবার শরীরটা যেন বাবার নিজ গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আব্বাকে নিয়ে আর কোনো ধরনের আয়োজন না হলেও চলবে। অনেক পেয়েছেন বাবা। আজন্ম বাবা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে জীবন যাপন করেছেন। আব্বাকে কোনো দাবি ছাড়া বাংলাদেশের মাটি বুকে টেনে নিক—এই শেষ দোয়া, এই শেষ চাওয়া।
* উন্নয়নকর্মী। ৮ জুন ২০২০