প্রতিবন্ধকতা নয়, খুঁজতে হবে প্রতিকার

ছবিটা আমার মেয়ের হাতে আঁকা। তার একটা গবেষণা প্রজেক্টে এটা ব্যবহার করেছিল।
ছবিটা আমার মেয়ের হাতে আঁকা। তার একটা গবেষণা প্রজেক্টে এটা ব্যবহার করেছিল।

‘আমি বাবা-মায়ের শত আদরের মেয়ে, শিক্ষা আমায় মুক্তি দেবে, মুক্তি দেবে’। মীনা কার্টুনের এই গানকে উপজীব্য করে আমার মেয়েটাকে গড়ার মূল চিন্তা ছিল, সেই ওর জন্মক্ষণ থেকেই। টিভিতে মীনা কার্টুন দেখালে আমি ওকে কাছে নিয়ে দেখতাম। আমি ঘুরেফিরে ওকে নিয়ে গানটা করতাম আর গানের কথাগুলো ওকে বুঝিয়ে বলতাম।

ওর অনেক আকর্ষণ ছিল মীনা কার্টুনের বই পড়ার। ও তখনো নিজে নিজে পড়া শেখেনি, তবে আমার পড়া শুনে শুনে মীনা কার্টুনের বইগুলো সব মুখস্থ করে ফেলেছিল। ও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাত আর মুখস্থ পড়া বলত। দেখে মনে হতো যেন ও সত্যিই পড়তে পারে। একদিন ও ঠিকই পড়ে ফেলল মীনা কার্টুনের বই। যেটা ওর জীবনের প্রথম বই পড়া। সত্যি কথা বলতে কি, এত বছর পরে আজও আমি মাঝেমধ্যে মীনা কার্টুনের গানটা করি ওকে কাছে পেলে। 

আমার মেয়েটা জন্ম নেয় শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে। যেহেতু ও হাঁটতে পারবে না, সেই জন্য ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই বছরের পর বছর ওকে পার করতে হবে। এটা আমি কিছুতেই আমার মনকে বোঝাতে পারতাম না। আমি ওকে বাইরের জগতের সঙ্গে কীভাবে পরিচয় করাব, কীভাবে ও জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে, সব সময় ভাবতাম। আমার মা পরামর্শ দিলেন, ‘ওকে বইয়ের জগতে ব্যস্ত রাখো, যার ভেতর দিয়ে ও ওর জীবনে বাঁচার অনুপ্রেরণা পাবে। আর ওর চাচা-খালাদের বলে দাও ওর জন্মদিনে জামা-কাপড় বা খেলনা না দিয়ে বই উপহার দেওয়ার জন্য।’ আমি নীলক্ষেত, বইমেলা, অন্যান দোকান ঘুরে যেখানেই বই পেতাম, ওকে প্রচুর বই কিনে দিতাম। আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, ওকে বাইরের জগৎটাকে ঘরের মধ্যে এনে দেওয়া। আমি ওকে শুনিয়েছি অনেক আশা-উদ্দীপনার গল্প। যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্টিফেন হকিং।


কখনো ওকে বুঝতে দিইনি যে ও এটা পারবে না কিংবা ওটা ওকে দিয়ে করানো যাবে না। আমি বাংলাদেশে একটা সরকারি বয়েজ স্কুলে চাকরি করতাম, স্কুলটা ক্লাস টু থেকে শুরু ছিল। ও বয়সে অনেক ছোট ছিল, কিন্তু স্কুলে পড়ার জন্য খুব আগ্রহ দেখাত। প্রধান শিক্ষকের অনুমতিক্রমে স্কুলের ড্রেস কোড অনুযায়ী ওকে ছেলেদের ড্রেস পরিয়ে শ্রেণিকক্ষে বসতাম। আমি ওকে কোলে করে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া–আসা করতাম। আমি চাকরির সুবাদে নবাবপুরে থাকতাম। তখন শারীরিক অসুস্থ বাচ্চাদের পড়ালেখার জন্য আমার আশপাশে কোনো স্কুল ছিল বলে আমার জানা নেই। আমি তখনো কোনো দিন কোনো বাচ্চাকে হুইলচেয়ারে স্কুলে যেতে বা রাস্তায় চলতে দেখিনি।


ডাক্তার, কবিরাজ, দোয়া, তাবিজ যে যা বলেছে, সব করিয়েছিলাম। কোনো আশার আলো দেখা দিল না। শেষ আশা ভরসা হিসেবে দেখলাম বিদেশে চিকিৎসা করানো। এর পরিপ্রেক্ষিতেই কানাডাতে পাড়ি দেওয়া। যদিও বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে বসত করব, এ ধরনের চিন্তা আমার কল্পনাতেও আসেনি। আমার বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডা বসবাসের একমাত্র কারণ আমার মেয়েটাকে আর সাধারণ দশটা মেয়ের মতো করে লালন-পালন করা, ওকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। যা–ই হোক, আমার স্বামীর টোফেল পরীক্ষা, স্কলারশিপ পাওয়া, আরও বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে আমাদের কানাডাতে আসা।


