মাসিক ট্যাবু

মাসিক (মিন্সট্রেসন), স্যানিটারি প্যাড নিয়ে অনেক কচলাকচলি চলছে, তা–ও নাকি এক প্যাডের অ্যাডের বদৌলতে। আর কিছু না হোক, কথা বা সমালোচনা যে চলছে, তাতেই তো অনেকের চক্ষু খুলে যাচ্ছে! জানতে পারছে।

এ মহাদেশে পিরিয়ড ট্যাবু! সেক্স ট্যাবু, কারণ আমরা সেটা নিয়ে লজ্জা পাই। আমাদের এমনই শেখানো হয়। লজ্জার সময়! তুমি অসুচি! নেপালে, ভারতে এখনো মেয়েদের আলাদা ঘর থেকে দূরে মেয়েদের ঋতুকালীন সময়ে রেখে আসা হয়। একাকী! ভাবুন তো ৮-৯ বছরের দুধের বাচ্চাকে অসুচি বলে তাকে একাকী গোয়ালঘরে ফেলে আসা! মেয়েটার হয়তো মা ছাড়া ঘুমও আসে না এ বয়সে! সাপের কামড়ে মরে কত মেয়ে এ অবস্থায়! পানিটা ধরলেও অসুচি! পূজা–অর্চনার কথা তো বাদই দিলাম!

মুসলমান মেয়েরা অতটা খারাপ অবস্থায় না থাকলেও যখন নামাজ, রোজা করতে পারে না তখন আশপাশের মানুষজন তাদের দেখে যে অসভ্য রকমের হাসি দেয়, তাতে যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের পিত্তি জ্বলে যাওয়ার কথা! অনেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলে এ সময়, এ করা যাবে না, ও করা যাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি!

আমাদের বয়সে বড়দের যখন পিরিয়ড হতো, জিজ্ঞেস করত জামার পেছনটা চেক কর, বুঝতাম না কেন? নাম শুনেছি, জানতাম না ব্যাপারটা কী!

যখন স্কুলে পিরিয়ডবিষয়ক চ্যাপ্টার পড়ানোর সময়, তখন যাদের অলরেডি পিরিয়ড হয়েছে, তারাই চ্যাপ্টারটা পড়ানোর বিরোধিতা করত! বুঝতাম না কেন? কেন এত লুকোচুরি!

নিজেরও সময়মতো একদিন পিরিয়ড হলো। স্কুল থেকে ফিরি দেখি, কাপড়ে রক্ত ভরা! ভয় পেয়ে কয়েক ঘণ্টা বসে ছিলাম। কনসেপ্টটাই ছিল না। কেন হলো, কী করতে হবে। আমাদের সময়ে দাদি–নানিদের নাকি দায়িত্ব ছিল, বাড়ির মেয়েদের এসব নিয়ে সচেতন করার। আমার তো দাদি–নানি আশপাশে থাকত না, আর ছিলাম ভীষণ ডানপিটে, বান্ধবীদের জামার পেছনের দাগ পাহারা দিয়েছি; কিন্তু সে দাগে কী করতে হবে, কেউ বলেনি। পিরিয়ড হলে কেন হয়, কী হয়, সেটাও জানা ছিল না।

দুই–তিন ঘণ্টা পরে যখন মেন্টালি এক্সজস্টেড, তখন মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন ব্লাড আমি জানি না! মা আমাকে হাতে পুরোনো কাপড় তুলে দিল। কীভাবে পরতে হবে বলে দিল, তারপর কী করতে হবে তা বলেনি। কাপড়টা ধুয়ে শুকাতে হবে কি না, কতক্ষণ পর পরিবর্তন করতে হবে, কিছুই জানি না। পরদিন স্কুলে গিয়ে, আমার কিছু ক্লাসমেট বাথরুমে নিয়ে গিয়ে জামা পরিষ্কার করে ধুয়ে দিল। সকালবেলা, ভেজা ত্যানা থেকে ছড়িয়েছে সব জায়গায়। তখন জানলাম শুধু ত্যানা ধুলেই হবে না! শুকাতেও হবে। শুকাবে কোথায়? মানুষ দেখলে ছি ছি করবে! আড়ালে ধুয়ে, আড়ালে শুকাতে হবে! সে আরেক হ্যাপা!

