মধ্য ইউরোপের পানিপথে একদিন

মার্শাল টিটো স্কয়ার, কপার। ছবি: সংগৃহীত
মার্শাল টিটো স্কয়ার, কপার। ছবি: সংগৃহীত

‘পানিপথ’—হয়তোবা এ নামটির সঙ্গে পরিচয় নেই এমন কোনো মানুষকে অন্তত আমাদের উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুলে পড়ার সময় বইতে পানিপথের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় যুদ্ধ সম্পর্কে আমরা পড়েছি। এমনকি উচ্চমাধ্যমিকেও আমাদের পাঠ্য ছিল নাট্যকার মুনীর চৌধুরী রচিত অমর সৃষ্টি ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ যার মূল পটভূমি উপজীব্য হয়েছিলও পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। বর্তমান ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত পানিপথের যুদ্ধ একই সঙ্গে যেমন এ উপমহাদেশে নতুন কোনো সাম্রাজ্যের ভিত্তির সূচনা ঘটেছিল, ঠিক একই সঙ্গে লোদি, হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য কিংবা মারাঠা সাম্রাজ্যের মতো প্রতিপত্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর পতনের সাক্ষী হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে এই পানিপথ।

ঠিক একইভাবে মধ্য ইউরোপে ত্রিয়েস্তে ও কপার—দুটি শহরকে মধ্য ইউরোপের পানিপথের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। দুটি শহরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কিংবা বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের ভার্সাইতে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে আজকের ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানচিত্র রচিত হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালীন সময়ে ভার্সাইতে স্বাক্ষরিত চুক্তির ফলে আজকের ইউরোপের বিভিন্ন দেশের যে মানচিত্র রচিত হয়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিল দুটি শহর—ত্রিয়েস্তে ও কপার।

ঐতিহাসিক কিংবা ভৌগোলিক অবস্থান—যেকোনো দিক বিবেচনায় মধ্য ইউরোপের সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছে ত্রিয়েস্তে ও কপার শহর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে এবং বলকান পর্বতমালার প্রায় সমঙ্গস্থলের দুটি শহরের সৌন্দর্য বলে কিংবা লিখে শেষ করা যাবে না। ছবির মতো সুন্দর দুটি শহরে বছরের প্রায় সময়ই পর্যটকের আনাগোনা থাকে, বিশেষ করে এখানে ত্রিয়েস্তের কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়।

শীতের শেষে বসন্তের প্রাক্কালে এভাবেই স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন স্থানে ভেসে ওঠে বিজ্ঞাপন। ছবি: লেখক
শীতের শেষে বসন্তের প্রাক্কালে এভাবেই স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন স্থানে ভেসে ওঠে বিজ্ঞাপন। ছবি: লেখক

