আব্বুর জন্য

আমার দাদা-দাদুর আট সন্তানের মধ্যে আব্বু ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ফুফুর পরেই আব্বু। ছোটবেলা থেকেই আব্বু ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী। দেখতে শুনতে এতই সুন্দর ছিলেন যে দাদু নাকি প্রায়ই আব্বুর মুখে পাতিলের নিচের কালি মেখে রাখতেন। এই ব্যাপারটা অবশ্য তখনকার সময়ের একটি কুসংস্কার ছিল। ক্লাস ফাইভে এবং এইটে পড়ার সময় সেই যুগে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। এলাকাজুড়ে সাড়া পড়ে গিয়েছিল, শিক্ষা বোর্ড থেকে লোকজন যখন আব্বুর খোঁজে বাড়িতে আসতেন, দাদু আব্বুকে তখন খাটের নিচে লুকিয়ে রাখতেন, যেন কারও নজর না লাগে।

আমাদের দাদাজান ছিলেন পাকিস্তান আমলের স্বনামধন্য ফুটবল খেলোয়াড়। দাদাজানের ফুটবল খেলা ছিল নেশার মতো, দূরদূরান্তে চলে যেতেন খেলতে। ঘরে মন বসত না, উড়ু উড়ু মন। অর্থাৎ তখনকার দিনে আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে খেপ মারা। ভালো খেলতে পারলে টাকা আসত, না পারলে খালি হাতে ফিরে আসতেন। সংসারে সমস্যা দেখা দিলেই দুম করে জমি বিক্রি করে দিতেন। দাদুর হাতে কিছু টাকা দিয়েই কোথায় কোথায় খেলতে চলে যেতেন। দাদুর ভাষায়, হাওয়া হয়ে যেতেন।


আব্বুর মুখে শুনেছি, অল্প বয়সী দাদু খুব হিমশিম খেতেন সংসার, ছেলেমেয়েদের সামলাতে। আব্বু অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন, সেই গল্প আমাদের কাছে ছিল রূপকথার মতো। পড়াশোনার জন্য আব্বুর বাড়ির কাছাকাছি কোনো স্কুল ছিল না, তার ওপর অঙ্ক বুঝতে যেতেন কয়েক মাইল পথ হেঁটে। সিনিয়র কারও কাছ থেকে নিজে শিখে এসে ভাইবোনদেরও শেখাতেন। ভাইবোনদের কষ্ট করতে দিতেন না। বর্ষার সময়ে যদি পরীক্ষা থাকত, তাহলে এক সেট কাপড় পেঁচিয়ে পুঁটলি করে মাথায় বেঁধে সাঁতরে স্কুলে যেতেন। এখন আমাদের মতো কাপড়ের সমাহার ছিল না। বছরে একটা ঈদেই কাপড় হতো, সেই কাপড়ে বছর কাটাতে হতো। অনেক সময় ভাইবোনদের জন্য নিজেরটাও নিতেন না। নিজের স্টাইপেন্ডের টাকা দিয়ে নিজের পড়াশোনা করেছেন। অবসর সময়ে দাদুকে ঘর–গৃহস্থালির কাজে হাত লাগিয়ে সাহায্য করেছেন। ছোটবেলায় দেখতাম, ঢেঁকিতে কিছু ভানতে গেলেই আব্বু, ফুফুরা দাদুকে সাহায্য করতেন। দাদুকে তাই সব সময় আব্বুর ওপর আলাদা একটা ভালোবাসার, স্নেহের টান দেখতাম।


দাদুবাড়ির আদর এবং স্মৃতিপটে যে সোনালি অতীত জমা হয়ে আছে, সে ক্ষেত্রে বলব, আমরা অনেক ভাগ্যবান আমাদের পরবর্তী কাজিন এবং সন্তানদের তুলনায়। আমরা ছিলাম মানুষ, মাটি আর প্রকৃতির মধ্যে বড় হওয়া প্রজন্ম। আমার সন্তানেরা প্রযুক্তি আর ফাস্ট ফুডের ছত্রচ্ছায়ায় বড় হচ্ছে। দাদা, দাদু যত দিন বেঁচে ছিলেন, আব্বু তাঁর স্বর্বস্ব দিয়ে করে দিয়েছেন। ভাইবোনদের পড়াশোনা শিখিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন, প্রতিষ্ঠিত করেছেন।


বিএইচসি পাস করার পর আব্বু যোগ দেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে। এর কিছু মাস পরেই আব্বুর গলার কণ্ঠনালিতে একটা অসুখ ধরা পড়ে। মেজর একটা অপারেশন করতে হবে। সেই অপারেশনে চিরতরে কথা বলার শক্তি থাকবে কি না, ডাক্তাররা তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারেননি। আবার না অপারেশন করালে ওনার যে সহজাত কথা বলা, তাঁর স্বর অস্পষ্ট বা বদলে যেতে পারে। দ্বিতীয় অপশনটাই আব্বু বেছে নিলেন। আর এদিক দিয়ে শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধের দামামা। একদিকে দেশ, অন্যদিকে পাকিস্তানিদের চরম দুর্ব্যবহারে আব্বু মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েন। সঙ্গে নিজের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।


