করোনার কোনা থেকে বেরিয়ে একটা দিন

বেটসম্যান বেতে ফুটবল খেলা। ছবি: লেখক
বেটসম্যান বেতে ফুটবল খেলা। ছবি: লেখক

অস্ট্রেলিয়ার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে অনেক উন্নতি হয়েছে। দুটি প্রদেশ ছাড়া বাদবাকিগুলোতে পাঁচ-ছয় সপ্তাহ ধরে করোনাভাইরাসে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম। এখন পর্যন্ত এই যমদূতকে থামাতে দুটি প্রদেশের রীতিমতো ঘাম ঝরে যাচ্ছে।

কী ভয়ংকর এই ভাইরাস! অতি ক্ষুদ্র একটা জীব! সে কিনা এত বড় বড় মানুষ আর এত বড় দুনিয়াটাকে একেবারে কাবু করে ফেলল! সব দেশকে খাঁচায় পুরে ফেলল! ৮৬ লাখের বেশি মানুষ ইতিমধ্যেই আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল! কদিন আগে দুঃস্বপ্নেও এই বাস্তবতা ভাবা যেত না!
গত বছরের গ্রীষ্মের শুরু থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের শুরু। শুরুতে বুশ ফায়ার। দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশগুলোজুড়ে। ক্যানবেরাতে বসবাসের কারণে বুশ ফায়ারের অসহ্য রকম আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। মূলত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। ক্যানবেরার বাতাসের কোয়ালিটি দূষণের দিকে বিশ্বের ১ নম্বর হয়েছে। তখন দীর্ঘদিন ধরে এই ১ নম্বর স্থান ক্যানবেরার দখলে থেকেছে। এয়ার-রেটার অ্যাপে বাতাসের কোয়ালিটি দেখা দিয়েই প্রতিটা দিন শুরু হতো তখন। বাতাসের পি-২.৫–এর মাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে এত বেশি যে বাইরে গেলে অ্যাজমাসহ শারীরিক অনেক সমস্যা হতে পারত। অনেকের হয়েছেও তা–ই। তো বলতে গেলে এখনকার কোভিড সময়ের মতোই তখনো বেশির ভাগ সময়ই বাসার ভেতরে বসে কাটাতে হয়েছে। মুখে মাস্ক ব্যবহার করে বাইরে যাওয়া যেত। শপিং মলগুলোতেও ফাঁকফোঁকর দিয়ে ধোঁয়া ঢুকে যেত। আর তখন, কোভিড সময়ের হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর টিস্যুর আকালের মতো ফার্মেসি, কেমিস্টগুলোতে মাস্কের আকাল দেখা দিয়েছিল।
পরপর দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জীবনযাত্রায়, মানসিক অবস্থায় অচিন্তনীয় প্রভাব ফেলে চলেছে সেই সময় থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় এক মিলিয়নের মতো মানুষ ইতিমধ্যে কোভিডের বিষাক্ত নখে ছিন্নভিন্ন হয়ে চাকরি হারিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। সরকারি তথ্যমতে, এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে নাকি দুই বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
তবু মানুষের জীবন কখনো থেমে যায় না বা বেশি দিন থেমে থাকে না। ক্যানবেরাতে গত সাত সপ্তাহে মাত্র দুজনের কোভিডে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত ব্যক্তিরা অস্ট্রেলিয়ার বাইরে থেকে আগত বলেই জানা যায়। ক্যানবেরাতে মানুষের জীবনযাত্রা আগের থেকে অনেক স্বাভাবিক। এখন একসঙ্গে ১০০ জন জমায়েত হতে পারে। পাশের প্রদেশ নিউ সাউথ ওয়েলসেও নিয়মনীতি অনেক শিথিল।
জীবনটাকে তো আর খাঁচায় বন্দী রাখা যায় না। জীবনের ডানাগুলোকে আর কত দিন নতুন কবুতরের ডানায় সুতা দিয়ে বেঁধে রাখার মতো করে আটকে রাখব। বন্দীদের মতো করে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখব। জীবন তো উড়তে চায় ওই নীল আকাশে। ভাসতে চায় সাদা মেঘের মতো করে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতার মতো মনটা বলতে চায়, ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে/দেখবো এবার জগৎটাকে’।
করোনার কোনা থেকে বিধ্বস্ত মনকে বের করার জন্য এক দিনের ডে ট্রিপে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের দক্ষিণের একটি টাউন বেটসম্যান বে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। ভ্রমণের তারিখ সপ্তাহান্তের ছুটির দিন শনিবার, ১৩ জুন। ক্যানবেরা থেকে বেটসম্যান বে পূর্ব-দক্ষিণে ১৫০ কিলোমিটারের মতো দূরে। ভ্রমণের কয়েক দিন আগে থেকেই প্রতিদিন আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখা, যাতে গিয়ে বাজে আবহাওয়ার কারণে হতাশ না হতে হয়।
