আমার শহরে আষাঢ় নামুক বৃষ্টির হাত ধরে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

একটা সময় ছিল যখন বাড়ির সামনে ছিল সবুজের মেলা। খালবিল আর সবুজের সমারোহে পরিবেশ ছিল অন্য রকম। তখন গ্রীষ্ম আসত কালবৈশাখী নিয়ে। তপ্ত দিনের পর বিকেলে হামেশাই আসত কালবৈশাখী, যা ভেঙেচুরে তছনছ করে দিত গাছপালাগুলোকে। পরের দিন স্মৃতিচিহ্ন রূপে পড়ে থাকত ভাঙা ডাল ও পাতাগুলো। তারপর গ্রীষ্ম ছুটি নিলে আসত বর্ষা। বর্ষা আসত নিয়ম মেনে। মস্ত বাড়িগুলো যখন আকাশ ঢেকে দেয়নি। শহর সেজে ওঠেনি বিজ্ঞাপনে।

মেঘেদের রং চেনা যেত। শহর ঢেকে থাকত মেঘের চাদরে। বৃষ্টি মানেই সারা দিন ছন্দের ক্লাস। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে মেঘের আওয়াজ। বৃষ্টি মানেই নস্টালজিয়া আর স্মৃতির কক্ষপথে হাঁটা। খুব যখন ছোট তখন বৃষ্টি মানে ছিল ছুটির দিন। সকালে বৃষ্টি দেখলেই আনন্দ হতো মনে। আজ আর স্কুল যেতে হবে না। সারা দিন ঘরে বসে খেলা আর দুপুরে ডিমভাজা–সহযোগে খিচুড়ি, সে এক অন্য অনুভূতি। তারপর যখন হাইস্কুলে, অন্যদিন স্কুল যাই না যাই, বৃষ্টি হলে স্কুল যেতেই হবে। কারণ, জানতাম আজ রেনি ডে, এমনিতেই ক্লাস হবে না। স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন বৃষ্টি নামত কচুপাতা মাথায় দিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কচুপাতার রস সাদা জামায় পড়ে তৈরি হতো ‘বর্ষা প্রিন্ট’, যা কোনো ডিটারজেন্টেই তোলা যেত না।

একসময় মাঠের ওপার ঝাপসা হয়ে আসত বৃষ্টিতে। দূর থেকে আসা বৃষ্টি বয়ে নিয়ে আসত ফুলের গন্ধ। মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেত খেলা। মাঠজুড়ে যার দাপিয়ে ফুটবল খেলত জলকাদায়, তারা ছাড়া বাকি সবাই বৃষ্টি এড়াতে দৌড়াত নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। আকাশভাঙা বৃষ্টিতে মাঠজুড়ে দৌড় কখনো পিছলে পড়ে কাদায় মাখামাখি, একজনের ওপর আরেকজন, ভয় ছিল না কোনো চোট–আঘাতের, পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাটি মেখে বাড়ি ফেরা। জ্বর, সর্দি, কাশি, ভাইরাল ফিভার, ইনফেকশান, সব জলে ধুয়ে চলে যেত। এসবের প্রকোপের চেয়ে বৃষ্টির প্রভাব মনে পড়ত বেশি। যে মেয়েটির চোখে হিরো হতে হবে, তাকে দেখে যেন আরও বেশি করে ভেজা। রাস্তা সুনসান। একলা চালক রিকশা নিয়ে যায় গান গাইতে গাইতে। টিউশন–ফেরত ছেলেমেয়েরা সাইকেলে ফেরে ভিজতে ভিজতে।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ভিজতে এখনো ইচ্ছা করে, কিন্তু উপায় নেই। নিজে ভিজলে ক্ষতি নেই, কিন্তু স্মার্টফোন ভেজানো যাবে না। শহরতলি, মফস্বলের ভেজার গল্প জমে অনেক। এখন বৃষ্টি এলে ভেজা দূরে থাক, বৃষ্টিকে তাড়াতে আমরা ব্যস্ত থাকি। অথবা ব্যস্ত হয়ে পড়ি ব্যস্ততার অজুহাতে। ছাতা, বর্ষাতি তো আছেই, আর ঘরেও জানালা বন্ধে ব্যস্ত আমরা। আমরা চাই বর্ষা আসুক, কিন্তু আমরা যখন বর্ষাতির ছাদ পাব তখন। চাই বৃষ্টি নামুক আমার সব কাজ শেষ হয়ে গেলে। নিরাপদ আশ্রয়ে বসে ভিজে যাওয়া শহর দেখার স্বার্থপরতা আমাদের। মাঠে যাওয়া যাবে না তাতে কী? ঘরেই জমত খেলা। ক্যারাম, তাস, লুডো, আর চিলেকোঠায় ছায়া আসত ভূতের গল্পের। বৃষ্টি আসার অপেক্ষায় থাকত কাগজের নৌকারা। সেসব খেলার দিন আর ছোট ছোট বিষয়ে আনন্দ পাওয়া আজ ইতিহাসে মুখ গুঁজেছে। খাতার পেছনের পাতায় বর্ষা নিয়ে লেখা কবিতা আর তা ভাসিয়ে দেওয়ার পর দুলে দুলে, চলে যেত সেখানে শৈশব দেহ রেখেছে। এখন সেই বৃষ্টিতে আর সেই বর্ষাকে আকাশের দিকে না তাকিয়ে মুঠোয় ধরা মোবাইলে দেখা যায়। এখন বানভাসি শহর হলে তাতে জমা জলে... মশা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া আর ডায়রিয়ার ভয়। আর পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া গাড়ির জলের ছিটেয় গায়ে জামা কাপড়ের দফারফা। জমা জল দেখতে শহরের এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় ভিড়। সারা রাত বৃষ্টি হলো তো জল কতটা বাড়ল দেখার তাড়া। বৃষ্টির অজুহাতে আরও একটা দিন ছুটি। এ ছুটি বৃষ্টিকে উপভোগের নয়, বদ্ধ ঘরে আলসেমির!

