জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে

পরিবারের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

অন্তত বিগত শতাব্দীতে মনুষ্য জাতি এমন বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়নি—শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধকে মাথায় রেখেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। বিশ্বযুদ্ধগুলোর ভয়াবহতা প্রকট আকার ধারণ করেছিল মূলত যুদ্ধের মূল পক্ষ দেশগুলোর মধ্যে। আপাতদৃষ্টে নিরীহ বা অনেকটা বাধ্য হয়ে পক্ষ অবলম্বনকারী দেশগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, সেখানে পক্ষ চেনা এবং তার সামরিক সক্ষমতাসহ সবকিছু ছিল প্রতিপক্ষের নখদর্পণে। আর প্রতিপক্ষের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেই রণকৌশল সাজানো, এমনকি মিত্র দেশ সন্ধানের কাজটি সম্পাদন করা হতো।

আজ আমাদের অহংকারের সংসারে হানা দেওয়া কোভিড–১৯ বা করোনাভাইরাসে আমরা দিশেহারা। জীবনঘাতী ভাইরাস হান দেওয়ার আগ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী এমন একটা ভাব তৈরি হতে শুরু করেছিল, যেন আমরা সবকিছু জয় করে ফেলেছি। এমনকি সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্ব মোড়লদের করোনা নিয়ে হাসি–তামাশা আমাদের এমন ধারণা করতে বাধ্য করেছিল এটা আসলে তেমন কিছু না। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, আমি করোনা রোগীদের সঙ্গে হাত মেলাব। আমাদের উচিত করোনাকে আমাদের গালে মেখে নেওয়া। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে তিনি বললেন, ‘আমার যেকোনো কিছুই ঘটে যেতে পারত।’

মানবজাতির এবারের যে প্রতিপক্ষ, তার নাম কোভিড–১৯ এবং অপর পক্ষে সারা পৃথিবী। গত শতাব্দীতে তামাম দুনিয়া এক পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেছে, এমন কোনো প্রতিপক্ষ নেই। সারা পৃথিবী এক পক্ষ হতে পারে, এমন বিশ্বাস আমাদের উঠেই গিয়েছিল। কোভিড–১৯ অবশ্যই একদিন পরাজিত হবে এবং এত হারানোর মধ্যেও যদি আমাদের কোনো প্রাপ্তি থেকে থাকে, তবে তা হলো সারা পৃথিবীকে এক পক্ষে এনে দাঁড় করানো। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠকুলকে এত অসহায় হতে কে কবে দেখেছে। এই অসহায়ত্বের মূল কারণ হলো আমাদের এবারের প্রতিপক্ষ অদৃশ্য। অন্তত বিশেষ পরীক্ষণযন্ত্র ব্যতীত এই বিশেষ মেহমানকে দেখার কোনো উপায় নেই। সে আপনাকে জানান না দিয়েই আপনার শরীরের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে পারে ১৪ দিন পর্যন্ত। আপনার শরীর যদি রণে পারদর্শী না হয়, তবে ঘটে যেতে পারে যেকোনো কিছু।

এখানেই শেষ না। আপনার শরীর যদি পরাজিত হয়, তবে আপনি চলে গেলেন আপনার স্থায়ী ঠিকানায়। কিন্তু পেছনে রেখে গেলেন বিশেষ প্রজাতির বিপত্তি। আপনার পরিবার, এমনকি আপনি যে বড়িতে ছিলেন, সবাই পড়তে পারেন হোম কোয়ারেন্টিনের প্যাড়ায়, তা–ও অন্তত ১৪ দিন। সামাজিকভাবে আপনার পরিবার পড়বে এক বিশেষ অস্বস্তিতে, যেন তারা কোনো মহাপাপ করে ফেলেছে। আপনি যে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গেছেন, সেটা তারা কাউকে বলতে চাইবে না। যদিও অতি নিকটজনদের ফিসফিস করে জানায়, তা–ও বলবে, তোমরা আমাদের সান্ত্বনা দিতে বাসায় এসো না।

আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি লন্ডনের যে ফ্ল্যাটে থাকি, ঠিক আমার ওপরে ফ্ল্যাটের আংকেল মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আমি তার ঠিক নিচের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হয়ে এই খবর জেনেছি করোনায় মৃতদের ওয়েবসাইট থেকে। পরিবারটির সঙ্গে আমার এবং আমার চেয়ে বেশি আমার স্ত্রীর জানাশোনা কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদেরকে তারা জানায়নি যে সদা হাস্যোজ্জ্বল আমার ছাদের ওপরের আংকেলটি আর নেই। অন্য যেকোনো সময় হলে বিষয়টি ভাবা যায়। এ ঘটনাটিই কি যথেষ্ট নয় এই বিশ্ব মহামারির ভয়াবহতা অনুধাবনে।