অনেক লং ট্রিপের চেয়ে এটি অনেক শর্ট হলেও মনে অন্য রকম আনন্দ, রোমাঞ্চের উপস্থিতি উপলব্ধ। এমন নয় যে বেটসম্যান বেতে আগে কখনো যাওয়া হয়নি, কিন্তু এবারের অনুভূতিটা একটু আলাদা। যেটা গত কয়েক মাসের বন্দিত্ব থেকে মুক্তির আনন্দ! জেলখানা থেকে বের হওয়ার আনন্দ! বিশেষ করে বাচ্চাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। তাদের পরিকল্পনায় কত কিছু। বিচের বালুতে খেলা, সমুদ্রের পানিতে গোসল, বিচে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট খেলা, পার্কে খেলা ইত্যাদি। তাদের বোঝাই, আমরা সেইখানে তিন-চার ঘণ্টা অবস্থান করব, তা–ও যদি আবহাওয়ার মন ভালো থাকে। এত কিছু তো কভার করা যাবে না। বাচ্চারা শুনলে তো! দিনটা তো তাদের! তারা নিজেই তাদের খেলাধুলার সরঞ্জামা গাড়িতে তুলে প্রস্তুত। যেহেতু যাত্রাপথ মাত্র দুই ঘণ্টা দূরত্বের, সকালে ঘুম থেকে উঠে আস্তে–ধীরে বাসা থেকে যাত্রা শুরু সকাল সাড়ে ৯টার দিকে।
ক্যানবেরা শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০ মিটার ওপরে অবস্থিত। চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মানে ক্যানবেরা থেকে বেটসম্যান বের সমুদ্র সমতলে যেতে ৬০০ মিটার নিচে নামা লাগবে। এই ধরনের যাত্রার পথগুলো সাধারণত সমুদ্রের কাছাকাছি জায়গায় অনেক আঁকাবাঁকা আর সরু হয়। এই পথও তার ব্যতিক্রম নয়। বাস্তবিক অবস্থায় পথের কোনো কোনো জায়গা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০০ মিটারের মতো উঁচু।
যাত্রাপথে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে ব্রেডউড নামের ছোট্ট একটি টাউন আছে। এ টাউনের কাছাকাছি জায়গাগুলো গত বুশ ফায়ারের সময়ে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর মূলত ব্রেডউডের বুশ ফায়ারের ধোঁয়াই ক্যানবেরাকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তো মনে কলাও বিক্রি করা হবে রথও দেখা হবে ভাবের একটা প্ল্যান ছিল যে যাত্রাপথে ব্রেডউডে ছোট্ট একটা বিরতি নিয়ে শহরটার আশপাশটা একটু ঘুরে দেখা। কিন্তু দুইটা ছানাই ঘুমিয়ে থাকার কারণে কোনো বিরতি ছাড়া সরাসরি বেটসম্যান বের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
প্রসঙ্গত, বেটসম্যান বের চারপাশের জঙ্গলগুলোতেও ব্যাপক বুশ ফায়ার হয়েছিল। শোনা যায়, সেই সময় সেখানকার মানুষ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দিন আকাশের কোনো মুখ দেখতে পায়নি ঘন কালো ধোঁয়ার কারণে। যাহোক, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছালাম বেলা সাড়ে ১১টার দিকে।
এবারই প্রথম আমার আস্তে ড্রাইভিং নিয়ে বউয়ের কাছ থেকে কোনো কথা না শুনে মনে শান্তি পাওয়ার সঙ্গে অনেক অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম, রাস্তায় কিছু মেরামতের কাজ চলার বা কুখ্যাত বাইকিদের একটি বহর দাঁড়িয়ে থাকার অথবা রাস্তা আঁকাবাঁকার কারণে বউয়ের মার্জনা পাওয়া গেছে! কারণ, যতবার লং ড্রাইভে যাই, বউ আমার গণনা করে কয়টা গাড়ি আমাকে ওভারটেক করল। আর যখন P–প্লেটওয়ালা ড্রাইভার ওভারটেক করে যায়, তখন তো কথার সঙ্গে পচানো মুচকি হাসিও দেখতে হয়! তখন মনে হয় গাড়ি আর মাটি দুই ভাগ হয়ে গেলে নিচে ঢুকে নিজেকে একটু আড়াল করি! তবু নিজে দমার পাত্র নই! নিজেকে বোঝানোর যত দক্ষতা আছে, সব বের করে নিয়ে আসি। বউকে বোঝাই, দেখো P-ড্রাইভার, তারা কেবলই লাইসেন্স পেয়েছে একাকী ড্রাইভিং করার। তারা তো এখন কেবলই ডানা পাওয়া পাখির মতো। তারা তো উড়বেই, জোরে চালাবেই। আবার বোঝাই, আমার লক্ষ্য পয়েন্ট A থেকে পয়েন্ট B–তে নিরাপদে যাওয়া। একটু আস্তে গেলে তো কিছু আসে–যায় না। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রিস্ক নিয়ে ড্রাইভিং করার কারণে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তো সবার প্রাণ যাবে। আমার বোঝানোর চেষ্টাগুলো অবশ্য এখনো সফল হয়েছে বলে মনে হয় না!

