ধারাবাহিক রচনা: বিলেতে সাইকিয়াট্রিস্টের জার্নাল-৯

তিনি হন্যে হয়ে ক্যামেরা খুঁজছেন!

৫৯ বছর বয়সের এলিজাবেথ পেশায় স্কুলশিক্ষিকা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাজ্যেও লকডাউন চলছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। অফিস–আদালতও প্রায় বন্ধ। জীবন এখন থমকে আছে।

এলিজাবেথের হাতে এখন অফুরন্ত সময়। অনলাইনে মাঝেমধ্যে ক্লাস নিচ্ছেন। স্কুলের কিছু কাজ করছেন। সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ গাইডলাইন ফলো করছেন। স্কুল খুলবে কিংবা খুলবে না—এ নিয়ে সরকারের দোদুল্যমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। যাপিত জীবন থেকে একটু সরে এসেছেন। এক ছেলে ও মেয়ে বড় হয়ে গেছে। ভিডিও কলে মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়েদের খবর নিচ্ছেন। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর অনেকটা একাকী জীবন যাপন করছেন। করোনার সময় সেই একাকিত্ব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সেই একাকিত্বই তাঁর জীবনে অভিশাপ হয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। তাকে কেউ একজন ফলো করছে।

এ সপ্তাহে ব্রিটিশ সরকার লকডাউন কিছুটা শিথিল করেছে। আর এই সুযোগেই ছেলে ডেভিড মাকে দেখতে বাসায় এসেছে। কিন্তু বাসায় প্রবেশ করেই তার চক্ষু চড়কগাছ। বাসায় এসব কী হচ্ছে? অস্থির হয়ে সে হাসপাতালে ফোন করেছে। আর সেই সূত্র ধরে আমরা এলিজাবেথকে দেখার সিদ্ধান্ত নিই।

ঘরের দেয়ালের অনেকগুলো জায়গায় প্লাস্টার খুলে ফেলা হয়েছে। সিলিং থেকে লাইট খুলে মেঝেতে রাখা হয়েছে। ৫০ ইঞ্চি টেলিভিশনকে জানালার বড় পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ইউটিলিটি রুমে রাখা ওয়াশিং মেশিনকে সরিয়ে এনে রান্না ঘরে রাখা হয়েছে। ল্যান্ডলাইন টেলিফোন সেটকে তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। পুরো বাসার জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে, কেউ একজন এসে সবকিছু তছনছ করে গেছে। কিন্তু কাজটি করেছেন এলিজাবেথ নিজেই। বাসার ভেতরে তিনি গোপন ক্যামেরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গত কয়েক দিন ধরে তিনি ক্যামেরা খুঁজছেন!

ঘরের ভয়াবহ অবস্থা দেখে মাকে ডেভিড জিজ্ঞেস করেছে, ‘এসব কী হচ্ছে? ঘরের অবস্থা এ রকম কেন? এসব কে করেছে? চার দিন আগে তুমি যখন আমার সঙ্গে ভিডিও কলে ছিলে, তখন তো এসবের কিছুই দেখিনি।’

ডেভিড মায়ের মুখে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা লক্ষ করে। বোঝাই যাচ্ছে এলিজাবেথ প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে আছেন। কিছু একটা হচ্ছের আতঙ্ক এলিজাবেথের চোখেমুখে। সেই আতঙ্ক এখন ডেভিডের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ভয় ও উৎকণ্ঠায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে হাসপাতালে ফোন করেছে।

আমি আমার সহকর্মীসহ এলিজাবেথকে দেখতে এসেছি। ইংল্যান্ডে যাকে বলা হয় হোম ভিজিট। মাঝেমধ্যেই আমাকে হোম ভিজিট করতে হয়।

করোনাঝুঁকি থাকায় আমাদের পিপিই ব্যবহার করতে হয়। সেই পিপিই পরেই আমরা হাজির হই এলিজাবেথের বাসায়।

আমরা যখন তার বাড়িতে হাজির হই, তখন শনিবার দুপুর। বেশ কিছুদিন পর ইংল্যান্ডে একটি রোদেলা ঝলমলে দিন। বাইরে লোকজনের চলাচল কম। তাই খুব সহজেই স্বল্প সময়ে তার বাড়িতে এসে হাজির হই আমরা।

