পর্তুগালের 'অর্থনীতির রোনালদো'র গল্প

মারিও সেন্টেনো। ছবি: সংগৃহীত
মারিও সেন্টেনো। ছবি: সংগৃহীত

‘আমি আজ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৬৪ দিন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে দায়িত্বশীলতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি।’ কথাগুলো গত মঙ্গলবার বলেছিলেন পর্তুগালের অর্থনীতির নায়ক ও ফুটবল কিংবদন্তি রোনালদোর নামানুসারে ‘অর্থনীতির রোনালদো’খ্যাত অর্থমন্ত্রী মারিও সেন্টেনোর।

পুরো নাম মারিও জোজে গোমেজ ডে ফ্রেইতাস সেন্টেনো। কে জানত, তিনি দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে দিনের হিসাবটাও গুনে গুনে কষে রেখেছেন। তবে তা করতেই পারেন অর্থনীতির মানুষ হিসেবে নিশ্চিতভাবে তাঁকে নায়ক বলা যায়। কেননা, পর্তুগালের স্বাধীনতার ৪৫ বছরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ২০১৯ সালের অর্থবছরের বাজেট উদ্বৃত্ত করতে পেরেছিলেন। আগের বছরগুলোতে সব সময় ঘাটতি বাজেট বজায় ছিল।

পর্তুগাল অর্থনীতিতে অর্থমন্ত্রী মারিও সেন্টেনো আরও কিছু অসাধ্য সাধন করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যয় বাড়িয়ে কীভাবে অর্থনীতিতে আয় বাড়ানো যায়, তা তিনি সার্থকভাবে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। মারিও সেন্টেনো ২০১৫ সাল থেকে পর্তুগালের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৭ সালে ইউরো গ্রুপের (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) প্রেসিডেন্ট এবং ইউরোপিয়ান স্টেবিলিটি মেকানিজমের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মারিও সেন্টেনোর এই চলে যাওয়া পর্তুগালের জনগণ, তথা বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক খুব সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। কেননা, বর্তমান প্রেক্ষাপট তাঁর মতো একজন যোদ্ধা বা সফল নায়কের খুবই প্রয়োজন।

পর্তুগালের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশ্লেষক ম্যানুয়েল কার ভালো বলেছেন, ‘মারিও সেন্টেনো ২০ বছরের বাজেটের পুনর্গঠনের পরে তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি ঘাটতি সংকুচিত করেছিলেন এবং আমাদের প্রমাণ করেছিলেন যে হ্যাঁ পর্তুগাল একটি সঠিক হিসাব (বাজেট) পরিচালনা করতে পারে। এটি কোনো ছোট কীর্তি নয়, এ জন্য তাঁর চলে যাওয়া খুবই সংক্ষিপ্ত সময় হিসেবে দেখা যেতে পারে, তিনি আশপাশে থাকবেন এবং শিগগরই ফিরে আসবেন, রাজনৈতিকভাবেই হোক বা যেকোনো পোশাকেই হোক।’

পর্তুগালের বর্তমান ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টির পর্তু শহরের মহানগর কমিটির সদস্য প্রবাসী বাংলাদেশি এবং সফল ব্যবসায়ী শাহ আলম কাজল অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, মারিও সেন্টেনো ‘পর্তুগাল অর্থনীতির সুপারম্যান’। কেননা, তিনি ২৮ বছর ধরে পর্তুগালের বসবাসকালে এত সুন্দর অর্থনৈতিক পরিবেশ ইতিপূর্বে পাননি।

বর্তমান আন্তোনিও কস্তার সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পেছনে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর মারিও সেন্টেনোর জাদু ছিল। কেননা, দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে জনগণ ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট পার্টির ওপর পুনরায় আস্থা রেখেছিল।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থমন্ত্রীর আবিষ্কৃত সূত্রটির ওপর আস্থা ছিল। রাজস্ব আয়ের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং অর্জন করা সম্ভব। সে হিসাবেই পর্তুগাল সরকার প্রতিবছর বেতন কাঠামো, পেনশন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল। এতে খরচের পরিমাণ বাড়লেও অর্থনীতি সচল থাকার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

মারিও সেন্টেনোর জন্ম ১৯৬৬ সালের ৯ ডিসেম্বর পর্তুগালের অন্যতম পর্যটননগরী আলগার্ভে, শিক্ষাজীবনে ১৯৯০ সালে লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট অনুষদের (ISEG-ULISBOA) অর্থনীতিতে স্নাতক পাস করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৩ অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ২০০০ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবনে মারিও সেন্টেনোর ২০০১ সালে পর্তুগিজ ইকোনমিক জার্নাল এডিটোরিয়াল মেম্বার হিসেবে কাজ শুরু করেন, পাশাপাশি পর্তুগালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে বোর্ড অব ডিরেক্টরসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইকোনমিক পলিসি কমিটিতে মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তিনি একাধারে ইউনিভার্সিটি অব লিসবনের অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর বাইরে বিভিন্ন অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে পর্তুগালের অর্থমন্ত্রী এবং একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

অর্থমন্ত্রী থাকাকালে মারিও সেন্টেনো গায়ে তেমন কোনো আঁচড় পড়েনি, শুধু ২০১৮ সালে পর্তুগালের বিখ্যাত ক্লাব বেনিফিকাকে আয়কর সুবিধা দিয়েছিলেন বলে একটা অভিযোগ উঠেছিল। সে কারণে তাঁর অফিস পর্যন্ত পুলিশি তল্লাশি হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় সে অভিযোগ থেকে তিনি মুক্তি পান। এটি বিরোধী পক্ষের একটি তির ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না।

বিদায় সবাইকে নিতে হয়, তবে পর্তুগালের অর্থনীতির এই জাদুকরের বিদায় সবার কাছেই ব্যথিত এবং প্রশ্নবোধক থেকেই যায়। কেননা, যিনি পর্তুগালের অর্থনীতিতে নতুন এক সূর্য উন্মোচন করেছিলেন এবং ইউরো গ্রুপের (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) অর্থমন্ত্রী হিসেবে সার্থকভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ইউরোপ এবং পর্তুগালকে একটি নতুন উচ্চতায় আসীন করেছেন। তবে ইতিহাসের পাতায় তাঁর কীর্তি ফুটবল মাঠের জাদুকর বিশ্বে সমাদৃত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতোই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে বিদায় নিলেও অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশের জন্য কাজ করে যাবেন, এই আশা পর্তুগালের জনগণ, তথা সব অর্থনৈতিক বিশ্লেষকের।

বর্তমান পর্তুগালের নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে জোয়াও লিয়াও দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। তিনি ইতিপূর্বে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের দুই মেয়াদেই বাজেট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।