মালুয়া বিচে বাচ্চারা। ছবি: লেখক
মালুয়া বিচে বাচ্চারা। ছবি: লেখক

বেটসম্যান বেতে পৌঁছে রবীন্দ্রসংগীতের সেই গানটি যেন মনে বাজতে শুরু করল, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী...’। হ্যাঁ, এর আগে একবার এসেছিলাম বলে এই জায়গা চিনি। সেইবার এসেছিলাম গ্রীষ্মকালে। আবহাওয়া হতাশ করেনি। খুব চমৎকার আবহাওয়া ছিল। আর এবার পুরো শীতেও কী চমৎকার! ২১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। একেবারে হালকা বাতাস। নীল আকাশ। পুরো যেন বসন্তকাল। আহা! মন যেন তোমাকেই ভেবেছে, এঁকেছে তোমাকে পেনসিলের সূক্ষ্ম মাথা দিয়ে সাদা কাগজের ওপরে! আর সেই দিনের ক্যানবেরার আবহাওয়া পুরোপুরি উল্টো। ধিক্কার দেওয়ার মতো। ১২ ডিগ্রি তাপমাত্রা, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ...।
প্রায় দুপুর হয়ে যাওয়ার কারণে পেটটাকেই প্রথমে শান্তি দেওয়া আর ড্রাইভিংয়ের হালকা ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে একটু কোলাহলমুক্ত জায়গা পছন্দ করে ম্যাটটা পেতে বিচের পাশে বসা। কিন্তু কিসের কী! বাচ্চারা কী তা মানে! নেমেই দৌড়াদৌড়ি শুরু। খেলাধুলার সরঞ্জামাদি নামিয়ে খেলার জন্য প্রস্তুত। বলে, ‘বাবা আসো ব্যাডমিন্টন খেলি।’ আমি বলি, ‘না বাবা, একটু রেস্ট নিতে দে।’ কয়েক মিনিট পরে শুরু করি। তারা নাছোড়বান্দা। মন খারাপ করে। আসলে তারাই মনে হয় ঠিক। বাবা হ্যাজ টু বি লাইক এ সুপারম্যান! আবার বলাও যায় না যে বাবার বয়স হয়েছে। বুড়িয়ে যাচ্ছে। বললেই কান্না শুরু হবে, যাত্রাটাই মাটি হবে! তো আর কী করা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে খেলাধুলা শুরু করি। তবে তাদের আনন্দ দেখে ক্লান্তির বেশির ভাগটাই ইতিমধ্যে চলে গেছে। প্রথমে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু। ভাবা যায়, বিচের পাশে। নীল আকাশের নিচে। নীল পানির ধারে। সহনীয় রোদের মধ্যে। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলা। অন্য রকম মজা। শুধু হালকা বাতাসটাই যা একটু বেরসিক ছিল।
বিভব ইদানীং দেখি ব্যাডমিন্টন খেলায় খুব মজা পাচ্ছে। নিজের খেলার অভিজ্ঞতায় আর হালকা বাতাস থাকার কারণে মনে হলো, তার আই-হ্যান্ড কো–অর্ডিনেশন একটু টেস্ট করা যাক। বাতাসকে নিজেদের মধ্যে আড়াআড়িভাবে প্রবাহিত হতে দিয়ে কর্ককে বাতাসের প্রবাহের সঙ্গে একটু কোণ করে মারা, যাতে কর্কটা একটু বাঁকা হয়ে তার কাছে যায়। আর দেখা সে কর্কের কৌণিক গতি বুঝে মারতে পারে কি না। অনেকবার মিস করলেও বেশির ভাগই সে তার নাগালের মধ্য দিয়ে যাওয়া কর্কে মারতে বা র‍্যাকেট দিয়ে ছোঁয়াতে পারল। প্রয়োজনে সে দেখি রীতিমতো ডানে–বামে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। পড়ার পরে আবার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভাবি, আহা, বয়স