আমরা হার্ড-ইমিউনিটির পথে

প্রতীকী ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

হার্ড-ইমিউনিটি শব্দটি ইদানিং বেশ আলোচিত হচ্ছে । মোটামুটিভাবে হার্ড-ইমিউনিটি বলতে বোঝায়, একটি সোসাইটির অধিকাংশ লোকের মধ্যে কোনও রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠা। তা ৬০-৭০ শতাংশ লোকের মধ্যে গড়ে ওঠলে ধরেনেওয়া যায়, ঐ নির্দিষ্ট রোগ থেকে ঐ সোসাইটি মোটামুটি শংকামুক্ত!

আমাদের দেশে লকডাউন তুলে দিয়ে করোনাকে আরও প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তা প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধি দেখলেই বোঝা যায়। পরীপরীক্ষার অপ্রতুলতার কারণে যদিও এখনও আমরা আসল সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা করতে পারছি না। তবে করোনার গতিবিধি লক্ষ করলে এটা সহজেই অনুমেয়, আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। যে পরিমাণ মানুষের মাঝে কোভিডের উপসর্গ আছে, তাদের খুব অল্প সংখ্যক রোগীকেই পরীক্ষার আওতায় আনা যাচ্ছে। পরীক্ষা করা হলেও রিপোর্ট পেতে লেগে যাচ্ছে বেশ কয়েকদিন, তার মধ্যে করোনা আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।

আমার এলাকায় প্রায় সবার ঘরে ঘরে জ্বর। খবর নিলে জানা যায়, প্রায় সবখানেই জ্বরের প্রকোপ বেড়ে গেছে। এই জ্বর কয়েকদিন স্থায়ী হয়ে নিজে নিজেই চলে যাচ্ছে সাধারণ চিকিৎসায়। যদিও ‌অনেকেই অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। যা একেবারেই উচিত নয়। এ পর্যন্ত কোভিডের চিকিৎসায় কোনও অ্যান্টি বায়োটিকের কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়।

যাদের জ্বর আছে পরীক্ষা করলেই কোভিড পজেটিভ আসছে। সেজন্যই মোট পরীক্ষার প্রায় ২০-৩০ শতাংশ পজেটিভ পাওয়া যাচ্ছে। নমুনা সংগ্রহ এবং নানাবিধ সমস্যার কারণেও অনেক রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে। তাই এখন জ্বর হলেই ধরে নেওয়া যায়, কোভিড পজেটিভ।

এক্ষেত্রে করণীয় হলে ঘরে থেকে টেলিমেডিসিন সেবা নেওয়া। নিজেকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা নেওয়া। যদি কারও অন্যকোনও সমস্যা না থাকে কিংবা কোভিডের উপসর্গ, বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট অতিরিক্ত বেড়ে না যায়—হাসপাতালে যাওয়া উচিত না। ইতোমধ্যেই প্রায় সব কোভিড হাসপাতালে কোনোও বেড খালি নেই, সেক্ষেত্রে আপনাকে চাইলেও হয়তো কর্তৃপক্ষ ভর্তি করাতে পারবে না।

দেশে এখন কোভিডের যে পরিস্থিতি, তা দেখে মনে হচ্ছে এখনও আমরা কার্ভের পিক থেকে দূরে আছি। ততদিন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। তবে অন্যন্যা দেশের তুলনায় মৃত্যুহার কম বলে এখন যদি অবহেলা করা হয়, মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

আশার বাণী হলো, যাদের পূর্বতন কোনও রোগ না থাকে, সেক্ষেত্রে কোভিডে মৃতের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তাই যদি ব্যাপকভাবে জ্বরে আক্রান্ত এই বিশাল জনসংখ্যা সেরে ওঠে, তাদের মধ্যে রোগপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হবে, যা তাদেরকে পরবর্তী সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সহায়তা করবে।

ভ্যাকসিন আসতে এখনও অনেক দেরি। আসলেও বাংলাদেশে আসতে আসতে আরও অনেক সময় লাগবে। এত বিশালজনগোষ্ঠীকে টিকাদানের আওতাধীন করাও বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। আমাদের স্বাস্থ্যখাত ইতোমধ্যেই প্রায় ভঙ্গুর অবস্থায় চলেগেছে। এভাবে আরও কিছুদিন কোভিডের সংক্রমণ বাড়তে থাকলে একেবারেই ভেঙে পড়বে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য সাধারণ রোগিরা সেবা থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হবে, এখনও হচ্ছে।

প্রায় সবকিছু খুলে দেওয়াতে এখন ব্যক্তিগত সুরক্ষাও খুব একটা কাজে আসার কথা না। তারপরেও জরুরি কোনও কাজ কিংবা জীবিকার তাগিদ না থাকলে ঘরে থাকাই উচিত। ঘরের বয়োজৈষ্ঠদের বিশেষভাবে খেয়াল এবং যত্নের প্রয়োজন, বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ কিংবা কিডনি-সংক্রান্ত কোনও রোগে আক্রান্ত।

আমার ধারণা, বাংলাদেশ থেকে কোভিড আর যাচ্ছে না। অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধীর মতো এটিও সারা বছর বিচরণ করবে। যেমন যক্ষ্মার কারণে এখনও প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে। কারও জানা নেই, এই অজানা আতঙ্ক থেকে কবে মুক্তি মিলবে। তারপরেও জীবন চলতে থাকে। কিন্তু এই করোনা পৃথিবীর সবকিছু বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে প্রতিটি জীবনকে। এই বদল কতদিন স্থায়ী হয় তা-ই দেখার বিষয়!


*এমডি নিউরোলজি (অধ্যয়নরত), ইয়াংজো ইউনিভার্সিটি, জিয়াংসু, চীন। [email protected]