আজকের পৃথিবীতে আমরা ‘গ্লোবালাইজেশন’ কিংবা ‘মাল্টিকালচারাল’—এ ধরনের যেসব শব্দ ব্যবহার করি, তার সবকিছুই একসময়, বিশেষ করে গত শতাব্দীর প্রথম ভাগেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব সময় পর্যন্ত এ শহরে ছিল। এমনকি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের শাসনকালেও এ শহরটি স্লোভেনিয়ান, ইতালিয়ান, অস্ট্রিয়ান, জার্মান, হাঙ্গেরিয়ান, ক্রোয়েশিয়ানসহ ইউরোপের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পদচারণে মুখর থাকত। আজকের পৃথিবীতে নিউইয়র্ককে অনেকে যেমন এ পৃথিবীর রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন, ঠিক সে সময়ের প্রেক্ষাপটে ইউরোপের অঘোষিত রাজধানী হিসেবেও ত্রিয়েস্তেকে উল্লেখ করলে ভুল কিছু বলা হবে না। এমনকি ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে যখন পুরো ইউরোপ শীতের চাদরে ঢেকে যায়, সে সময়ও ত্রিয়েস্তে উষ্ণ, এবং এতটাই উষ্ণ যে শুধু গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে অনায়াসে যে কেউ হেঁটে বেড়াতে পারেন। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ইলিরীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দ্বারা এ শহরটির গোড়াপত্তন হয়। এরপর আনুমানিক ৫২ থেকে ৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি কোনো সময়ে জুলিয়াস সিজার শহরটিকে রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর ত্রয়োদশ কিংবা চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে শহরটি রিপাবলিকা ভেনেটার জলপথে বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৮২ সালে শহরটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য অর্থাৎ হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বকালীন সময় পর্যন্ত শহরটি হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। যদিও ১৫০৮ থেকে ১৫১৬ সাল পর্যন্ত ত্রিয়েস্তে আবারও ভেনেটিয়ানদের দখলে চলে যায় এবং ১৮০৯ সালের দিকে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ত্রিয়েস্তে দখল করলে কিছু সময়ের জন্য এ শহরটি হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের থেকে হাতছাড়া হয়। আজকের দিনে আমরা যে অস্ট্রিয়া দেখতে পাই বিশ্ব মানচিত্রে, সেটি একটি ল্যান্ডলকড কান্ট্রি এবং দেশটিতে কোনো সমুদ্রের উপস্থিতি নেই। অস্ট্রিয়ার মতো চেক রিপাবলিক এবং হাঙ্গেরিও ল্যান্ডলকড। তাই অস্ট্রিয়ানরা ত্রিয়েস্তেকে তাদের বাণিজ্যিক সমুদ্রবন্দর হিসেবে গড়ে তুলেছিল। আবার ভিপাভা উপত্যকার নিকটে অবস্থিত হওয়ায় মধ্যযুগ থেকেই ত্রিয়েস্তেতে স্লোভেনিয়ান এবং একই সঙ্গে অনেক ক্রোয়েশিয়ান জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরও বসবাস ছিল। একই কারণে উত্তর-পূর্ব ইতালির গোরিজিয়া, মনফালকোন এবং উদিনেতেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্লোভেনিয়ান জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিল।

স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা হলেও ত্রিয়েস্তে হলো সেই শহর, যেখানে সবচেয়ে বেশি স্লোভেনিয়ান জাতিগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। স্লোভেনিয়ার কিংবা ক্রোয়েশিয়ার ভাষায় ত্রিয়েস্তেকে ‘টার্স্ট’ নামে অভিহিত করা হয়। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অধীন চতুর্থ বৃহত্তম নগরীও ছিল ত্রিয়েস্তে। ল্যাটিন, স্লাভিক, জার্মানিক, ইউরেলিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উপস্থিতি শহরটিকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। আজও শহরটিতে একদিকে যেমন রোমানদের স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি অস্ট্রিয়ান তথা জার্মান এবং স্লোভেনিয়ান ও ক্রোয়েশিয়ানদের স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনও রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের আদান-প্রদান, সাগরপথে বাণিজ্য, শিল্প ও সাংস্কৃতিক আদান–প্রদান—সবদিক থেকেই এ শহরটি হয়ে উঠেছিল চারটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মিলনমেলা।