কী জিনিস! অল্প বয়সের কারণে তার হাড়-মাংস সব রাবারের মতো। আর নিজের অবস্থা পুরা কাচের মতো, একটু ডানে–বামে গেলেই ভেঙে যেতে পারে। সে ভালো পারল কি না, তা নিজের সঙ্গে তুলনা করে বোঝা গেল। বাবা পরাজিত! পরাজিত হয়েও নিজের বিজয় দেখি সন্তানের মধ্যে। আর মনে মনে ভাবি, ‘যে সময়টা ফেলে এসেছি জীবনের নিয়মে, সে তো আর আসিবে না ফিরে, দেশান্তর হয়েছে সে যেন ঘরছাড়া হয়ে।’ মেয়ের আবার ফুটবল খেলার প্রতি বেশি আগ্রহ হওয়ায় তার সঙ্গে কিছুক্ষণ ফুটবল খেলাও চলল।
এদিকে বউ আমার দেখি সমুদ্রের পানি আর নীল আকাশের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। এক দৌড়ে কাছে গিয়ে তার ক্যামেরার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে কিছু ছবি তোলা হলো। কারও সেই দার্শনিক কথাটিকে পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা, ‘হ্যাপি ওয়াইফ, হ্যাপি লাইফ’! বলা বাহুল্য যে কোনো জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য কষ্ট করে সব খাবার বানানো থেকে পরিকল্পনাগুলো সব বউই করে। নিজেকে শুধু একজন ড্রাইভার আর বাচ্চাদের খেলাধুলার সঙ্গী ভাবতেই বেশি আনন্দিত বোধ করি।
এখানে দুপুরের খাবার শেষ করে আমার ছোট্ট মায়ের কোলে মাথা রেখে মিনিটখানেক জিরিয়ে নিয়ে কিছুটা শক্তি ফিরে পেলে পাশেই বাচ্চাদের খেলার করিংস বিচ পার্কে রওনা। বাচ্চাদের খেলার আগ্রহ, এনার্জি দেখে ছোটবেলার কথা ভাবতে থাকি। নিজে কেমন ছিলাম? নিজে তো মনে হয় এমন ছিলাম না? তিন দশক আগে নিজের বাল্যকালটাকে ফেলে আসার কারণে প্রায় কোনো কিছুই মনে নেই। এই উত্তর হয়তো বাবা-মায়ের কাছে আছে। এখানে জিপ-লাইনার রাইডে দুই বাচ্চাকে সমানসংখ্যক আটবার করে দৌড়ে দৌড়ে পুশ দিয়ে তাদের মনের খায়েশ নিবারণের চেষ্টার মধ্য দিয়ে আর বৃত্তাকার রাইডে দৌড়ে ঘুরে ঘুরে পুশ দিয়ে নিজের মাথা ঘুরার মধ্য দিয়ে অনেক্ষণ সময় গেল। কিছুক্ষণ বসে থেকে মাথার ওপরে দুনিয়ার ঘূর্ণন থেমে গেলে নিকটের মালুয়া বেতে রওনা।

মালুয়া বিচে সমুদ্রের পানির ঢেউ, বালুর রঙের সঙ্গে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের এক অপরূপ মিলন। মুহূর্তেই মুগ্ধ হওয়ার মতো। বাচ্চারা বিচে নেমেই ঢেউয়ের পানিতে পা ভিজিয়ে বিচের বালু নিয়ে খেলা শুরু। একজন আরেকজনের চেয়ে বালু কত গভীর করে তুলতে পারে, সুন্দর করে নিজের নাম লিখতে পারে, বালুর বল ঢেউয়ের পানিতে কত দূরে ছুড়ে মারতে পারে, ঢেউয়ের সাদা ফেনা হাতে তুলতে পারে ইত্যাদি প্রতিযোগিতা। বাচ্চাদের মাথায় কত ধরনের আইডিয়া! আর বড় দুজনের ভোঁতা মাথায় ছবি তোলা ছাড়া কিছুই আসে না। মোবাইল কোম্পানি ধন্যবাদ পেতে পারে মোবাইলের সঙ্গে ক্যামেরা টেকনোলজি যোগ করার জন্য। বিশেষ করে সেলফি ক্যামেরার জন্য!