কুমিল্লা জেলা স্কুলে সিনিয়র বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেন। জানুয়ারিতে আম্মুর সঙ্গে বিয়ে এবং মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একদিকে নিজের পরিবারের ছোট ছোট ভাইবোন, অন্যদিকে আম্মুর পরিবার। দুজন দুই পরিবারের দ্বিতীয় বড় সন্তান।


পরবর্তীকালে অবশ্য আমার অসুস্থ নানাজির অনুরোধে আব্বু ভৈরব কেবি পাইলট হাইস্কুলে যোগ দেন। কয়েক মাস পরেই নানাজি মৃত্যুবরণ করলে দুই পরিবারের বিশাল দায়িত্ব আব্বুর কাঁধে চলে আসে। তখন আব্বুই একমাত্র পুরুষ কর্তাব্যক্তি। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আব্বু আম্মুর পড়াশোনা বন্ধ হতে দেননি। আম্মুর পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের ও পড়াশোনা আবার আমাদের দেখভালের সব দায়িত্ব পালন করেন আব্বু। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বলব, আমার দুই খালাম্মার অবদান ছিল অনেক। ওনারা আমাদের আগলে রেখেছেন। আম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেন। সবকিছুতে ছিল আব্বুর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। আমার দাদুবাড়ির কেউ চাননি আম্মু পড়াশোনা করুক, চাকরি করুক। কিন্তু না, আব্বু আম্মুকে পুরো স্বাধীনতা দিয়েছেন। আব্বুর এই উদারতাকে আমি সব সময় শ্রদ্ধা জানাই। দাদুর সব আবদার আব্বু হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন, পূরণ করেছেন। কিন্তু আম্মুর ক্ষেত্রে ওনার স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন।


শুধু সংসারের ক্ষেত্রেই নয়, আমি বলব আব্বু তাঁর কর্মক্ষেত্রেও একজন সফল শিক্ষক ছিলেন। অত্যন্ত দৃঢ়তায় দীর্ঘ ৩৫ বছর শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই দশক ছিল আব্বুর ক্যারিয়ার আর খ্যাতির খুব সুন্দর একটা সময়ের ছবি। একজন শিক্ষক কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা লাভ করলে তাঁকে আলাদাভাবে সম্মানের নামে ডাকা হয়! এখন পর্যন্ত আব্বু সবার প্রিয় খান স্যার হয়েই আছেন। আব্বুকে বেশ কয়েক বার প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিতে চেয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ কিন্তু উনি সম্মানের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন। আমরা যখনই জিজ্ঞেস করতাম, আব্বু বলতেন, তোমরা এখন এগুলো বুঝবে না, বড় হয়ে বুঝবে।


প্রধান শিক্ষকের পদে যাওয়া মানে কলের পুতুলের মতো বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এখানে কথা প্রসঙ্গে বলতে হচ্ছে, স্কুলে তখন স্থানীয় শিক্ষক অর্থাৎ এলাকা থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং এলাকার বাইরের শিক্ষক, এ দুইয়ের মধ্যে ছিল ঠান্ডা একটা লড়াই। এলাকার শিক্ষকেরা নিজেদের প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করতেন কিন্তু আব্বু দুবার ভৈরব উপজেলার শিক্ষক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন শুধু দুই পক্ষের শিক্ষকদের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক বজায় রাখতে। স্কুলের পরিবেশ, শিক্ষকদের অধিকার, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আব্বুর অবদান ছিল অনেক।

লেখকের বাবা।
লেখকের বাবা।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের হেড এক্সামিনার হয়েছেন তিনবার এবং একবার পুরস্কৃত হয়েছিলেন সেরা হেড এক্সামিনার হিসেবে। শুধু শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বললে ভুল হবে, স্কুলের আয়া, দপ্তরি নিয়োগে এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার, তাঁদের পরিবারের ও ভরসার জায়গা ছিল আব্বু। যেকোনো প্রয়োজনে তাঁরা সবাই আব্বুর কাছে ছুটে আসতেন। খুব গোপনে তাঁদের অভাব–অনটনে সাহায্য করতেন। নিজের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়দের বিভিন্ন জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু কখনোই প্রকাশ কর‍তেন না। কাউকে কিছু দান করার ক্ষেত্রে আমরা জেনে গেলে বলতেন, উপকার করে, বলে বেড়ালে সেটা আল্লাহর কাছে কবুল হয় না। আব্বু প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষের দোয়ায় আমি বেঁচে আছি। না হলে নোংরা রাজনীতির কবলে পড়ে অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতাম।’ নিম্ন আয়ের দপ্তরি, আয়া, ক্যানটিনের রান্নার লোকদের অবর্তমানে তাঁদের ছেলেরা স্কুলের চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া, গরিব অসহায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ভার, বিয়ে, সংখ্যালঘু শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যায় আব্বুর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। অবশ্য এই কাজগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে আব্বুকে অনেক মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হতে হয়েছে। নিজের ভাইবোনেরাও পিছিয়ে নেই এ ক্ষেত্রে। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন ওনার বন্ধু, সহযোদ্ধা, সহকর্মী শ্রদ্ধেয় জামান স্যার, হামিদ স্যার।


