ভালোবাসার স্পর্শ ৬ ফুট দূরত্বের জালে বন্দী

লেখকের সঙ্গে মেয়ে রোদেলা ও স্বামী এজাজ। ছবি: সংগৃহীত
লেখকের সঙ্গে মেয়ে রোদেলা ও স্বামী এজাজ। ছবি: সংগৃহীত

সেদিন শনিবার। রাত আটটা বাজে। হঠাৎ টের পেলাম, বাসার বাইরের দরজার লকটা কেউ খুলছে। একটু ভয়ই পেলাম। এজাজের তো এ সময় আসার কথা না। রোদেলা এসে পৌঁছাবে রাত ১০টায়। ইদানীং সবকিছুতেই ভয় লাগে। ভয়ে ভয়ে লিভিংরুমের সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বাদামি কাঠ দিয়ে সিঁড়ির রেলিংটা মোড়ানো। শেষ প্রান্তে নকশা করা গোল বোয়ামের মুখের মতো কাঠের চাকতি। সেই চাকতিতে হাত রেখে দাঁড়ালাম। ভূত দেখার মতো চমকে গেলাম। না আর কেউ নয়, আমার মেয়ে রোদেলা। মাথার চুল কিছুটা অগোছালো, শ্যামলা মুখে ক্লান্তির ছাপ, বিশাল একটা সুটকেস টেনে ভেতরে আনার চেষ্টা করছে। আমি সিঁড়িতে পা বাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আনন্দ আর আশ্চর্যমিশ্রিত দোলাচলে, ‘মামণি তুমি?’

সে গম্ভীর হয়ে হাত তুলে আমাকে থামার সংকেত দিল। আমি থমকে গেলাম। এবার সে পূর্ণ দৃষ্টিতে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকাল। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আম্মু আমি তো তোমাকে বলেছি, আমাদের সেলফ আইসোলেশনে থাকতে হবে। আমি বড় শহর থেকে এসেছি। তোমাকে সোশ্যাল ডিসটেনস বজায় রাখতে হবে।’

এই মেয়েকে অচেনা মনে হচ্ছে। এই তিন মাসেই যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। আমি শক্ত করে রেলিংয়ের চাকতিটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য, এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। এত দিন পর দেখা, এত ধকলের পর সে এসেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ আমাদের মা-মেয়ের ভালোবাসায় দূরত্বের দেয়াল তুলে দিয়েছে। সে একাই টেনে টেনে ভারী সুটকেসটা নিচের ঘরে নিয়ে গেল। দরজাটা খোলা, খোলা দরজা দিয়ে হিমেল হাওয়া আসছিল। সে হাওয়ায় অল্প অল্প বিষণ্নতার বার্তা। আমায় সে–ও শাসাচ্ছে, এই যে তুমি এখানেই দাঁড়াও। এখন থেকে তুমি মমত্ব লুকিয়ে রাখবে বুকের কোঠরে। সবকিছুই এখন বদলে গেছে। তুমি পারবে না তোমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতে। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে ৬ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে। আনন্দ–বেদনার মিশেলে এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। অনুভূতিগুলো কেমন শূন্য লাগছে। খুব বেশি প্রত্যাশার পর কোনো কিছু পেলে যেমন একধরনের অস্থিরতা ভেতরটা দাবড়িয়ে বেড়ায়, তারপর বিশাল ক্লান্তিতে সবকিছু স্থবির হয়ে রয়। ঠিক সে রকম বিশাল এক স্থবিরতা ভর করেছে আমাকে। স্নেহ–ভালোবাসার স্পর্শ এখন ৬ ফুট দূরত্বের জালে বন্দী।

গাড়ি থেকে মালপত্র টেনে এনে সে নিচতালার রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। এত দিন পর মেয়ে এসেছে, কিন্তু সামান্য কথা বলারও সুযোগ নেই। গতকালই ধোয়া চাদর বিছিয়ে, বালিশের কভার বদলিয়ে বিছানা বিছিয়ে দিয়েছি। বিছানার কাছে ছোট্ট টেবিলে তার প্রিয় কিছু বই আর একটি পানির বোতল রেখে দিয়েছি। সঙ্গে একটি চিপসের প্যাকেট। এ দেশে মাটির নিচে যে ফ্লোর, তাকে বলে বেজমেন্ট। রোদেলার জন্য সেখানেই কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে জানালাগুলো উঁচু, মাটির ওপরে। তাই আলো আসে প্রচুর। এই ১৪ দিন একদম অন্ধকার গুহায় তাকে থাকতে হবে না, এই ভেবে সান্ত্বনা পেলাম।
আমাদের দুজনের কারোই কোভিড পরীক্ষিত নয়, শুধু সতর্কতা হিসেবেই আমরা হেলথ নার্সের সঙ্গে কথা বলে এই ব্যবস্থা নিয়েছি।