পাঁচ থেকে সাত দিন কারণ ছাড়াই জীবনে অতিরিক্ত হ্যাপা!

না নামাজ, না রোজা! ভাগ্যিস সে কদিন খাবারের কষ্ট করতে হয়নি, অন্যদের মতো! অনেক সময় লেগেছে পিরিয়ডের দিনগুলো বশে আনতে! জীবন তো থেমে থাকে না। ক্লাসে যেতে হয়, পরীক্ষা দিতে হয়, পার্বণে যেতে হয়। ট্রাভেল করতে হয়!

কলেজে গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের সঙ্গে পরিচয়। কলেজের ছেলেদের বাঁকা কথা শুনেছি। যেহেতু দেশে তখন গার্বেজ নেওয়ার কোনো সিস্টেমই ছিল না, যত্রতত্র স্যানিটারি প্যাড পড়ে থাকত। কী হাসাহাসি ছেলেদের সেসব প্যাড দেখে! আর যদি হোস্টেলের রেলিংয়ে অন্তর্বাস দেখা যেত। তাহলে তো কথাই নেই! মেয়েদের লাজলজ্জা নেই, শুনতে শুনতে কান খারাপ হওয়ার জোগাড়। এসব ছেলের যে ভদ্রতা বোধ নেই, সেটিই আমরা বুঝি না। মেয়েদের প্রতি সম্মান নেই, সেটা আমরা বুঝি না।

আচ্ছা, সমস্যাটা কার? আপনাদের আন্ডারওয়্যার নিয়ে মেয়েরা তো বিকৃত আনন্দ পায় না। অন্তর্বাস, পিরিয়ড, প্যাড—সব স্বাভাবিক ব্যাপার। কেন তাতে আপনাদের বিকৃত আনন্দ? কেন তা লুকিয়ে রাখতে হবে? আপনাদের ভয়ে না শুকিয়ে ফেলে রাখতে হবে? অনেকে তো আবার সাইজ মাপে সেগুলো দেখে! অসভ্যতার চূড়ান্ত!

পারভার্শনটা যে আপনার! মাথায় আসে না? সহজ বোধটা আসে না যে আপনারই মস্তিষ্ক বিকৃত?
নিজে সাফার করায়, যখন ছেলেমেয়ের স্কুলে যৌনশিক্ষার সময় এল, আমি আমার সন্তানদের সেসব ক্লাসে অ্যাটেন্ড করতে বলেছি। কারণ, তাতে শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানা যায়। আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে অনেকে সেসব ক্লাস অপ্টআউট করেছে, সেটা তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত।

আমি আমার মতো ব্যস্ত। হাসপাতাল থেকে একদিন ফিরে ডিনার শেষে আমার স্বামী বলে, আমার মেয়ে প্যাড চেয়েছিল, ও প্যাডের প্যাকেট মেয়েকে দিয়েছে। এটা আমার মেয়ের প্রথম পিরিয়ড। নাহ, আমাকে ফোন দেয়নি। ওর যেহেতু ক্লাস করে ধারণা ছিল, ও এটাকে অন্যভাবে ভাবেনি। পিরিয়ড হয়েছে, প্যাড লাগবে, মা নেই কাছে, বাবা আছে, বাবাকে বলেছে। খুব সাধারণ ব্যাপার! এই সাধারণ জৈবিক বিষয়টিকেই আমরা ত্যানা প্যাঁচাই প্রতিদিন, খামোখা।

মেয়েটি আমার দুরন্ত। যতক্ষণ বাসায়, সাইকেল চালিয়ে বেড়ায় ছোট ভাইটির সঙ্গে। ভাইয়ের চোখে পড়েছে একদিন রক্তাক্ত প্যাড। প্রশ্ন করেছে বোনটিকে, এটা কী?