ত্রিয়েস্তে থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে কপারের অবস্থান, ত্রিয়েস্তের মতো কপার যদিও আড্রিয়াটিক সাগরের তীরবর্তী একটি শহর এবং বিভিন্ন ধরনের সুউচ্চ পর্বতমালা দ্বারা বেষ্টিত, তবে কপার ত্রিয়েস্তের মতো এতটা উষ্ণ নয়। শীতের সময় এ অঞ্চলে শক্তিশালী বাতাস প্রবাহিত হয় এবং এখানে বছরের প্রায় সময়ই বৃষ্টিপাত হয়। কপার বর্তমান স্লোভেনিয়ার একমাত্র বন্দরনগরী, যেখানে সাগরপথে স্লোভেনিয়ার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য দেশের বাণিজ্যিক যোগসূত্র রয়েছে। কপার, পিরান, পোর্তোরস, ইজোলা—সব জায়গা মূলত প্রসিদ্ধ ওল্ড টাউনের জন্য। যদিও জনসংখ্যার বিচারে এগুলো হয়তোবা খুব বেশি বড় শহর নয়। কোনো এক সুউচ্চ জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে যখন আপনি আড্রিয়াটিক সাগরের তীরবর্তী কপার, পিরান, পোর্তোরস কিংবা ইজোলাকে দেখার চেষ্টা করবেন, আপনার মন চাইবে কোনো এক অজানায় মিশে যেতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মানবসৃষ্ট স্থাপত্যশৈলী—দুই মিলিয়ে আপনার মনে এক অপার্থিব অনুভূতির সৃষ্টি করবে। যদিও আজকের দিনে কপার, পিরান, পোর্তোরস, ইজোলা অঞ্চল স্লোভেনিয়ায় পড়েছে। কিন্তু মূলত ঐতিহাসিকভাবে এগুলো আসলে একচেটিয়াভাবে ইতালিয়ানদের শহর বললেও ভুল হবে না। স্থাপত্যশৈলীও সেটি ইঙ্গিত করবে এবং ১৯০০ সালে করা এক জনগণনা অনুযায়ী কপারের ৭,৮৩০ জন অধিবাসীর মধ্যে ৭,২০৫ জনই ছিলেন ইতালিয়ান। অবশিষ্ট মানুষ ছিলেন স্লোভেনিয়ান, জার্মান ও ক্রোয়েশিয়ান। কপার থেকে শুরু করে ক্রোয়েশিয়ার পুলা অথবা পোরেচে সমগ্র অংশে এখনো উল্লেখযোগ্য ইতালিয়ান জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এবং এ অঞ্চলে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের প্রায় সবাই দ্বিভাষী। স্লোভেনিয়ান বা ক্রোয়েশিয়ানের পাশাপাশি সবাই এখানে ইতালিয়ান শেখেন এবং এ অঞ্চলের সব পরিষেবায় স্লোভেনিয়ান বা ক্রোয়েশিয়ান ভাষার পাশাপাশি ইতালিয়ান ভাষাও ব্যবহার হয়।

চিরায়ত ত্রিয়েস্তের সামনে লেখক। ছবি: লেখক
চিরায়ত ত্রিয়েস্তের সামনে লেখক। ছবি: লেখক

কপারের সেন্টার কিংবদন্তি নেতা যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়কের নামে এ জায়গাটিকে মার্শাল টিটো স্কয়ার বলে ডাকা হয়। মার্শাল টিটো স্কয়ারের ক্যাথেড্রালটি স্লোভেনিয়ার স্থানীয় ভাষায় ‘স্টোলনা চেরকেভ মারিয়েনিগা ভিনেবভজটিয়া’ নামে ডাকা হয় এবং দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নির্মিত এই ক্যাথেড্রালটি মধ্যযুগীয় ইউরোপের স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন।

একটু আগেই বলেছি যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ গোটা ইউরোপ মহাদেশের ইতিহাসে বিস্ময়কর পরিবর্তন নিয়ে আসে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য এবং অটোমান সাম্রাজ্যের মতো প্রতিপত্তিশালী সাম্রাজ্যগুলো এ সময় পতনের মুখে পতিত হয়। মোস্তফা কামাল তুরস্কের ক্ষমতা গ্রহণের পর তুরস্ককে আধুনিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং অটোমান সাম্রাজ্যকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, গ্রিস, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, রোমানিয়া, মন্টিনিগ্রো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভার্সাই চুক্তির ফলে হাঙ্গেরিকে ভেঙে আজকের অবস্থানে আনা হয়। ট্রানসিলভানিয়াকে রোমানিয়ার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এমনকি অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়ার আজকের মানচিত্র রচিত হয়েছে ভার্সাই চুক্তির ফলে। যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জয়লাভ করেছিল এবং তারাই এ ভার্সাই চুক্তির মূলে কলকাঠি নেড়েছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জয়লাভ করলেও আসলে তাদের অধীন উপনিবেশগুলো এ সময় স্বাধীনতার দাবি জানাতে শুরু করলে তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে ভেঙে পড়তে থাকে এবং লেনিন ও রাসপুটিনের নেতৃত্বে রুশবিপ্লব সংগঠিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার আত্মপ্রকাশে অবদান রাখে। হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া পূর্ব ইউরোপের দেশে রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার নেতৃত্বে স্লোভেনিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া অ্যাান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো ও সার্বিয়ার অধিকৃত আলবেনীয় অংশটি, যা আজকের দিনে ‘কসোভো’ নামে পরিচিত এসব রাষ্ট্র মিলে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন গঠন করে। যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ছিল লেনিন কিংবা স্ট্যালিনের সমাজতান্ত্রিক কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ছিল সম্পূর্ণ উদার ধাঁচের, কিন্তু এরপরও যেহেতু ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ছিল সমাজতান্ত্রিক শাসনের বিরোধী এবং তাদের মধ্যে একটি ভয় ছিল যে যুগোস্লাভিয়ার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ধেয়ে আসে মধ্য ইউরোপের দিকে, এ কারণে কপারকে ইতালি থেকে নিয়ে যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পোর্তোরস, পিরান, ইজোলাকে যুগোস্লাভিয়ার করা অন্তর্ভুক্ত হয়।