কোলাহলবিহীন নিরিবিলি এলাকায় এলিজাবেথের বাড়ি। পাহাড়ি এলাকা বলা যেতে পারে। এলিজাবেথের বাড়িকে আমরা ফার্ম হাউস বলতে পারি। কয়েক শ গজ হাঁটলে কেবল অন্য বাড়ির দেখা মিলবে। আশপাশে লোকজনের দেখা পাওয়া ভার। ডানে-বাঁয়ে দুটি ছোট সবুজ মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা দিয়ে আমরা এলিজাবেথের ফার্ম হাউসে প্রবেশ করি। ছেলে ডেভিড ইতিমধ্যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কলিং বেল টিপে বাইরে যখন আমরা অপেক্ষা করছি, তখন খেয়াল করে দেখলাম এলিজাবেথের ঘরের বড় জানালাগুলো এই রোদের মধ্যেও কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা। বাইরে যখন অপেক্ষা করছি, তখন ভেতরে থাকা এলিজাবেথের উত্তেজিত কণ্ঠ আমাদের কানে ভেসে আসে। এলিজাবেথ আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেবেন না। ডেভিডকে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে শুনি। শেষমেশ ছেলে ডেভিড এসে দরজা খুলে দেয়। আমরা বুঝতে পারি এলিজাবেথের কাছে আমাদের হোম ভিজিট ভালো লাগছে না।

স্বাভাবিক দূরত্বের চেয়ে বেশি দূরত্ব বজায় রেখে এলিজাবেথ জড়োসড়ো হয়ে আমাদের সামনে বসেন। আমি তার চোখেমুখে আতঙ্ক দেখতে পাই। অভয় দিয়ে আমাদের আইডি কার্ড তাকে দেখাই। আশ্বস্ত হলেন কি না, বোঝার কোনো উপায় নেই। আমরা কথা বলতে শুরু করি। কথা বলার সময় খেয়াল করি এলিজাবেথ কিছুক্ষণ পরপর ডানে–বাঁয়ে তাকাচ্ছেন। অদৃশ্য ভয় তাকে জাপটে ধরেছে।

এলিজাবেথের শারীরিক বা মানসিক রোগের কোনো ইতিহাস নেই। কিন্তু গত কয়েক দিন থেকে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে।

এলিজাবেথের কাছে মনে হচ্ছে কেউ একজন বাসায় গোপন ক্যামেরা রেখে দিয়েছে। সেই ক্যামেরা দিয়ে তার সবকিছু রেকর্ড হচ্ছে। গোপন ক্যামেরা খুঁজে বের করার জন্য তিনি হন্যে হয়ে চেষ্টা করছেন।

প্রথমে মনে হয়েছে, সিলিং লাইটের সঙ্গে গোপন ক্যামেরা লাগানো। ঘরের সব কটি সিলিং লাইট খুলে ক্যামেরা খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। মনে হয়েছে, গোপন ক্যামেরার সম্ভবত ওয়াশিং মেশিনের পেছনে লাগানো। ওয়াশিং মেশিনকে ইউটিলিটি রুম থেকে বের করে এনে ক্যামেরা খুঁজেছেন কিন্তু ক্যামেরা কোথাও নেই। মনে হয়েছে টেলিভিশনের গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে থাকে মনিটর করা হচ্ছে। চেষ্টা করছেন কিন্তু টেলিভিশনের পার্টসগুলো আলাদা করতে পারেননি। তাই জানালার পর্দা দিয়ে টেলিভিশনকে ঢেকে দিয়েছেন। পরক্ষণে মনে হয়েছে দেয়ালের ভেতর গোপন ক্যামেরা আছে। গত রাত থেকে দেয়ালের প্লাস্টার খোলা শুরু করেছেন। মনে হচ্ছে টেলিফোন সেটে গোপন ক্যামেরা বসানো আছে। সে টেলিফোন সেটকে এখন তোয়ালে দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। এত কিছু করার পরও এলিজাবেথ আশ্বস্ত হতে পারেননি। মনে হয়েছে, জানালা দিয়ে গোপন ক্যামেরা তাকে মনিটর করছে। গত দুই দিন থেকে তিনি জানালা খোলেননি। বরং জানালায় বড় পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। বালিশ, বিছানা—সবকিছু ওলটপালট করে তিনি ক্যামেরা খুঁজছেন। কিন্তু ক্যামেরা পাচ্ছেন না!

জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক্যামেরা দিয়ে কে আপনাকে মনিটর করছে? কেন করছে? কখন থেকে করছে?’

‘আমি ঠিক জানি না কে করছে। তবে চার দিন থেকে আমার কাছে এমনটাই মনে হচ্ছে। সম্ভবত সরকার আমাকে গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে ফলো করছে। সরকারের সামাজিক দূরত্ব নিয়ম আমি ভাঙছি কি না, তা দেখার জন্য। বাসায় কোনো পার্টি দিচ্ছি কি না, তা সরকার খেয়াল রাখছে।’

‘এমনটা হওয়ার তো কথা নয়। সরকার কীভাবে এসে তোমার ঘরের ভেতরে ক্যামেরা ফিট করবে? তোমার ঘরের চাবি তো তোমার ছেলেমেয়ে এবং তুমি ছাড়া অন্য কারও হাতে নেই।’

‘আমি জানি না এবং জানার চেষ্টা করছি না। আমি যা জানি, তা হচ্ছে আমার ঘরের সব জায়গায় ক্যামেরা বসিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি বাথরুমের ভেতরেও ক্যামেরা। কয়েক দিন ধরে আমি শাওয়ার করতে পারিনি। ভয়ে ঘুমাতে পারছি না। রান্নাঘরে গিয়ে খাবার বা একটা কফিও বানাতে পারছি না। আমি এখন জাহান্নামের মধ্যে আছি।’

‘এ রকম একটি অবস্থা হচ্ছে, কিন্তু তুমি তোমার ছেলে বা মেয়েকে বলোনি কেন?’