নিজের রুমে বসে শুনতে পেলাম, সে ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধুতে দিয়েছে। তিন দিন বাইরে থেকেছে, কাপড় ধুয়ে ফেললে করোনার জীবাণু থাকবে না। তার সুটকেস লন্ড্রিরুমে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সুটকেসটাও জীবাণুক্ত করা দরকার, এমনকি তার জুতাও।
ফোন দিলাম, ‘কী করো মা?’
‘ওয়াশরুম ধুচ্ছি’
‘কেন, আমি তো ধুয়েছি।’
‘তুমি তো বাথটাব ধোওনি। সেটি ধুচ্ছি।’
‘তোমার সুটকেস, জুতা স্যানিটাইজ করার দরকার ছিল।’
‘আমি সব করছি, তুমি ঘুমাও।’
‘ঘুম আসে না মা।’
‘কেন?’
‘এত দিন পর এলে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না, একটু জড়িয়ে ধরতে পারছি না, ভীষণ কষ্ট লাগছে।’
‘আম্মু আমি যে নিরাপদে এসেছি, তোমাদের সঙ্গে থাকব, এতে অন্তত খুশি হও।’
‘এত কষ্ট করে এলে, কত কাজ করতে হচ্ছে।’

‘আম্মু কাল থেকে রেস্ট নেব। আর আমি ইয়াং, আমার কষ্ট হচ্ছে না। সব স্যানিটাইজ করলে আর বাসাতে কোনো ভাইরাস ছড়াতে পারবে না। তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।’
মেয়ের সঙ্গে কথা বলে মনটা একটু শান্তও হলো। গত তিন দিন ঘুমাই না। বিছানায় শুতেই ঘুম চলে এল।

শুরু হলো মা–মেয়ের কোয়ারেন্টিন জীবন। এজাজ বাসা থেকে চলে গেছে ১৫ দিনের জন্য। যেহেতু এজাজ বাইরে বৃদ্ধ মানুষদের সঙ্গে কাজ করে, এ কারণে সে বাসার বাইরে থাকাই নিরাপদ মনে করছে। দায়িত্বের জায়গা থেকে এটা ছাড়া আর তো কোনো রাস্তা খোলা নেই।

৮১১ থেকে নার্স ফোন করেছিল। বলল আমাদের তিনজনকেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। সামাজিক দূরত্বের জন্য তিনজনের পরিবারের সদস্য তিন দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। মা, মেয়ে, বাবা—তিনজনই ভীষণ অস্থিরতা নিয়ে, মনঃকষ্ট নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। এই যাপিত জীবন আমরা চিনি না। এ এক নতুন জীবন। রোদেলা রান্নাঘরে গিয়ে নিজে রান্না করে খায়, নিজেই সব ধুয়ে পরিপাটি করে রাখে। আমিও কোনো রকম একটা ডাল-ভাত রেঁধে একবেলা খাই। দুজনের প্লেট–গ্লাস, এমনকি হাঁড়ি–পাতিলও আলাদা। কখনো সকালে এসে আমরা ঘুম থেকে উঠার আগেই স্যানিটাইজার দিয়ে দরজা–জানালা–মেঝে, এমনকি বাথরুম পরিষ্কার করে রেখে যায়। এজাজ বাজার করে গ্যারেজে রেখে যায়। সেসবের মধ্যে পচনশীল খাবার স্যানিটাইজ করে ফ্রিজে ঢোকাই। বাকিগুলো তিন দিন গ্যারেজে ফেলে রাখি। প্লাস্টিকের ব্যাগও ফেলে রাখি গ্যারাজে। প্রতিদিনই দরজার নব, ফ্রিজ, দরজা, টেবিল পরিষ্কার করতে করতে মনে হয় আমি হাসপাতালে বাস করি। হাত ধুতে ধুতে হাতের চামড়া এখন জ্বলে। মনে হয়, জেলখানায় বন্দী থাকা কি এর চেয়ে কষ্টকর? মৃত্যু হলে এই পৃথিবীতে কী হচ্ছে জানা যায় না। কিন্তু মৃতপ্রায় হলে মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ সে জীবন।