ব্রিটেনের এরই মধ্য জীবন স্বাভাবিক করতে নানা কাজ শুরু হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
ব্রিটেনের এরই মধ্য জীবন স্বাভাবিক করতে নানা কাজ শুরু হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদিনই বাংলাদেশের খবরের কাগজে দেখছি, স্বামীর লাশ ফেলে যাচ্ছেন স্ত্রী করোনায় মৃত বলে। ভাই ভাইয়ের মৃতদেহ শেষবারের মতো দেখতে যাচ্ছে না মৃতদেহ থেকে সংক্রমণের ভয়ে। সারা পৃথিবী তছনছ করে দিয়েছে। আমাদের বীরত্বের অহমে হেনেছে নির্মম আঘাত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ‘করোনা–পরবর্তী বিশ্ব কোনোভাবেই আর আগের রূপ ফিরে পাবে না। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, কোনোভাবেই আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীকে আর সশ্ছিদ্র রাখতে পারি না।’

এত গেল সংক্রমিত ব্যক্তি এবং পরিবারের ওপর প্রভাব কিন্তু এখানেই এর শেষ নয়, বরং বলা যায় শেষের শুরু। আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের কোন অংশে কোভিড–১৯ প্রভাব ফেলেনি। আমাদের নিত্যদিন কার কোন আচারকে বদলে দেয়নি করোনা। বলা অনিশ্চিত কত দিন এই বদলে দেয় বলবৎ থাকবে অথবা এই নতুন আচারই আমাদের জীবনব্যবস্থায় পরিণত হবে কি না। আমাদের বিলেতি জীবনব্যবস্থার কোন পরতে করোনা প্রভাব ফেলেনি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এখানে কিছু বদলে যাওয়া আচারের নমুনা দেওয়া যেতে পারে।

গত তিন বছরে ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় প্রধান ব্যক্তি থেকে শুরু করে সব রাজনীতিবিদ এমনকি প্রান্তিক মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ব্রেক্সিট। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ব্যয়বহুল তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। দুজন প্রধানমন্ত্রী ঘরে ফিরে গেছেন। প্রতিদিন টেলিভিশন সংবাদ এবং খবরের কাগজের অন্যতম খোরাক ছিল এই ব্রেক্সিট। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর একটা বিশাল রাজনৈতিক বিজয় ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন। করোনা যেন ব্রেক্সিট আলোচনার মুখে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। নিয়মিত সংবাদ চ্যানেলগুলো ফলো করা আমি গত তিন মাসে একটি শব্দও শুনিনি গত তিন বছর কান ঝালাপালা করা এই ব্রেক্সিট নিয়ে। দেশটির রাজনৈতিক বিভাজন নিমেষেই উধাও। সব রাজনীতিবিদ এবং দলগুলো ঘোষণা দিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন অদৃশ্য এই শত্রুকে মোকাবিলা করতে।

প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় সরকারের প্রতিনিধি হয়ে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের শক্তিমান মন্ত্রী, প্রধান সায়েন্টিফিক অফিসার এবং প্রধান মেডিকেল অফিসার। ব্রিটেনের গৃহবন্দী মানুষ সারা দিন অপেক্ষায় থাকছে তাদের কাছ থেকে জানার, গত ২৪ ঘণ্টায় কতজন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। এরপর শুরু আক্ষেপের আহা আজ এতজন বেশি মারা গেলেন। কোনো দিন মৃত্যুর সংখ্যা একটু কম শোনা গেলে মনের কনে আশার সঞ্চার হতে থাকে, তা হলে কি করোনা করুণা করতে আরম্ভ করল। হয়তো পরের দিনই সব আশার গুড়ে বালি দিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে এল। এরই মধ্যে এপ্রিল মাসের শেষ দিনে সরকার এক লক্ষ্যের বেশি মানুষের করোনা টেস্ট করে বেশ কৃতিত্ব দাবি করে বসলেন। আর শুরু হতেই পিপিই–সংকট নিয়ে যে ব্যাপক সমালোচনা তার সূত্রপাত করেছিলেন আমাদের বঙ্গ সন্তান ডা. আবদুল মাবুদ চৌধুরী। তিনিও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। ডা. চৌধুরী জীবন দিয়ে সতর্ক করে গেলেন পিপিই–সংকট কতটা ভয়াভহ রূপ ধারণ করেছে খোদ ব্রিটেনে।