মনে আছে, সেদিন আমি বাসায় ছিলাম। ওপরে এদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছি। মেয়ে তার ভাইকে বলছে, ‘মেয়েদের প্রতি মাসে এগ যায়, মানে ডিম যায়, ডিম যখন যায়, রক্তপাত হয় এক সপ্তাহ। ব্যথাও হয়।’

খুব সাধারণ অ্যানালজি! মেয়েদের ডিম আছে, মুরগির মতোই! ডিম যখন পাস হয়, ব্যথা হয়, রক্তপাত হয়। এর চেয়ে সিম্পল করে আমি নিজেও হয়তো বলতে পারতাম না।

আমার ছেলে আর কখনোই কিছু জানতে চায়নি। কারণ, এটাকে আমরা লুকোনোর মতো কিছু বলিনি, লজ্জার কিছু বলিনি। এটা লুকোনোর বা লজ্জার কিছু নয়ও, স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া! কেন ফালতু তাতে লজ্জা, ধর্ম টেনে আনা? ছেলেকে বরঞ্চ এটা শিখিয়েছি, যেকোনো মেয়ের গায়ে যেন কখনো অহেতুক হাত না দেয়, নজর সংযত রাখে, মেয়েদের সম্মান করে।

পিরিয়ডকে বরং এভাবে ভাবলেও তো হয়, এটা মেয়েদের স্রষ্টাপ্রদত্ত ছুটির দিন। যেখানে প্রতিটি মেয়ের জীবনে কেউ কোনো ব্রেক দিতে রাজি নয়, সেখানে স্রষ্টা আমাদের ছুটি দিয়েছেন।

কিছু মেয়ে ভয়ানক কষ্ট পায়, এসব দিনগুলোতে। প্যাড ম্যানেজ ও প্রপার ডিসপোজের ব্যবস্থা করে আপনারা মেয়েদের এই কষ্ট থেকে বাঁচাতে পারেন। হোক সে মেয়ে, বোন, মা, খালা বা বউ বা প্রেয়সী।

প্যাড তো আমার কাছে মনে হয় জিনিয়াস আবিষ্কার! পিরিয়ডের দিনগুলোতে কাজ, পড়াশোনা, খেলাধুলা, সমাজ, সামাজিকতা, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ম্যানেজ করার একটি সত্যিকারের মেয়েবান্ধব জিনিস! নয়তো এক ত্যানা পরিষ্কারের হ্যাপা, তার থেকে কাপড়চোপড়ের দাগ, বিছানা–বালিশে রক্তের দাগ, সেগুলো পরিষ্কার করতে করতেই সপ্তাহ, মাস, বছরের পর বছর। মেয়েদের জীবনে আর কিছু করতে হবে না। পেটব্যথায় চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকো সপ্তাহভর।

আমরা প্যাড বাল্ক, মানে অনেক একসঙ্গে, কোয়ান্টিটি কিনতে পাই। দেশে সে ব্যবস্থা হয়তো এখনো হয়নি। তাই তো কথা ওঠে, কে কিনবে? বাপ, ভাই, ছেলে, পরিবার, না নিজে? আরে ভাই বাল্ক মানে বড় প্যাকেট একেবারে কিনে নিতে পারলে, একটা পরিবারের কয়েক মাস চলে যায় সহজে। সে যে–ই কিনে আনুক। দেশেও আশা করি মানুষ কিনতে পারবে। একটু ভদ্র হোন! সবকিছু নিয়ে তামাশা না করে, সবকিছুর মধ্যে যৌনতার গন্ধ না খুঁজে, নিজের পরিবারের মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। সেটিই সবার আগে। ভালো মানুষ হতে ধর্ম লাগে না। ভালো মানুষ হলে বরং নিজ ধর্ম অর্ধেক পালন হয়, বাকিটা পালন করুন যার যেভাবে ইচ্ছা, নিজস্ব বিশ্বাস অনুযায়ী। মানুষ হোন আগে।

* চিকিৎসক