কানাডাতে এসে মেয়েটা চলাচলের জন্য একটা হুইলচেয়ার পেল। কানাডাতেই ওর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্কুলজীবন শুরু হলো। কানাডিয়ান আইন অনুযায়ী প্রাপ্য সুযোগ–সুবিধা নিয়ে ও স্কুলে যেতে লাগল। বিশেষ করে স্কুলে যাওয়া–আসার জন্য একটা স্পেশাল স্কুলবাস, যেটা লিফটের সাহায্যে হুইলচেয়ারসহ ওকে ওঠা–নামা করাত এবং একজন টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, যিনি ওকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করতেন। আমাদের তখন গাড়ি ছিল না। হুইলচেয়ারে ওকে নিয়ে আমরা স্কুলের পরে অথবা ছুটির দিনগুলোতে অনেক দূরে দূরে হেঁটে বেড়াতাম। ওকে আমি সব সময় মনে করিয়ে দিতাম, ‘পৃথিবীটাকে চোখ মেলে দেখো। আগে তো শুধু বইয়ের মধ্যে পড়তে হতো, আর এখন দেখার সুযোগ এসেছে।’


আমরা সর্বদা ওকে বিভিন্ন সামাজিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করতাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে পিয়ানো বাজানো, বাঁশিতে সুর জাগানো, উপস্থাপনা করা, বক্তৃতা দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ও কমিউনিটিতে বেশ পরিচিতি পায়। আমাদের চলার পথে মেয়েটাকে নিয়ে অনেক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে। যেটা আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বসে আলোচনা করি। কখনো আল্লাহের ওপর অনেক কৃতজ্ঞ হই, কখনো ব্যথিত হই, আবার কখনো চোখে পানি আসে। সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে ওর পরিসর বড় হতে থাকে, ও এখন স্কুল পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমি যেটা কখনো দেখব বলে বিশ্বাস করতে পারিনি, এটা আমার স্বপ্ন ছিল। তবে আমার ভেতরের তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে পেছন থেকে সর্বদা ধাক্কা দেয় ওকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। ওকে বলি, ‘ইনশা আল্লাহ! তুমি পারবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট (আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স) নির্বাচিত হয়। TEDx-এ ও একটা বক্তৃতা দিয়েছিল, ওর মতো অন্যদের মনোবল জাগানোর জন্য ওর নিজের জীবনের গল্প তুলে ধরে। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর গবেষণার প্রতিপাদ্য (Women with Disabilities) উপস্থাপনায় প্রথম স্থান অধিকার করে ১ হাজার পুরস্কার পায়। ও দিন দিন বেশ কতগুলো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ওর চলার পথে।


আমি যখন ওকে নিয়ে বাংলাদেশে যাই এবং যে কদিন থাকি, চেষ্টা করি ওকে বাইরে ঘুরাতে, শপিং করতে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে। হুইলচেয়ারে ঘুরতে রাস্তাঘাট খুবই দুর্গম লাগে। তবে বিশেষ করে ওর প্রতি জনসাধারণের অতি উৎসাহ ওকে বিব্রত এবং হতাশার সৃষ্টি করে। ও বড় হচ্ছে এমন একটা পরিবেশে, যেখানে লোকজন উৎসুক না হয়ে সহায়তার হাত বাড়ায়। যেমন দরজাটা খুলে ধরে অথবা ওকে আগে যেতে দেয় অথবা খাবারটা ওকে প্রথমে নিতে দেয়।


মনে পড়ে, তখন আমরা ওয়াটারলুতে থাকি। কোনো এক সন্ধ্যায় পুরো পরিবার নিয়ে ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম, বাসের অপেক্ষায় অন্য যাত্রীদের (সবই প্রায় স্টুডেন্ট) বেশ বড়সড় লাইন। আমরা পরিবার হুড়োহুড়ির মধ্যে না থেকে একদিকে একটু ফাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বাসটা আসার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরা সবাই হুড়হুড় করে বাসে উঠে পড়ল। বাসের ড্রাইভার যাত্রীদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন, কিছুই বললেন না। একটু ফাঁকা পেয়ে আমরা বাসের দরজায় দাঁড়ালাম লিফটের জন্য। বাসের ড্রাইভার তখন আমাদের হাতের ইশারায় অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দিয়ে তাঁর নিজের সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেন। যাত্রীদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘অনুগ্রহ করে সবাই বাস থেকে নেমে যাও, এখানে একটা হুইলচেয়ার মানুষ আছে, তাকে আগে উঠতে দেওয়ার পরে তোমরা উঠবে।’ সব যাত্রী নেমে গেল, কোনো একটা হইচই বা টু শব্দটিও কেউ করল না। ঘটনাটি খুব মনে দাগ কেটেছিল, কারণ তখন আমরা কেবলই বাংলাদেশ থেকে এসেছি।


আমার মেয়েটা এখানে এখনো হুইলচেয়ার ব্যবহার করে ওর চলাচলের জন্য। ও এখনো অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বছরের পর বছর পার করছে। তারপরও সে লেখাপড়া ধরে রেখেছে, পাশাপাশি চাকরি করছে, আর সবার মতো করে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো করেই বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু অনেকের জন্য এটা হয়তোবা সম্ভব নয়। আবার বিদেশ এলেই যে সবকিছু পাওয়া যাবে, সেটাও না। সব থেকে বড় ব্যাপার, তাদেরকে ঘরের বাইরে আসার সুযোগ করে দিতে হবে।


আমাদের যাদের এই ধরনের অসুস্থ সন্তান আছে, তাদের ঘরের বাইরে আনতে হবে তাদের মেধা-মননের বিকাশ ঘটাতে। আর সর্বোপরি সমাজকে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে আমাদের সন্তানেরাও মানুষ। তাদের আর সাধারণ সবার মতো বাঁচতে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য সমাজের প্রতি আমার আহ্বান। সবার একত্র আন্তরিকতাতেই এ সমাজ সবার জন্য বসবাসের উপযোগী হবে। আমরা আশায় থাকব এই অনাগত দিনের জন্য।