এখানে দৈবাতে আমার এক অফিসের কলিগের সঙ্গে দেখা। সে–ও তার পরিবারকে নিয়ে এসেছে। তার কথাও একই, কোভিডের কারণে বাসায় থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছে। মনকে কোভিড থেকে একটু দূরে ঠেলাটাই উদ্দেশ্য। মালুয়া বিচে অসম্ভব সুন্দর কিছু সময় কাটিয়ে বেড়ানোর ইতি টেনে বাসার উদ্দেশে ক্যানবেরার মুখে রওনা।

মালুয়া বিচ। ছবি: লেখক
মালুয়া বিচ। ছবি: লেখক

লেখাটির শুরুর দিকে ব্রেডউড আর বেটসম্যান বের বুশ ফায়ারের কথা উল্লেখ করেছিলাম। ক্যানবেরার উদ্দেশে বেটসম্যান বে ছাড়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তার দুই পাশের উঁচু গাছগুলোর বুশ ফায়ারে ঝলসানো অবস্থা দৃশ্যমান। প্রায় প্রতিটি গাছেরই গায়ের ছাল পুড়ে হয় একেবারে খুলে পড়ে গেছে, নতুবা এখনো খুলে খুলে পড়ছে। দেখে অনেক মায়া লাগল।
গাছেরও তো প্রাণ আছে। তবে অনেক গাছের অফুরন্ত প্রাণশক্তি, মনের জোর, বেঁচে থাকার স্পৃহা আর ঘুরে দাঁড়ানো দেখে নিজের ভেতরে অনেক সাহস, অনুপ্রেরণা খুঁজে পেলাম। অনেক গাছ ইতিমধ্যে তার মনের জোর কাজে লাগিয়ে পুড়ে যাওয়া ছালগুলো ফেলে দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট নতুন ডাল-পাতা গজানো শুরু করে দিয়েছে। নতুনভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা থেকে কার্যকরভাবে বেঁচে থাকার যাত্রাও শুরু করে দিয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, এটা মানুষের জন্য প্রকৃতির একটা বড় মেসেজ। প্রকৃতি যেন প্রমাণ দিয়ে বলতে চাইছে, যতই বিপদ আসুক, তোমরা কখনো হাল ছেড়ো না। বেঁচে থাকার আশা নিয়ে চেষ্টা করলে, কষ্ট করলে তোমরা পারবেই।
আর প্রকৃতিই তো আমাদের শেখার–জানার নির্ভেজাল অগাধ ভান্ডার। আমরা তো প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিজ্ঞানী নিউটন আপেলগাছের নিচে বসে গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তো প্রকৃতির সত্যিকার ঘটনাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। গ্র্যাভিটেশনের তত্ত্ব দিয়ে গেছেন। আরেক বিজ্ঞানী মেরি কুরি পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রকৃতির আরেক প্রাকৃতিক ঘটনাকে জানার–বোঝার চেষ্টা করে গেছেন। বিজ্ঞানে দুইবার নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
করোনাভাইরাস যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তার উৎপত্তি যেহেতু এই প্রকৃতিতেই হয়েছে, তাকে কন্ট্রোল আর বিনাশের তত্ত্বও এই প্রকৃতিতেই নিহিত আছে। আর প্রকৃতির মানুষেরাই তা বের করে ফেলবে অচিরেই। ১০০ বছর আগে প্রাণঘাতী স্প্যানিশ ফ্লুও মানুষকে শেষ করতে পারেনি। অনেক দেশে যত গবেষণা চলছে আর গবেষণা যত দূর এগিয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের সফল ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হবেই। করোনাভাইরাসই নির্মূল হবে।
মানুষ বোকা মৌলিক কণা কোয়ার্কের মতো নয় যে প্রোটন, নিউট্রন, পায়নের মতো বড় অনেক কণার ভেতরে আজীবন আটকে থাকবে। মানুষ আবার তার ডানা ফিরে পাবে। নীল আকাশে উড়বে ইচ্ছামতো।
*তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া।