সব উন্নত দেশগুলোর মতো ব্রিটেনেও কেয়ার হোমগুলো বেশ নিরাপদ স্থান হিসেবেই পরিচিত ছিল দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের জীবনের শেষ সময়টা পার করার জন্য। ব্রিটেনে কেয়ার হোমগুলোর সেবার মান নিয়ে কোনো সময়েই তেমন অভিযোগ শোনা যায়নি। করোনা যেন মন স্থির করেই এসেছিল ব্রিটেনের অগ্রজদের দায় থেকে মুক্ত করবে কেয়ার হোমগুলকে। ২ জুন ব্রিটেন হতে প্রকাশিত নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকা সংবাদ দিয়েছে ব্রিটেনে ৮০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষেরা ৭০% বেশি মৃত্যুঝুঁকি বহন করে চলেছে করোনায়। বাংলাদেশি অরিজিন ব্রিটিশ নাগরিকদের এই মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আটটায় সারা দেশের মানুষ তার মূল গেটের সামনে, বাগানে, বারান্দায় এমনকি রাস্তায় এসে হাততালি দিয়ে করোনাযুদ্ধে প্রথম কাতারের যোদ্ধাদের জন্য হাততালি দিয়ে থাকেন। করোনা প্রকট আকার ধারণ করার পর ২৫ মার্চ হতে ক্লাপ ফর আওয়ার কেয়ারার–এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন ডাচ লন্ডনারস এনিমারি প্লাস নামের একটি সংগঠন। রাজপরিবারের সদস্য, প্রধানমন্ত্রী হতে শুরু করে দেশের সব মানুষ এই হাততালিতে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটেনে আটটি করোনাকালীন নাইটঅ্যাঙ্গেল হাসপাতাল বানানো হয়েছে, যার মধ্যে বড়টির ধারণক্ষমতা ছিল ২০০০ হাজারের বেশি। মাত্র দুই সপ্তাহে এই হাসপাতালগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সহায়তায়।

ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেসকে সহায়তার জন্য ফান্ড সংগ্রহে এগিয়ে আসেন প্রায় ১০০ শত বছরের ক্যাপ্টেন মুর ১০০০ পাউন্ড প্রত্যাশার বিপরীতে ফান্ড সংগ্রহীত হয় ২৭ মিলিয়ন পাউন্ড। অন্য দিকে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের গর্ব ১০০ বছরের বেশি দবিরুল ইসলাম চৌধুরী রোজা রেখে তার বাগানে প্রতি দিন ১০০ বার হেঁটে প্রায় ২ লাখ পাউন্ড ফান্ড সংগ্রহ করেন, যা করোনাযুদ্ধে ব্যয় করা হয়েছে।

প্রতিদিনকার চলাচলে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে করোনা। বাসগুলো বিনা পয়সায় যাত্রী পরিবহন করেছে। বাসে এমনকি পিক আওয়ারেও যাত্রীদের গাদাগাদি নেই। সবার চোখেমুখে এক অজানা ভয়, আতঙ্ক নিয়ে বাধ্য না হলে কেউ বাসে চড়ছে না। ট্রেনে যাত্রী নেই বললেই চলে। তবুও ট্রেন বিশেষ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে ক্রিটিকাল কর্মীদের জন্য। আকাশপথ বন্ধ, মুখ থুবড়ে পড়েছে আকাশ পরিবহনব্যবস্থা। শুধু ব্রিটিশ এয়ারলাইনস কোম্পানি ১২০০০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। অন্তত দুটি আকাশ পরিবহন কোম্পানি ইতি মধ্য নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। ব্রিটিশ সরকার এরই মধ্যে দেশের বাসগুলোকে সচল রাখতে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড ভর্তুকি প্রদান করেছেন।

দিগন্তজোড়া নয়নাভিরাম পার্কগুলো ফাঁকা পড়েছিল। শুধু ব্যায়াম করার জন্য কিছু মানুষের দেখা মিলত সেখানে। করোনা আক্রমণের শুরু হতেই সমুদ্রসৈকত ফাঁকা হতে থাকে। রাজনৈতিক সভা–সমাবেশসহ সামাজিক সংগঠন তাদের সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে। শুধু একটি সংগঠনকে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে এই মহামারিজুড়ে। সমাহিতকরণ সংগঠন, তারা করোনার চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সব ধর্মের মানুষদের তাদের ধর্মীয় রীতি মেনে দাফন করেছে। সংবাদপত্র দ্য সান ৩ জুন জানায় ৩৯৭২৮ জন মানুষকে দুফোঁটা চোখের জলে চিরবিদায় জানিয়েছে সমাহিতকরণ সংগঠনগুলো।