ছুটি মানেই আরও একটা ডুব। রেনি ডে। এখন বর্ষা আসে টিভিতে। প্রবাসী সন্তানের মা–বাবা মফস্বলে রাত জাগে, অনেক দূর দেশ থেকে আসা ফোনের অপেক্ষায়। বৃষ্টি এলে চোখে ভাসায় স্মৃতি, বুকের ভেতরে বিষণ্নতায় একটানা চলে তেপান্তরের খোঁজ। প্রবাসীর চোখেও তখন গোলাপবাগের গাছগুলোর প্রথম বৃষ্টি মাখার সতেজতা পায়। স্কুলের পাশে চাঁপা ফুলের গাছটার গন্ধ সব মিলেমিশে একাকার। শহরের কোনায় কোনায় একটা মেঘদূত লেখার রসদ হাজির থাকে। বর্ষার বিকেলে বন্ধ হওয়া জানালার ভেতরে সব কটা বাড়িতেই একটা করে গল্প জমাট বাঁধে। সে গল্পের হদিস থাকে না আমাদের। অনেক অমিলের মধ্যেও মিল থাকে। যার ভিজত পথের ধারে, ফুটপাতে তারা এখনো ভেজে। কান্নার সময় আকাশভাঙা বৃষ্টি চায় কেউ, চোখের জল মিলেমিশে যায় একসঙ্গে তাদের। ছাদ সারানোর ক্ষমতা নেই, যাদের চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির জন্য বরাদ্দ থাকে বালতি। পুকুরের জল একইভাবে আলপনা কাটে। তবে ব্যস্ত শহরের চোখে পড়ে না আর। এখন বর্ষা দামি বর্ষাতির কাছে হার মেনেছে।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

একটা দিন আচমকা শহরের ঘুম ভাঙবে বৈশাখী ঋণ শোধ করে দেওয়া বৃষ্টিতে। অজস্র কালো ছাতা হেঁটে যাবে রাস্তা দিয়ে, মেঘের সঙ্গে সঙ্গে মনে জমানো অভিমান আর বিচ্ছেদের মনখারাপেরা গলে গলে পড়বে। যান্ত্রিক সব সমীকরণকে ছাপিয়ে গিয়ে মেঘমল্লার বাজবে একটানা। কান পাতলে শোনা যাবে নিত্যকালের প্রিয়ার চপল অভিসারের আওয়াজ। একটানা ঝিঁঝি আর ব্যাঙের ডাকের কনর্সাটে নিভু আলোয় বাড়ি ফেরার রাস্তায় আচমকা আসবে বর্ষাদিনের ফেলে আসা গল্পেরা। জলছবির মতো দেখতে পাওয়া সন্ধেয় আকাশের সব মেঘেরা হয়ে যাবে রূপকথার চরিত্র। জীবনের চাওয়া-পাওয়া এবং না পাওয়াদের জমাটি আড্ডায়, রূপকথার চরিত্রেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে অঝোর বৃষ্টিতে একের পর এক পড়ত খসে পড়া আমাদের। বর্ষা ঋতু আমাদের শহরে এবার আসুক স্বপ্নের কারবারি হয়ে, হাতের তালুতে বন্দী মেঘ হয়ে যাক ঘুমভাঙানিয়া ভোর। বৃষ্টির ক্ষত সেরে উঠুক ব্যস্ততার শহরে। মাটির সোঁদা গন্ধ প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ুক। পুরোনো দিনের সেই বর্ষা মাতিয়ে তুলুক আধুনিক যন্ত্রমানবদের। এক মেঘগর্জনের লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যায় জমে উঠুক শিহরণ জাগানো সেসব গল্প। আবেগে মিশে যাক বর্ষা ঋতু। দূরের মানুষেরা কাছে আসুক সমস্ত বিদ্বেষ সংঘাতের প্রাচীর ভেঙে। প্রকৃতি ফিরে পাক তার আদিম সন্তানদের সবুজের মোড়কে। শ্রাবণের প্লাবন আসুক প্রত্যেকের হৃদয়ে। মুঠোফোনের কয়েক ইঞ্চি স্ক্রিনে বর্ষার রূপ যারা দেখতে অভ্যস্ত, তারা বর্ষার বাংলাকেই দেখেনি দুচোখ ভরে।