মায়ের কোলে চড়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম সেদিন

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল কম। যতটা মনে পড়ে আমি ছিলাম দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাস্তবে সেই বয়সের অনেক কথাই মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু মাকে নিয়ে লেখাটি লিখতে শুরু করার পর রীতিমতো আমাকে ধ্যান করতে হচ্ছে ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা আমার মনের মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য, তারপরই লিখছি।

যেদিন বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে পালাই সেদিন দুপুরে বাড়িতে এলেন মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন। তিনি খবর দিলেন, বাড়ি ঘিরে ফেলেছে শত্রুসেনারা। তখন দেরি না করে আমরা অনেকটা পড়িমরি করে বাড়ি ছাড়ি। বাবা তখন বাড়িতে ছিলেন না, যতটা মনে পড়ে, বাড়ির উত্তর পাশে খেতে গরু চরাতে গিয়েছিলেন। বাবার জন্য অপেক্ষা করলে মা–বোনদের ইজ্জত যাওয়া বা মৃত্যু ছিল অবধারিত। তাই মা আমাকে কোনোরকমে টান দিয়ে কোলে নিয়ে বাড়ির পুব দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। বাড়ির ভিটা তখন সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচু ছিল। বাড়ির পুব দিকে ফসলের খেত, এরপর বাঁশজঙ্গল। তার পরেই রয়েছে খাল। খালে তখন কোমর সমান ছিল পানি।

এলাকার সবার বাড়ি থেকে দৌড়ে পালানোর হিড়িক। সবাই দৌড়ে এসে ধুপধাপ করে খালের পানিতে পড়ছে। শরীরের সঙ্গে কাপড় জড়িয়ে আছে সবার, এতে চাইলেও সহজে দৌড়াতে পারছে না। পানিতে থাকা অবস্থায় মা চিৎকার দিয়ে বলল, ছোট বোন শেলীকে তো কেউ নিয়ে আসেনি। ও তো বড় (উত্তর পাশের) ঘরে রয়েছে। ছোট বোনের তখন খুব জ্বর ছিল। মা পারলে আমাকে যেন পানিতে ফেলে দিয়ে আবার যেন যায় দৌড়ে ছোট বোনকে আনতে।

বড় বোন মায়া (বর্তমানে ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন) মাকে বলল, মা তুমি যেতে থাকো আমি যাই, গিয়ে শেলীকে নিয়ে আসি। বলেই আবার পানি থেকে উঠে দৌড়ে গেল বাড়ির দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট বোন শেলীকে নিয়ে বড় বোন মায়া ফিরে এলে আবার দৌড়াতে থাকে পরিবারের সবাই। ততক্ষণে বাড়িতে ধুপধাপ শব্দ পাচ্ছি। সেদিনের সেই দৃশ্য কল্পনায় আনলে এখনো বুক ভারী হয়ে ওঠে।

খাল থেকে ওপরে উঠেই আবার পুব দিকে অজানার উদ্দেশে দৌড় শুরু। তখন শাইল খেতে বড় বড় মাটির চাকা (ঢেলা), তার ওপর দিয়ে এমনিতেই হেঁটে যাওয়া কষ্ট তার ওপর দৌড়ানো। কী যে কষ্ট হচ্ছিল সবার। তখনো মায়ের কোলে আমি। মায়ের কষ্ট করে দৌড়ানোর সেই দৃশ্য আমার চোখের পর্দায় স্থিরচিত্রের মতো বন্দী আছে। মাথার ওপর দিয়ে আর কানের কাছ দিয়ে গুলি যাচ্ছে। সময় সময় বাঁকা হয়ে উপুড় হয়ে পড়া, আবার দৌড়ানো। মা ক্লান্ত হয়ে ভাই–বোনকে অসহায়ের মতো বলছিল, আমাকে একটু কোলে নিতে। তখন রদবদল করে কোলে নিচ্ছিল সবাই আমাকে এবং বোন শেলীকে।

মা থেকে থেকে চিৎকার দিয়ে বলছে, তোর বাবা তো আসছে না, তোর বাবাকে দেখে কেউ নিয়ে আয়। একসময় বাবা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

বাবাকে পেয়ে এলাকার অনেকেই যেন প্রাণ পায়। একবার মা আমাকে কোলে নেয়, একবার মেজ ভাই। একবার বোন। এভাবেই কোলে নিয়ে আমাকে নিয়ে যায় আশ্রয়স্থানে। প্রথম এক স্কুলমাঠে এলাকার অনেকেই আমরা মাঠে বসে জিড়িয়ে নিই। এরপর আরও দূরে রাতে এক বাড়িতে আশ্রয় চাইলে সেখানে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করার কথা বলে কালক্ষেপণ করছিল। কিন্তু মধ্যরাতে সেই বাড়ির কর্তা গলায় গুলির মালা আর কাঁধে অস্ত্র নিয়ে বাড়ি ফিরলে বাবাকে প্রথমেই বললেন, চাচা, আপনার সেয়ানা মেয়েরা রয়েছে। ওদের নিয়ে এখনই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যান। নতুবা ওদের রক্ষা করা যাবে না। সেখানে আর মুহূর্তকাল দেরি না করে বাবা আমাদের নিয়ে রওনা দিলেন আবার কোনো অজানার উদ্দেশে। (যতটা মনে পড়ে লোকটি ছিল ডাকাত দলের সর্দার এবং পাকিস্তানিদের সহযোগী)।

বর্তমানে দেশে কোনো হিন্দুবাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলে মনে পড়ে আমাদের সেই দিনগুলোর কথা। কিছুদিন আগে মিয়ানমার থেকে আসা লোকদের (রোহিঙ্গা) দেখে খুব মনে পড়েছিল, আমরাও এভাবে দেশ তথা ভিটাবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। বাবা–মা মারা যাওয়ার আগে দেশে বাড়িতে গেলে বাবা-মার সঙ্গে বসে কথা বলতে বসে প্রায়ই বলতাম আমার কিন্তু এখনো মনে পড়ে সেই যুদ্ধের সময়কার কথা। সেদিন মা আমাকে সেভাবে কোলে নিয়ে না পালালে আমি হয়তো বাঁচতামই না।

আমি যেহেতু অসুস্থ তাই যুদ্ধ নিয়ে বসে কথা বলার সময় প্রায়ই বলতাম, আমি যেকোনো সময় মরে যেতে পারি। মা আমার এমন মরার কথা শুনে বলত, এমন অলুক্ষনে কথা বলতে নেই। বলত, আমরা যেহেতু দুজনই নব্বই বছর পার করেছি, তুইও আশির ওপর যাবি দেখিস।

মা-বাবা দুজনেই বলতেন, পারলে যুদ্ধের সময়কার কথাগুলো লিখে রেখে যাইস। মায়ের সেই কথার জন্যই সম্ভবত আমি মাকে নিয়ে লিখতে শুরু করেছি। চলবে...