‘করোনার এই আতঙ্কের মধ্যে আমি তাদেরকে বাড়তি টেনশন দিতে চাইনি।’

যখন কথা বলছি, তখন খেয়াল করে দেখি বাসার মেঝেতে ল্যাপটপের কিছু ছিন্নভিন্ন অংশ। জিজ্ঞেস করলাম, ল্যাপটপে কী হয়েছে?

‘ওরা এখন আমাকে ল্যাপটপের ক্যামেরা দিয়ে ফলো করছে’—এলিজাবেথের উত্তর।

‘তুমি বারবার ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছ কেন?’

‘ওরা এখন চলে আসতে পারে। আমার ভয় হচ্ছে ওরা চলে এলে ওরা আমাকে নিয়ে যাবে।’

‘কারা আসবে? কারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে?’

লেখক
লেখক



‘সরকারের গোপন বাহিনী। আমি নিশ্চিত, ওরা জানে আমি সরকারি আইন ভঙ্গ করেছি। আইন ভঙ্গ করে কদিন আগে সুপার মার্কেটে শপিং করতে গিয়েছিলাম।’

‘বাইরে যাওয়ার তো তোমার অনুমতি আছে।’

‘কিন্তু আমি মাস্ক পরে যাইনি।’

‘মাস্ক পরা তো ১৫ জুন থেকে কার্যকর হবে। এখন ভয় পাচ্ছ কেন?’

‘না, আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম। কেন আমি ব্যতিক্রম তা জানি না। তবে ওরা আমাকে বলেছে আমি আইন ভঙ্গ করেছি এবং আমাকে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে।’

‘কারা বলেছে?’

‘সরকারের লোকজন। আমি তাদের দেখি না কিন্তু তারা যে আমাকে নিয়ে কথা বলছে, তা শুনতে পারি। তোমাদের আসার আগে আমাকে বলে দিল আমি যেন তোমাদের জন্য বাসার দরজা খুলে না দিই। আমি হয়তো তোমাদের বাসায় ঢুকতে দিতাম না। কিন্তু ডেভিড বাসায় থাকায় আমি তা করতে পারিনি।’

আমাদের কথা এগিয়ে যায়। কিন্তু কোনো ফল আসে না। এলিজাবেথ নিশ্চিত যে সরকারের গোপন বাহিনী তাকে ফলো করছে। তার বাসার ভেতরে এবং বাইরে গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে। তাকে নিয়ে কথা বলছে। তার বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই যে তার জীবন এখন ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে আছে।

তাকে এখন এই গোপন ক্যামেরাগুলো খুঁজে বের করতেই হবে। গত রাতে দেয়ালে অনেক জায়গার প্লাস্টার তিনি খুলে ফেলেছেন। আরও খুলতে হবে। সম্ভবত ইলেকট্রিক ওয়্যারের (বৈদ্যুতিক তার) সঙ্গে গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে। তিনি এখন অন্য কিছু নিয়ে ভাবছেন না। গোপন ক্যামেরাগুলোকে তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। এই মুহূর্তে এলিজাবেথের এটি সবচেয়ে বড় কাজ! এই কাজ করতে গিয়ে তিনি মারা যেতে পারেন কি না, তা তাকে ভাবাচ্ছে না।

এলিজাবেথ এখন Auditory Hallucinations এবং Paranoid Delusion এ ভুগছেন। তাকে বাসায় রাখা ভয়ানক ঝুঁকির ব্যাপার হবে। তিনি যে গোপন ক্যামেরা খুঁজছেন, তা তার মনোজগতে কাল্পনিক ক্যামেরা। বাইরের পৃথিবীতেই এসব ক্যামেরার অস্তিত্ব নেই। নিরাপত্তা ও চিকিৎসার স্বার্থে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতেই হবে। যেহেতু এলিজাবেথের আগের কোনো রোগের ইতিহাস নেই, সম্ভবত চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে তার আগের জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তা সংঘটিত হওয়ার আগে ফার্ম হাউসে তাকে রেখে দেওয়া ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার প্রস্তুতি গ্রহণ করি।

*লেখক: ইংল্যান্ডে কর্মরত বাংলাদেশি সাইকিয়াট্রিস্ট। [email protected]