কষ্টের দিন দ্রুত যায় না। আমাকে দেখলেই রোদেলা বলে, ‘মা তুমি দূরে থাকো।’
আমি হাসি, ‘দূরেই আছি বাবা।’ মেয়ের মুখের দিকে তাকালে মনটা কষ্টে ছটফট করে। নিচে একটা রুমে বন্দী থাকা কীভাবে সম্ভব।
বললাম, ‘এক সপ্তাহ তুমি নিচে থাকলে এবার তুমি ওপরে লিভিংরুম, ডাইনিংয়ে আসো। আমি বরং বেডরুমেই বেশি থাকব।’
মেয়ে দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘তোমার কষ্ট হবে না?’
‘না। তা ছাড়া তোমার তো আর কোভিড নেই। আমরা যথেষ্ট সতর্কতা পালন করছি।’
‘ওকে থ্যাংক ইউ, মা। তাহলে আমার ল্যাপটপটা আনি? তোমার গাছের কাছে বসি?’
আমি ভীষণ মমতা নিয়ে বললাম, ‘যাও নিয়ে এসে বসো তুমি।’
সে দৌড়ে গেল নিচে, ল্যাপটপ নিয়ে এল।
আমি হাসলাম।

আমি আমার বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম। জানালাগুলোর পর্দা সরিয়ে দিলাম। চারদিকের আলো এসে আমার ঘরের দেয়ালে পড়ছে। সেই আলোতে মন ভরে গেল। আমরা মানুষেরা কখনো কখনো সামান্য কিছুতেই খুশি হয়ে যাই। মেয়েকে অল্প কিছু জায়গা ছেড়ে দেওয়াতেই সে কি খুশি। আর তার খুশি দেখে আমারও খুব ভালো লাগছে। তিনজনেই তিনজনের নিরাপত্তার জন্য সেক্রিফাইজ করে যাচ্ছি। বাঙালিরা পরিবারে ভালোবাসার কথা কখনো মুখ ফুটে বলি না। কিন্তু করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পরিবারের সদস্যদের নীরব ভালোবাসা, মায়া আর স্নেহ। আমরা তিনজনই চাইছি এই ভয়াবহ অদৃশ্য শত্রু যেন প্রিয়জনকে আক্রমণ না করে। এই নীরব ভালোবাসা বুঝতে পারাও জীবনের জন্য অনেক বড় পাওয়া।

সকাল আটটা বাজে। ঘুমাচ্ছিলাম তখনো। কম্পিউটারে জোরে জোরে গান বাজছে, তার চেয়ে জোরে কেউ একজন কথা বলছে আর হাসছে। এই হচ্ছে রোদেলা। সে যখন পড়াশোনা করে না, তখন এমন চেঁচাবে বন্ধুদের সঙ্গে, হাসতে হাসতে বাড়িঘর কাঁপিয়ে দেবে। অন্য কোনো ছুটি হলে ভীষণ রেগে যেতাম। আজ কেন জানি এসব হই-হুল্লোড়ে রাগ লাগছে না। যেন কিছুই হয়নি পৃথিবীতে। কোনো করোনাভাইরাস নেই, মৃত্যুর অপেক্ষায় নেই আমরা। আমরা অপেক্ষা করছি এমন আলোময়, আনন্দমাখা এক ভোরের। আমি কান পেতে শুনতে থাকলাম তারুণ্যের জয়গান। আমার ভয়ংকর রাতের প্রেতাত্মারা আজ সকালের হাসির দমকে ছিটকে কোন অন্ধকারে লুকিয়েছে, আজ যেন আবার নতুন করে আশা ফিরে পেলাম। এটাই তাহলে জীবন। যে প্রেতাত্মাঠাসা বাড়িতে আছি গত দুই সপ্তাহ, মনে হচ্ছিল সেটি যেন আজ কোলাহলমুখর আনন্দপুরী। আমার প্রিয় সন্তান কেমন করে বদলে দিল পরিবেশ। সন্তানের কাছাকাছি থাকাটাই মায়ের কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ। এর চেয়ে বড় সত্যি আর কিছু নেই জীবনে। অনেক বড় কিছু পাওয়ার আশায় তারা দূরে চলে যায়, কিন্তু শুধু মা-ই জানে কি বিশাল অপূর্ণতা, এক বুক হাহাকার নিয়ে তিনি জীবন কাটান।

করোনা আমার সেই শূন্যতা দূর করে ভালোবাসাময় পরিবার ফিরিয়ে দিল, হয়তো কিছুদিনের জন্য। তারপরও সেই অল্প কটা দিনও খুব মায়া আর ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকল স্বর্ণলতাগাছের মতো। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে প্রতিজ্ঞা করলাম, আজ সব অনিশ্চয়তা নিয়ে ভাবব না। যা হওয়ার হবে। শুধু আরও কিছুদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকি, শুধু এই প্রত্যাশা।