জামান স্যার, হামিদ স্যার ও আব্বু একই বৃন্তের তিনটি ফুল ছিলেন। আমি আজ ওনাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আজ যেহেতু বাবা দিবস উপলক্ষে লিখছি, সে ক্ষেত্রে এই লেখার দ্বিতীয় ধাপে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব এই তিন গুণী শিক্ষককে নিয়ে লেখার। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রথমভাগে শিক্ষকদের অনেক ক্ষেত্রে দমন করে রাখা হয়েছিল, শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে আব্বু অনেক সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। আব্বুসহ অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। স্কুল থেকেই আব্বু পালিয়ে যান। নারায়ণপুর আম্মুর মামাবাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন সপ্তাহখানেক। আব্বুরই এক সহকর্মী পুলিশের কাছে গিয়ে জানিয়ে আসেন আব্বুর লুকিয়ে থাকার জায়গার কথা। বাসায় প্রয়োজনে টাকা, কাপড় চেয়ে আব্বু আম্মুকে চিঠি লিখতেন। শেষের চিঠিতে আব্বু আমাকে দেখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। আমাদের ফলো করে যে পুলিশ গিয়েছিল, আমরা তখন বুঝিনি কিন্তু পথে আমার এক মামা দেখে ফেলায় আব্বু পালাতে সক্ষম হন। আব্বুকে না পেয়ে আমার সে কি কান্না! এর প্রায় এক মাস পর বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের (তখনকার কিশোরগঞ্জ জেলা জজকোর্টের ডাকসাইটে আইনজীবী ছিলেন তিনি), আম্মুর নানাবাড়ির দিকের কাছের আত্মীয়ও ছিলেন অবশ্য, ওনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আব্বু সেই মামলা থেকে অব্যাহতি পান। স্কুল সরকারীকরণে আব্বু, স্যারদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু তাঁর সুফল আব্বুরা ভোগ করে যেতে পারেননি। তাঁদের ত্যাগের কথা লিখতে গেলে এই লেখা আরও অনেক বড় হয়ে যাবে। আব্বুরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন, কষ্ট করেছেন এই জন্য যে পরবর্তী প্রজন্মরা ভালো থাকবে, স্কুলের পরিবেশ ভালো থাকবে।


গত বছর ইতালি ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমার কাজিন ফরিদুল ইসলাম ও আরিফুল ইসলামের আমন্ত্রণে। মার্কো পোলো বিমানবন্দরে নামার পর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই আমরা। ইতালি ভৈরব সমিতির পক্ষ থেকে প্রায় ১৫ জন পাঁচটি গাড়ি নিয়ে আমাদের ফুল দিয়ে সাদরে গ্রহণ করতে যান। একটাই ব্যাপার, তাঁদের প্রিয় স্যারের মেয়ে আমি। সেই মুহূর্তে গর্বিত বাবার মেয়ে হিসেবে গর্ববোধ করেছি। লেখাটি অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। মা–বাবা সম্পর্কে লিখতে গেলে কোনো লেখায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে হয় না। ওনাদের কোনো মাপকাঠিতে বা কোনো বিশেষণেও আবদ্ধ করা যায় না। মা–বাবা বেঁচে থাকতেই যদি তাঁদের সম্মানিত করতে না পারলাম, তাহলে সন্তান হিসেবে সেখানে আমার ব্যর্থতা থেকে যেত। মাথার ওপর থেকে যখন ছায়া সরে যায়, তখন রোদের তীব্রতা বোঝা যায়। হারিয়ে ফেলার পর স্মৃতিচারণা করার যে কষ্ট, আম্মুকে চিরতরে হারিয়ে বুঝেছি।
আব্বু, আমরা তোমাকে অনেক ভালোবাসি, অনেক।

সুস্থভাবে আমাদের আগলে রাখার তুমিই একমাত্র অবলম্বন। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জ্ঞাপন করছি।