ত্রিয়েস্তেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের পাঞ্জাব কিংবা বাংলার সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। কেননা অবিভক্ত ভারতবর্ষের পাঞ্জাব কিংবা বাংলাতে মুসলিম ও অমুসলিম এ দুই সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল সংখ্যায় প্রায় কাছাকাছি; ঠিক তেমনি ত্রিয়েস্তেতেও ইতালিয়ান ও স্লোভেনিয়ানরা ছিল সংখ্যায় কাছাকাছি। ইতালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে গেলেও ইতালিয়ান ও স্লোভেনিয়ান দুই জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দাবি ছিল ত্রিয়েস্তে কিন্তু ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তৎকালীন উদীয়মান পরাশক্তি রাশিয়া এবং সমাজতন্ত্রের কথা চিন্তা করে ত্রিয়েস্তে, উদিনে ও মনফালকোনকে ইতালির অন্তর্ভুক্ত করে। গোরিজিয়াকে দুই ভাগ করে এক ভাগের মালিকানা ইতালিকে এবং অন্য অংশের মালিকানা যুগোস্লাভিয়া পায়, যা পরে নোভা গোরিছা নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে স্লোভেনিয়া গঠিত হলে পোর্তোরস, পিরান, ইজোলা ও নোভা গোরিছা স্লোভেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। ভার্সাই চুক্তির পরবর্তী ইতালিতে যেসব স্লোভেনিয়ানরা থেকে গিয়েছিল, তাদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার, স্লোভেনিয়ানদের ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চাকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং স্লোভেনিয়ান অনেক নিদর্শনকে মুছে ফেলা হয়। অনেক জায়গায় এ সময় থাকা স্লোভেনিয়ান নামগুলোকে ইতালিয়ান ভাষায় রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে কপার, পোর্তোরস, পিরান, ইজোলা কিংবা ক্রোয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করা ইতালিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অনেক মানুষ পাড়ি জমান ইতালিতে। আজকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে এবং ইতালি, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া—সবাই এ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এবং সব অতীত ইতিহাসকে ভুলে আজকে সবাই চেষ্টা করছে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের ভিত্তিতে কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় সে লক্ষ্যে।

স্লোভেনিয়াতে গণপরিবহন খুব বেশি মানসম্মত নয়। কেননা এখানে প্রায় সবার নিজস্ব গাড়ি আছে, এমনকি একটা পরিবারে যদি চারজন সদস্য থাকে, তাহলে চারজনের জন্য চারটি গাড়ি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি অনেক সময় ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীও নিজস্ব গাড়ি থাকা খুবই সাধারণ ব্যাপার। গণপরিবহন সেবা ‘নোমাগো’ নামক কোম্পানির অধীনে এবং ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় পরিবহনসেবা, বিশেষ করে ইন্টারসিটি ট্রান্সপোর্ট অনেক বেশি ব্যয়বহুল। সব সময় যে গণপরিবহনসেবা পাওয়া যাবে—এমনটিও নয়। তাই সবাই নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করেন। এখানে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস (যা স্থানীয়দের কাছে ‘প্রিভোজি’ নামে পরিচিত) খুবই জনপ্রিয়। অপেক্ষাকৃত কম সময়ে এবং কম খরচে প্রিভোজির মাধ্যমে স্লোভেনিয়ার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিংবা আশপাশের দেশগুলোতে ভ্রমণ করা যায়।