১০৩২০৮১১ জন ছাত্রছাত্রী বাসায় বসে অলস জীবন যাপন করছে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে। মহামারি শুরুর দিকে সরকার কিছুটা দোটানায় ছিল স্কুল নিয়ে কিন্তু অভিবাবকদের পক্ষ হতে ক্রমাগত চাপের কারণে সরকার দেশের সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে। ১ জুন থেকে সীমিত আকারে স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলের ক্ষেত্রে শুধু রিসিপশেন, প্রথম শ্রেণি এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যাবে পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আর সেকেন্ডারি স্কুল খুলেছে ১৫ জুন থেকে। ক্রিটিক্যাল ওয়ার্কার ছাড়া সব অফিস–আদালত বন্ধ থাকায় বাসায় বসে বসে ভার্চ্যুয়াল জগতে বিচরণ ছাড়া কিছুই করার নেই। তবে করোনা পরিস্থিতি উন্নতি করায় সরকার যাদের পক্ষে কর্মস্থলে যাওয়া সম্ভব, তাদের যেতে উৎসাহিত করেছে। ১ জুন থেকে কিছু স্ট্রিট মার্কেট খুলে দেওয়া হয়েছে।

ধর্মপ্রাণ মানুষদের জন্য সময়টা একদমই ভালো যায়নি। মার্চ মাস থেকে সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষত ২.৬ মিলিয়ন ব্রিটিশ মুসলমানের জন্য সময়টা ছিল অত্যন্ত নাজুক। এই করোনাকালে মুসলমানেরা পালন করেছেন তাঁদের সবচেয়ে বরকতময় মাস রমজান। এই রমজান মাসে কোনো ব্রিটিশ মুসলমান মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারেনি। সর্বশেষে যোগ হয়েছে এক বিবর্ণ ঈদ। খুব সম্ভবত গত এক শ বছরে ঈদের নামাজ এবং ঈদের কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ঈদের দিনটি উদযাপন করেছেন ব্রিটিশ মুসলমানরা। ২০ জুলাই হতে মসজিদসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে।

পৃথিবীর ৫ম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে ভূমিধসের মতো। চ্যান্সেলর ঋষি শোনাক ইতিমধ্য বলেছেন, আমাদের জন্য অন্ধকার দিন অপেক্ষা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন মন্দা ব্রিটেনের অর্থনীতিতে আর দেখা যায়নি। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ইনডিপেনডেন্ট গত ১৯ মে বলেছে, করোনা হানা দেওয়ার পর প্রথম তিন মাসে ব্রিটেনে বেকার হয়েছে ১.৩ মিলিয়ন মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে এর ভয়াবহতা অনুমান করাও অসম্ভব। দিশেহারা হয়ে চ্যান্সেলরকে আগামী জুলাই মাসে জরুরি বাজেট ঘোষণা করতে হচ্ছে। ২ জুন ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড টেলিগ্রাফ বলেছে ‘ঋষি শোনাকের প্রথম ১০০ দিনে ব্রিটিশ অর্থনীতি ছিল লাইফ সাপোর্টে। পরবর্তী ১০০ দিন তার ফোকাস হবে ভালো সেবার মাধ্যমে ব্রিটিশ অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।’

লকডাউন খুলে দিতে ব্রিটিশ সরকার পাঁচটি ধাপের ঘোষণা দিয়েছে মে মাসের মাঝামাঝিতে। সবকিছু পরিকল্পনা মতো চললে আগামী ১০ আগস্ট কাগজে–কলমে ব্রিটেন পরোপুরি লকডাউন মুক্ত হবে। সারা পৃথিবীর মতো ব্রিটেনেও রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং ব্যক্তিজীবনে করোনার প্রভাব হাজারো। এমন সব প্রভাব ফেলেছে করোনা, যা মানুষকে বয়ে বেড়াতে হবে যুগের পর যুগ। এ নিয়ে এখনই গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। বিশেষত কোমলমতি শিশুদের ওপর করোনার প্রভাব ট্রমার সৃষ্টি করবে বলে বিশেষজ্ঞ মতামত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এত সবের মধ্যেও আমাদের জীবন যাচ্ছে কেটে। কারণ জীবনের যেন এটাই নিয়ম কেটে যাবে তার নিয়মে। সারা পৃথিবী একদিন লকডাউনমুক্ত হবে এবং আমরা সত্যি সত্যি করোনামুক্ত হব। কিন্তু এই মহামারি আমাদের হৃদয়ে, মননে যে লকডাউন তৈরি করেছে, আমাদের অহংকার লকডাউন করে যে দানবীয় উন্মাদনায় মেতেছে, তার প্রভাব থেকে যাবে আগামী শতাব্দী অথবা তারও বেশি।