শ্রেণিবৈষম্য ও একটি উপলব্ধি

কিশোরী বয়সে এক সেলিব্রিটিকে অনুসরণ করে ঠিক তার মতো একটি পোশাক বানিয়েছিলাম। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক পোশাক কারখানার মেয়েকে অনেকটা সে রকমের একটি পোশাক পরে রাস্তায় হাঁটতে দেখে ওই ড্রেসটার প্রতি সব ভালো লাগা উড়ে গেল। বাড়ি ফিরে গৃহকর্মীকে ওটা দিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, এই জিনিস ওদের ক্লাসের জন্যই ঠিক আছে। আমার পক্ষে এটা আর পরা সম্ভব নয়।


এই যে শ্রেণিভেদ, এই ব্যাপারটা যে কখন কীভাবে আর কেন আমাদের ভেতরে ঢুকেছে আমরা জানি না। তবে আমাদের সবার মধ্যে এই ব্যাপারটা কমবেশি আছে। আমরা মুখে বলি বৈষম্য করা অন্যায় কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমরা নিজের অজান্তেই এই বৈষম্য করে ফেলি। ইংল্যান্ডে এসে সংসার শুরু করার পর ঘর সাজানোর নেশায় পেয়েছিল। টুকটাক যা দেখতাম কিনে ফেলতাম। একদিন একটা খুব দামি ডেকোরেশন পিস খুবই পছন্দ হয়েছিল। মাসের শেষ জেনেও শখকে প্রাধান্য দিয়ে জিনিসটা কিনে ফেলেছিলাম। ট্রলিতে করে জিনিসটা গাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনতে আনতে চোখে পড়ল এক আফ্রিকান লোক এই একই জিনিস বগলদাবা করে নিজের গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখে আমার সব শখ শেষ। এই লোকের বাসায় আর আমার বাসায় সেম জিনিস থাকবে? অসম্ভব! ডেকোরেশন পিসটা দোকানে ফেরত দিয়ে ঘরে ফিরলাম।


ছোটবেলা থেকে দেখেছি দেশে আফ্রিকানদের নিগ্রো বলে ডাকা হয়। কেন ডাকি, কে শিখিয়েছে জানি না তবে এটা জানি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোতে নিগ্রো ওয়ার্ডটা ব্যবহার করা বড় ধরনের অপরাধ। দেশে রপ্ত করা এই অভ্যাস এখানে বিপদ ডেকে আনতে পারে। নিগ্রো, কাল্লু—এগুলা কোনোটা বলাই অ্যালাউড না। ভীষণ রকমের ডিসরেসপেক্টফুল একটা ব্যাপার। ব্ল্যাকদের প্রতি এই কঠিন ধরনের অপছন্দ ভাব আমাদের মজ্জার মধ্যে ঢুকে আছে, চাইলেও বার করতে পারি না। আর সে জন্যই অমন একটা কাণ্ড করেছিলাম। ব্যাপারটা অবশ্যই অনুচিত, বাট উই জাস্ট কান্ট হেল্প ইট।


মানুষ জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা মনে পড়লে দুঃখিত হয়। নিজেদের করা অনেক ভুল কাজের জন্য অনুতপ্ত বোধ করে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঢাকার বাইরে থেকে যারা আমাদের বিভাগে পড়তে, এসেছিল তাদের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য কাজ করত, সেটা মনে পড়লে আমি ভয়ংকর লজ্জিত হই। মফস্বল বা গ্রাম থেকে আসা মানুষজন আমাদের লেভেলের না—এ রকমের একটা বাজে মনোভাব নিয়ে জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছি—এটা চিন্তা করলে খুবই খারাপ লাগে। এখন নিজেই তো আমি লন্ডন থেকে দূরের ছোট্ট একটা শহরে থাকি। তাতে তো আমি নিচু শ্রেণির কেউ হয়ে যাইনি। তাহলে এমন অদ্ভুত চিন্তাধারা সেই সময় কেন ছিল আমার?

লেখক
লেখক

আসলে পরিবেশ এবং পরিস্থিতি মানুষের ধ্যানধারণাকে প্রভাবিত করে। যা মানুষ দেখে, যা শোনে সেভাবেই তার মনোভাব তৈরি হয়। দেখার বাইরে আলাদা করে ভাবার সুযোগই অনেকের হয়তো তৈরি হয় না। কিন্তু ভাবা প্রয়োজন, বড্ড বেশি প্রয়োজন।

কালোদের নাম শুনলেই যে অবজ্ঞাভরে আমরা ভ্রুকুটি করি, একবার কি আমরা ভাবি আমরা নিজেরাও কিন্তু সাদাদের কাছে এমন অবজ্ঞার পাত্র হতে পারি? বাংলাদেশের হিসাবে আমার বা আমাদের গায়ের রং যতই ফর্সা হোক না কেন, সত্যিকারের সাদাদের কাছে কিন্তু আমরা আজীবন ব্রাউনই থাকব। নিজেদের ক্ষেত্রে যখন আমাদের এই ব্রাউন শব্দটা শুনতে সুমধুর লাগে না, তখন অন্যদের কেন আমরা নিচু করে কথা বলি?


এ রকম আরও অনেক ভুল বা অন্যায় আমরা ছোটবেলা থেকে করি জ্ঞানে, অজ্ঞানে, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়। অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা টেরও পাই না যে আমাদের ধারণা বা মনোভাব সঠিক নয়। কিছু জিনিস আমরা জীবনে অভিজ্ঞতা থেকে শিখি, যা কেউ বলে কয়ে কখনোই শুধরাতে বা পরিবর্তন করতে পারে না। সময় আমাদের উপলব্ধি করিয়ে দেয়, আর তখন আমরা অতীত মনে করে লজ্জিত হই। তবে এটাও ঠিক যে এই লজ্জার, এই উপলব্ধির প্রয়োজন আছে। না হলে নিজেকে, নিজেদের শুধরাতাম কি করে?