গত জানুয়ারিতে আমি মাল্টা ভ্রমণের পরিকল্পনা করি এবং ফ্লাইট ছিল ত্রিয়েস্তের এয়ারপোর্ট থেকে। আমি লুবলিয়ানা থেকে ত্রিয়েস্তে যাওয়ার জন্য রাইডের সন্ধান করি এবং আমার সঙ্গে ইয়োজে নালের পরিচয় হয়। ইয়োজে নাল একটি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে কাজ করেন এবং তিনি স্লোভেনিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ছোট শহর মেটলিকাতে থাকেন। বয়স চল্লিশের ওপরে এবং তিনি খুব বেশি সাংসারিক জীবনেও বিশ্বাস করেন না, ক্যাসিনো আর লটো খেলা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস। লটো হচ্ছে ইউরোপে প্রচলিত বিশেষ ধরনের খেলা, যেখানে আপনাকে আপনার নিজের ইচ্ছামতো কতগুলো নম্বর নির্বাচন করতে বলা হবে এবং যদি আপনার দেওয়া নম্বরগুলো ড্রয়ের সময় প্রদত্ত নম্বরগুলোর সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার পাবেন। সব ধরনের ক্যাসিনোভিত্তিক কার্যক্রম থেকে স্লোভেনিয়াতে তিনি নিষিদ্ধও তিন বছরের জন্য। এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছেন যে স্লোভেনিয়াতে না পারলেও পার্শ্ববর্তী ক্রোয়েশিয়া বা অস্ট্রিয়াতে যান ক্যাসিনো খেলতে এবং প্রায়ই তাঁর অর্থ খোয়া যায়। তিনি চেষ্টা করছেন ক্যাসিনো থেকে বেরিয়ে আসতে, কিন্তু তিনি সেটি পারছেন না। নতুন যখন কারও সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, তিনি তাঁদেরকে পরামর্শ দেন আর যা-ই করুক না কেন, কেউ যেন ক্যাসিনোর ধারেকাছেও না যান। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের আগের দিন রাতেও তিনি ক্রোয়েশিয়াতে গিয়ে ক্যাসিনো খেলে প্রায় ১৫০০ ইউরোর মতো হারান। এ জন্য তিনি মনের প্রশান্তি অর্জন করতে ত্রিয়েস্তে যাচ্ছিলেন। আমি নিজে খুবই ভ্রমণপ্রিয় মানুষ এবং আমি চেষ্টা করি প্রায়ই সময়েই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়তে, অজানা কিংবা নতুনকে সন্ধান করতে। আমিও তাঁকে পরামর্শটি দিলাম ভ্রমণের। তাহলে ক্যাসিনো থেকে দূরে থাকা যাবে। পরামর্শটি ভালো লেগে গেল তাঁর। যখন তিনি কোথাও ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন আমাকে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য।

স্বভাবে ইয়োজে নাল একটু পাগলাটে ধরনের এবং অনেকটা রসিক মানুষ। তাঁর মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। চতুর্থ সেমিস্টার শুরুর আগের দিন নিজের থেকেই একটু প্রশান্তির জন্য কোথাও ঘোরার পরিকল্পনা করছিলাম। এমন সময় ইয়োজ ত্রিয়েস্তে এবং কপার ভ্রমণের কথা জানালেন। সামলাতে পারলাম না। ভিপাভা থেকে চলে গেলাম লুবলিয়ানাতে। লুবলিয়ানার সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিনি আমাকে গাড়িতে তুললেন।

ক্যাসিনো থেকে ভ্রমণপ্রিয় হয়ে ওঠা ইয়োজের সঙ্গে লেখক। ছবিটি তোলা হয়েছে ত্রিয়েস্তের সেন্টার থেকে। ছবি: সংগৃহীত
ক্যাসিনো থেকে ভ্রমণপ্রিয় হয়ে ওঠা ইয়োজের সঙ্গে লেখক। ছবিটি তোলা হয়েছে ত্রিয়েস্তের সেন্টার থেকে। ছবি: সংগৃহীত

শুরু হলো এক দিনের জন্য মধ্য ইউরোপের পানিপথের সফর। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় এবং একই সঙ্গে শীতের শেষ ও বসন্তের আগমনের প্রাক্কাল হওয়ায় স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন জায়গায় কার্নিভালের প্রস্তুতি চলছিল। স্লোভেনিয়া আর ক্রোয়েশিয়াতে সবাই এ সময় এক বিশেষ ধরনের ডোনাট কফি খেয়ে থাকে এবং দোকানগুলোতে এ সময় কফি বিক্রির ধুম পড়ে যায়। রাস্তাঘাট থেকে আরম্ভ করে সব জায়গাতে এ সময় আলোকসজ্জায় ফুটে ওঠে ও বিভিন্ন বর্ণিল রঙে সাজানো হয়। ছোট বাচ্চারা এ সময় কার্টুন কিংবা বিভিন্ন কমিক চরিত্রের আলোকে নিজেকে সজ্জিত করে। কি ত্রিয়েস্তে, ক কপার—কোথাও আনুষ্ঠানিকতার কোনো কমতি ছিল না। তবে যেকোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানের আয়োজনে ইউরোপের মধ্যে ইতালিয়ান কিংবা স্প্যানিশদের অথবা পর্তুগিজদের জুড়ি মেলা ভার। তারা আমাদের মতোই অনেকটা আবেগপ্রবণ এবং একই সঙ্গে কিছুটা বাঁচাল স্বভাবের; তবে আন্তরিকও বটে। ত্রিয়েস্তের সেন্টারে যেতে না যেতেই দেখি হাজারো মানুষ, সে তুলনায় কপার ছিল অনেকটা ফাঁকা। ইয়োজের বদৌলতে ত্রিয়েস্তে আর কপার ঘুরা হলো এবং এ দুটি জায়গার ইতিহাস নিয়েও একটি ধারণা পেলাম।

ত্রিয়েস্তেতে তিনজন বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের সিলেটে। তাঁদের আন্তরিকতাও ভুলে যাওয়ার মতো নয়।

কয়েক দিন আগে আবারও ইয়োজের সঙ্গে কথা হলো। আমাকে জানালেন, তিনি এখন নাকি আর ক্যাসিনোতে যাচ্ছেন না। এর পরিবর্তে তিনি আশপাশের দেশগুলোতে ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন। তাঁর এ কথা শুনে ভালো লাগল, অন্তত একটু হলেও একটা মানুষের উপকার করতে পেরেছি। আশা করি, সামনের দিন হয়তো বা ইয়োজের সঙ্গে আরও কয়েকটি জায়গায় ভ্রমণ করতে পারব। এভাবেই বন্ধুত্ব আরও বেশি দৃঢ় হবে।

তবে তৃতীয় সেমিস্টার শেষে চতুর্থ সেমিস্টার শুরুর আগে এ রকম একটি ভ্রমণ ছিল সত্যি উপভোগ করার মতো এবং আক্ষরিক অর্থে আমার মন সেদিন নতুন উদ্যমতায় ভরে উঠেছিল। আসলেই নতুন কোনো কিছুকে জানার উদ্দেশ্যে হোক কিংবা মনের সংকীর্ণতা দূর করার উদ্দেশ্যে হোক, মানুষের জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে ভ্রমণের বিকল্প নেই। সত্যি এ পৃথিবী আসলেই অনেক সুন্দর এবং তার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপার সৌন্দর্য। হয়তো ইউরোপে না এলে কিংবা বিশ্বভ্রমণে বের না হলে ব্যবহারিকভাবে তা কোনো দিন জানাই হতো না।
*শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা,